শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

আড়ি পাতার সংস্কৃতি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

আড়ি পাতার সংস্কৃতি

প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। আমেরিকার কুখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির নায়ক নিক্সনকে চিরদিনের মতো রাজনীতি থেকে অবসর নিতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গ দিয়ে কেন এ লেখা শুরু করলাম তা পাঠক বুঝতে পারবেন নিচের প্রসঙ্গে গেলেই। তেল আবিবের (ইসরায়েল) তৈরি পেগাসাস মারণাস্ত্র মোদির হাতে বিক্রি করা হয়েছে। মোদি কয়েক বছর আগে যখন ইসরায়েল সফরে গিয়েছিলেন তখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু এ মারণাস্ত্র তার কাছে কোটি কোটি ডলারে বিক্রি করেছিলেন। গোটা বিশ্বে এখন চর্চার প্রধান বিষয় হলো ইসরায়েলের এনএসও কোম্পানির তৈরি পেগাসাস। আর এ অস্ত্র হাতে পেয়েই মোদি এবং তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, গোয়া, মণিপুর, মেঘালয়- এ পাঁচ রাজ্যের সরকারের পতন ঘটিয়ে বিজেপি সরকার তৈরি করছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, প্যারিসের লে মনডেসহ পৃথিবীর ৩০টি সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা অন্ততদন্ত করে এ বিষাক্ত স্পাইওয়ার ভারতের হাতে যে আছে তা ফাঁস করে দিয়েছেন এবং মোদি সরকার তা ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতের গণতন্ত্র ধ্বংস করে বিভিন্ন বিরোধী নেতা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, বিশিষ্ট আইনজীবী, শিল্পপতি, নির্বাচন কমিশন এবং প্রায় ৩০০ সাংবাদিককে টার্গেট করেছে। এমনকি তার নিজের দলের সাংসদ ও মন্ত্রীকেও টার্গেট করা হয়েছে বলে ওই অন্ততদন্তে প্রকাশ। বিরোধী নেতাদের মধ্যে রয়েছেন রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ছাড়াও রাহুল গান্ধীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত আরও পাঁচজন। আছেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে, শারদ পাওয়ার, কর্ণাটকের এইচ ডি কুমারস্বামী ও তার সচিব এবং কংগ্রেসের একাধিক নেতা ও তাদের সচিবরা। সর্বশেষ যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁসহ পৃথিবীর তিনজন রাষ্ট্রপতি, ১০ জন প্রধানমন্ত্রী এবং একজন রাজা পেগাসাসের লক্ষ্য। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন চলছে তখন ইতিহাসের কুখ্যাত নায়ক, আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সন হোয়াইট হাউসে বসে বাঙালি হত্যার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ইয়াহিয়া খানকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ পৃথিবীর প্রায় সব নেতাই নিক্সনের এই বাঙালি হত্যার নিন্দা করছিলেন। কিন্তু তিনি কাউকেই গ্রাহ্য করেননি। কথায় বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। চার বছরের মধ্যে ১৯৭৪ সালে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে তাকে চিরদিনের জন্য ক্ষমতাচ্যুত করে মার্কিন সিনেট, সংবাদমাধ্যম ও মার্কিন বিচারব্যবস্থা। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি কী তা ভারত ও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই হয়তো এখন ভুলে গেছেন। ১৯৭৪ সালে ওয়াশিংটনের ওয়াটারগেট নামের একটি বাড়িতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনের কৌশল নিয়ে গোপন আলোচনা চলছিল ডেমোক্র্যাটদের। সে সময় রিপাবলিকান পার্টির নেতা, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (এফবিআই) দিয়ে আড়ি পাতিয়ে সেই গোপন বৈঠকের সবকিছু শুনে এবং রেকর্ড করে নেন। এ খবর ফাঁস করে দেয় ওয়াশিংটন পোস্টসহ বেশ কয়েকটি মার্কিন সংবাদপত্র। বিশ্বজুড়ে হইচই পড়ে যায় এ ঘটনায়। ইসরায়েলের এনএসও জানিয়েছে, তারা কোনো বেসরকারি সংস্থার কাছে এ স্পাইওয়ার বিক্রি করেনি, বিক্রি করেছে ভারত সরকারের কাছে। এখন ভারতের বিচারপতি, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, কূটনীতিক, বিদেশ মন্ত্রকের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক প্রমুখ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, দেশের সরকার কোন এজেন্সিকে দিয়ে এ স্পাইওয়ার কাজে লাগিয়েছে? দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই, এনআইএ, আইবি এবং র- কোন এজেন্সি এ কাজে সরকারকে সহায়তা করেছে তার নাম প্রকাশ্যে আনার দাবি তুলেছেন বিশিষ্টরা। কিন্তু সংসদে মোদি বা অমিত শাহ কেউই এ নিয়ে কথা বলছেন না। যার ফলে গত এক সপ্তাহ ধরে সংসদের দুই কক্ষেই অচলাবস্থা চলছে (এ লেখা পর্যন্ত)। বিরোধীরা এ নিয়ে সরকারের বিবৃতি দাবি করেছেন, কিন্তু সরকার নীরব। একজন সাবেক বিদেশ সচিব প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ক্যান উই ডু টু কালপ্রিটস হোয়াট আমেরিকা ডিড টু নিক্সন’। ভারতের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমানা প্রশ্ন তুলেছেন, ব্রিটিশ সরকারের তৈরি রাষ্ট্রদ্রোহ আইন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও দেশের সরকার রেখে দিতে চায় কেন? তিনি বলেছেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছেন তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগ করে এর অপব্যবহার করছে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা করার ক্ষেত্রে কোনো দায়বদ্ধতা নেই।’ এ ব্যাপারেও সরকার নিশ্চুপ। এ লেখা পর্যন্ত সরকার শীর্ষ আদালতে কিছুই জানায়নি। ফোনে আড়ি পাতা নিয়ে আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে ফোনে আড়ি পাতার অনুমতি সরকারের জন্য আইনে রয়েছে ঠিকই, তাই বলে মোবাইল ফোন হ্যাক করার অনুমতি আছে কি? তাদের বক্তব্য, সে ছাড়পত্র নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিগ্রাফ আইনে ফোনে আড়ি পাতার অনুমতি থাকলেও হ্যাক করার ছাড়পত্র নেই। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী করুণা নন্দীর মতে দেশের নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও তদন্তের স্বার্থে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৯ নম্বর ধারায় শুধু ফোনে আড়ি পাতা, নজরদারি ও সাংকেতিক বার্তা পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। টেলিগ্রাফ আইনের ৫ নম্বর ধারায়ও আড়ি পাতার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে। তাই বলে মোবাইল ফোনে স্পাইওয়ার ইনস্টল করে তথ্য চুরি আইনত অপরাধ। কংগ্রেস আবার প্রশ্ন তুলেছে, সারা দেশে এত ফোনে নজরদারির টাকা (ফোনপিছু প্রায় ১ কোটি টাকা) এলো কোথা থেকে? করদাতাদের টাকার এ অপচয় কেন? ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই ইসরায়েল নানাভাবে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছিল তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে লালবাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, পি ভি নরসিমা রাও কেউই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেননি। শেষ পর্যন্ত অটল বিহারি বাজপাইর আমলে ভারতের স্বীকৃতি পায় ইসরায়েল।

পেগাসাস স্পাইওয়ার কি ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেবে, নাকি নরেন্দ্র মোদি নিজেই দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থে এটি প্রত্যাহার করে নেবেন? অনেকেই মনে করছেন, মোদি এটি প্রত্যাহার করবেন না। বরং এ স্পাইওয়ার কাজে লাগিয়ে আগামী বছর ছয়টি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এবং সর্বোপরি ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের বৈতরণী পেরোনোর চেষ্টা করবেন। তাই অবিজেপি সব দল একাট্টা হয়ে ‘বিজেপি হটাও দেশ বাঁচাও’ স্লোগান দিতে শুরু করেছে। এখন আগামী দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া ভারতবাসীর আর কিছু করার নেই।

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক [ভারত]।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর