শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

বাহারি ফলের দেশ

শাইখ সিরাজ

বাহারি ফলের দেশ

এবার আমের মৌসুমে প্রচুর আম খাওয়া হলো। শুধু যে নিজে খেয়েছি তা নয়, স্বজনদেরও চেষ্টা করেছি আম উপহার দিতে। কৃষি সাংবাদিকতার চার দশকে দেশ-বিদেশের শত শত কৃষি উদ্যোক্তার সাফল্য তুলে ধরার সুযোগ হয়েছে। সেসব প্রতিবেদন দেখে নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। তবে আমার নিজের কৃষি উদ্যোগ বলতে তেমন কিছু নেই। শাহানার (আমার স্ত্রী) বাড়ির ছাদে একটা ছাদকৃষির আয়োজন আছে, যেখান থেকে এই করোনার সময়ে তাজা শাকসবজি পেয়েছি। ছাদে দু-একটি আমের গাছ আছে, সেখানে আম ফলেছে। আর আমি একটুকরো আমের বাগান গড়েছি। সে গল্প অবশ্য আপনাদের আগেও বলেছি। সেখান থেকে নিজ গাছের আম পেয়েছি। এ বছর বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষক তার বাগানের আম ভালোবাসার উপহারস্বরূপ আমাকে পাঠিয়েছেন। সে আম আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে পরম তৃপ্তি পেয়েছি।

আমাদের দেশে আম উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে আমরা শীর্ষ ১০-এ এসে গেছি। সব ফলের মধ্যে দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে আম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছে ১২ লাখ ২২ হাজার টন। প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার একর জমিতে আমবাগান রয়েছে। সে হিসাবে প্রতিটি গাছে গড়ে ৭৭ কেজি করে আম উৎপাদন হয়।

মনে আছে, এক যুগ আগেও আম ছিল শুধু বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ফল। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া ও ফজলি আমের ওপর দেশের চাষিরা নির্ভরশীল ছিলেন। আম্রপালি আম চাষের ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা ভেঙে দিয়েছে। বর্তমানে ৩০ জেলায় আমের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। দেশের মোট উৎপাদিত আমের প্রায় অর্ধেকই আম্রপালি। আম এখন আর মৌসুমি ফল নয়। চাষ হচ্ছে বারোমাসি আমের। কাটিমন ছাড়াও বারি-১১ জাতের আম বারো মাস ফল দিচ্ছে। পাঠক, ফেনীর সোনাগাজীর মেজর সোলায়মানের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। যিনি মাছের খামারের ৩৩ একর জলায়তনের চওড়া পাড় জুড়ে ৮০ জাতের আম উৎপাদন করছেন।  যেখান থেকে বছরে প্রায় ২০-২৫ টন আম পান তিনি। সোলায়মান সাহেবের বারি-১১ জাতের আম গাছ আছে ৭০টি। মাত্র পাঁচ বছর বয়স এসব গাছের। তিনি জানিয়েছিলেন প্রতিটি গাছ থেকে কমপক্ষে ১০০ কেজি আম পাওয়া যায়।

আমাদের দেশের কৃষক যে অনন্য এবং প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ দেখাতে সক্ষম তার প্রমাণ দিয়েছেন অনেক কৃষক। দুই যুগ আগেও আম আর কাঁঠাল ছিল এ দেশের প্রধান ফল। কৃষকের আঙিনার গাছে ফলানো উদ্বৃত্ত ফল বাজারে মিলত। আঙিনা থেকে ফল চলে এসেছে ফসলের মাঠে। কৃষি অধিদফতরের হিসাবে এখন বাংলাদেশে ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১.৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে ৫০.৭ লাখ মেট্রিক টন ফল উৎপাদন হয়, যার মধ্যে আম, কলা ও কাঁঠাল থেকেই আসে মোট উৎপাদিত ফলের প্রায় ৬৩% (বিবিএস-২০১৮)। নিত্যনতুন ফল চাষ বাড়িয়েছেন কৃষক। ড্রাগন তো আছেই, রামবুটান, অ্যাভোকেডো, স্ট্রবেরি, বাউকুল, আপেলকুল, ত্বিন এমনকি আপেল পর্যন্ত ফলিয়ে ছাড়ছেন দেশের মাটিতে। নানান জাতের ফলের উৎপাদনের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ফল উৎপাদন করে কৃষক তার নিজের নামও যুক্ত করে নিয়েছেন ফলের সঙ্গে। যেমন পেঁপে বাদশা, পেয়ারা আতিক, কুল সিরাজুল, আম কাশেম, মালটা বাবুল, খেজুর মোতালেব, লিচু কিতাব, কলা কাদের। নামগুলো মোটেও কাল্পনিক নয়। দেশের প্রায় সব ফল চাষি এ নামগুলোর সঙ্গে পরিচিত। আশির দশকে পাবনার ঈশ্বরদীর সলিমপুর গ্রামের এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মো. শাহজাহান আলী বাদশা বেকারত্ব দূরীকরণের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কৃষিকাজ। মাত্র আড়াই বিঘা জমিতে শুরু করেন আধুনিক ফলফসলের এক সমন্বিত কৃষি খামার। তারপর পেঁপে চাষ করে খুব অল্প সময়ে অর্থ আর খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান। এখন ২০০ বিঘা আয়তনের এক বিশাল কৃষি খামারের অধিকর্তা তিনি। সবার কাছে পেঁপে বাদশা নামেই পরিচিত। কৃষি ডিপ্লোমা করেও কোনো চাকরি না পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আতিক আজ থেকে ১০ বছর আগে মাত্র ৬ বিঘা জমি লিজ নিয়ে শুরু করেছিলেন পেয়ারাবাগান। পেয়ারা চাষ তার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এখন তার বাগানের পরিধি ২৭০ বিঘার মতো। তার এ সাফল্য দেখে ওই এলাকায় বহু তরুণ যুক্ত হয়েছেন পেয়ারা চাষে। ফলে নাটোর-রাজশাহী এলাকায় অর্থকরী ফসলের অন্যতম জায়গায় পৌঁছে গেছে থাই পেয়ারা। এ রকম গল্পই কাশেম, বাবুল কিংবা কাদেরের। ফল চাষ পাল্টে দিয়েছে তাদের জীবনের গল্প। সারা দেশে এমন কৃষকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই কৃষকের সাফল্যের পেছনে নেই কোনো আলাদিনের চেরাগ। বুদ্ধি আর শ্রমেই গড়েছেন তাদের নিজ নিজ সাম্রাজ্য। এদের হাত ধরেই বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে সফলতার উদাহরণ হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে বাংলাদেশে ১৮ বছর ধরে ফল উৎপাদন বাড়ছে ১১.৫ শতাংশ হারে। ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হারের রেকর্ডটি আমাদের। শুধু তাই নয়, মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এ সাফল্যে ফল চাষিদের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

শহরের বাড়ির ছাদগুলোয়ও হরেক রকম ফলের চাষ হচ্ছে। মনে আছে, আশির দশকে যখন বিটিভিতে মাটি ও মানুষের প্রোগ্রাম করি তখন বাড়ির ছাদে কাজী পেয়ারার চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এখন ছাদকৃষি উদ্যোক্তারা শুধু পেয়ারাই নয়, আখ থেকে শুরু করে জামরুল, ড্রাগন, পেঁপে, জলপাই, তেঁতুল এবং বিদেশি ফলের মধ্যে ত্বিন, এমনকি কলাও চাষ করছেন। ফল চাষের এ বিস্তারে দেশের নার্সারিগুলোর ভূমিকাও অপরিসীম। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী দেশে নিবন্ধনকৃত নার্সারির সংখ্যা ১৮ হাজার। অনিবন্ধিত নার্সারির সংখ্যা আরও বেশি। বিনিয়োগের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। ৫ লাখের অধিক মানুষ এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব নার্সারিতে দেশি ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফলের বিভিন্ন জাতের চারা পাওয়া যায়। নার্সারিগুলোও জাত উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। তবে অনেকেই কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি অনুসরণ না করে দেশের বাইরে থেকে সায়ান, গাছের চারা, বীজ নিয়ে আসছেন। সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে, কারণ ফাইটো স্যানিটারি সার্টিফিকেশন নিশ্চিত না হলে বৃক্ষের জন্য ক্ষতিকর জীবাণুও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফল চাষে বাংলাদেশের সাফল্য সত্যিই আশাজাগানিয়া। তবে ফল চাষিদের বেশ কিছু সমস্যার কথা আমি শুনেছি। যেমন বরিশাল ও দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচুর পেয়ারার চাষ হয়, কিন্তু মৌসুমে পেয়ারার কোনো দাম কৃষক পায় না। কারণ পেয়ারা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই পেয়ারা থেকে জ্যাম-জেলি তৈরির কোনো কারখানা। ফলে কৃষক তার উৎপাদিত ফল নিয়ে পড়ে সমস্যায়। এ সমস্যা শুধু পেয়ারার ক্ষেত্রেই নয়, আনারস কিংবা আমের ক্ষেত্রেও। বাজার তৈরি করতে ফলের রপ্তানি রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। রপ্তানির জন্য কমপ্লায়েন্স মেনে ফল উৎপাদন ও বাজারজাত করা গেলে এটি হবে কৃষির সোনালি খাত।

লেখাটি শুরু করেছিলাম আম নিয়ে এবং আম দিয়েই শেষ করতে চাই। গত বছরের ঘটনা। আমরা জানি সুমিষ্ট আমের দেশ হিসেবে ফিলিপাইনের খুব সুনাম রয়েছে। গত বছর ফিলিপাইনে আমের ফলন খুব ভালো হয়েছিল। এত ভালো হয়েছে যে ২ মিলিয়ন কেজি আম বেশি উৎপাদিত হয়েছে। ফলে আমের দাম পাচ্ছিল না কৃষক। বাজার অর্থনীতিতে এমনটা ঘটতেই পারে। সে দেশের কৃষি বিভাগ আম চাষিদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তারা খুব দ্রুত সময়ে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়। তাদের কার্যক্রমগুলোর একটি হচ্ছে, ‘মেট্রো ম্যাংগো’। তারা বিভিন্ন শহরে আম বিক্রির জন্য অসংখ্য স্টল তৈরি করেছে। আম রপ্তানির ব্যবস্থা করেছে। ওয়ালমার্ট কৃষকের আমের জন্য বিনামূল্যে স্টল বরাদ্দ দিয়েছে। সবাই মিলে দাঁড়িয়েছে কৃষকের পাশে। কারণ কৃষক একবার হেরে গেলে সমগ্র কৃষির ওপরই এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।

আমাদের দেশে যদিও লকডাউনে ফল পরিবহনে কোনো প্রভাব পড়েনি, প্রভাব পড়েছে ক্রেতার ফল কেনায়। স্বাভাবিক নিয়মেই ফল কেনা কমিয়ে দেয় গ্রাহক। ফলে প্রচুর আম বাজারে রয়ে যায়। এবং প্রচুর আম পচে নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক এ সময়টাতে এসে ফল প্রক্রিয়াজাতকরণের গুরুত্বটুকু অনুধাবন করা যায়। উন্নত দেশগুলো ফল প্রক্রিয়াজাতকরণে এগিয়ে আছে।

আমাদের দেশেও ফল প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা উচিত। পেয়ারা থেকে জ্যাম-জেলির শিল্পকারখানা হতে পারে। আনারস থেকে হতে পারে জুস। এ ছাড়া মাল্টা, তরমুজ, বাঙ্গিসহ নানা ফল থেকে তৈরি হতে পারে নানা জাতের খাদ্যদ্রব্য। ফল নিয়ে আমাদের সম্ভাবনার ক্ষেত্রটা অনেক বড়। সারা বিশ্বেই ফলের বড় একটি বাজার আছে। তা মাথায় রেখে ফল চাষ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তৈরি করতে হবে ফল সংরক্ষণাগার ও বাজার কাঠামো। সরকারের পাশাপাশি ফলকে নিয়ে বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি করতে এগিয়ে আসতে হবে শিল্পোদ্যোক্তাদের।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর