রবিবার, ২৫ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

রবির কিরণে সিক্ত শৈলজারঞ্জন মজুমদার

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

রবির কিরণে সিক্ত শৈলজারঞ্জন মজুমদার

একজন ছাত্র, শৈলজারঞ্জন মজুমদার। তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন আচার্য্য প্রফুলচন্দ্র, বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রসায়ন শাস্ত্রের একজন ছাত্র হয়ে উঠলেন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। যিনি মনে করতেন তাঁর নিজের গুণ বলতে কিছুই নেই। তিনি রবির কিরণে আলোকিত একজন মানুষ মাত্র। এ অঞ্চলে রবীন্দ্রচর্চার মাধ্যমে বিশুদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশে তিনি চিরকাল একজন উজ্জ্বল পুরুষ। প্রতি বছর জুলাইয়ের এই সময়ে মননে তাঁর কীর্তি ঘুরে ফেরে।

১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশ্বিক পরিচিতি লাভ করেন। বাঙালি জনগোষ্ঠীকেও চিনতে পারে বিশ্ব। এর আগে তিনি দেশে বা বিদেশে পরিচিত ছিলেন না আমি সে কথা বলছি না। তিনি ভারতবর্ষ তো বটেই ভারতের বাইরেও বিভিন্ন দেশে ধীরে ধীরে পরিচিত ব্যক্তি হয়ে উঠছিলেন। তবে নোবেল প্রাপ্তির পর পরিচিতির ব্যাপকতা বিস্তৃত হয় অনেক। এ কথা নিশ্চয়ই সবাই মেনে নেবেন। এশিয়া মহাদেশে প্রথম নোবেল পুরস্কারজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ পর্যন্ত এ মহাদেশটিতে কতজন বিখ্যাত মানুষ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এর হিসাব নিশ্চয়ই নোবেল পুরস্কার প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। বাঙালির গর্বের বিষয় এটিই যে এশিয়া মহাদেশে নোবেল পুরস্কার এসেছে একজন বাঙালির হাত ধরে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত গবেষণা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়ে আসছে। আমার এ লেখাটি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত কোনো গবেষণা নয়। তা করার যোগ্যতাও আমার নেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন একান্ত অনুগত ভাবশিষ্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে নিয়ে আমার আজকের এ লেখা। পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যারা সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলেছিলেন তার মধ্যে শৈলজারঞ্জন মজুমদার ও দেবব্রত বিশ্বাসের নাম উল্লেখযোগ্য। দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন কিশোরগঞ্জের মানুষ। তিনি রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে এ সংগীতকে পূর্ব বাংলাসহ সমগ্র বঙ্গের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে অসামান্য অবদান রেখেছেন। অন্যদিকে শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছিলেন শুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের একজন ভ্যানগার্ড। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ১৯৩৪ সালে তিনি প্রথম রবীন্দ্রসংগীত ‘মম মন উপবনে’ গানের স্বরলিপি তৈরি করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শৈলজারঞ্জন মজুমদার রসায়ন শাস্ত্রে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন, সম্ভবত ১৯২৪-১৯২৫ সালে। ১৯৩২ সালে শান্তিনিকেতনে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে শৈলজারঞ্জন মজুমদার সরাসরি কবিগুরুর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। ছাত্রজীবন থেকেই শৈলজারঞ্জন ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত মানুষ। ১৯৩২ সাল থেকে কবিগুরুর প্রয়াণকাল পর্যন্ত তিনি তাঁর সরাসরি সান্নিধ্যে থেকে অনেক গান, নৃত্যনাট্য প্রভৃতির স্বরলিপি তৈরি করেছেন।

৪ শ্রাবণ, ১৩০৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৯ জুলাই, ১৯০০ (পশ্চিম বাংলায় ২০ জুলাই) খ্রিস্টাব্দে শৈলজারঞ্জন মজুমদার ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার অন্তর্গত মোহনগঞ্জ থানার বাহাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল একটি কুলিন বর্ধিষ্ণু পরিবার। নেত্রকোনা থেকে মেট্রিক পাসের পর আরও পড়াশোনা করার জন্য বাবা রমণী কিশোর দত্ত মজুমদার ছেলেকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন আধুনিক শিক্ষা ও আধুনিক জীবনযাপনের কায়দা-কানুন অনুশীলন করার জন্য। রমণী কিশোর ছিলেন নেত্রকোনা মহকুমার তৎকালীন একজন ডাকসাইটে আইনজীবী। বাবা চাইতেন ছেলেও তাঁর মতো আইন ব্যবসায় আসুক। সে কারণে শৈলজারঞ্জন মজুমদার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে নেত্রকোনা মহকুমা আইনজীবী সমিতিতে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জীবন-দেবতা। রবীন্দ্রনাথের সংগীতের রস এমনভাবেই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল যে তিনি আইন পেশা ছেড়ে শান্তিনিকেতনে পাড়ি জমিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশাতেই শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেন। শুরু হয় ভিন্ন এক পরিভ্রমণ। তিনি রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি যেমন তৈরি করেছিলেন তেমনি রবীন্দ্রনাথকে পূর্ব বাংলা বিশেষ করে ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য কলকাতার বাইরে নেত্রকোনায় ১৯৩২ সালে প্রথম কবিগুরুর জন্মদিন পালন করেছিলেন। নেত্রকোনায় কবিগুরুর জন্মদিন পালনের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে ধন্যবাদসূচক এক পত্রে লিখেছিলেন-

কল্যাণীয়েষু,

তোমাদের নেত্রকোনায় আমার জন্মদিনের উৎসব যেমন পরিপূর্ণ মাত্রায় সম্পন্ন হয়েছে এমন আর কোথাও হয়নি। পুরীতে একবার আমাকে প্রত্যক্ষ সভায় নিয়ে সম্মান করা হয়েছিল। কিন্তু নেত্রকোনায় আমার সৃষ্টির মধ্যে অপ্রত্যক্ষ আমাকে রূপ দিয়ে আমার স্মৃৃতির যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, কবির পক্ষে সেই অভিনন্দন আরও অনেক বেশি সত্য। তুমি না থাকলে এই উপকরণ সংগ্রহ করত কে? এই উপলক্ষে বৎসরে বৎসরে তুমি আমার গানের অর্ঘ্য পৌঁছিয়ে দিচ্ছ তোমাদের পল্লীমন্দিরে। ভোগমন্ডপেও কম কাজ হচ্ছে না...। আমার লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সংগীতকে যাঁরা জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তাদের মধ্যে শৈলজারঞ্জন মজুমদার অন্যতম। আমাদের নেত্রকোনার আরেক কৃতী সন্তান অধ্যাপক যতীন সরকার তাঁর এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন- নূরুল আনোয়ারের বই থেকেই সে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। সত্যেন বসু বলেছিলেন, ‘দেশে রবীন্দ্রসংগীতের যে প্রভূত প্রচার হয়েছে, তার জন্য শৈলজারঞ্জন অনেকটাই দায়ী। এবং এজন্যই হয়তো সুরঙ্গমার ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে এতো ভালোবাসে। সকলের সঙ্গে আমি তার শুভ কামনা করি।’

রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ অনেককেই আবিষ্কার করেছেন। শৈলজারঞ্জন তাদের অন্যতম। নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রসংগীতের সুর তালাদি আয়ত্ত করেন। এবং যক্ষের ধনের মতো তা আগলে না রেখে তা প্রচার করেন একে একে। রবীন্দ্রনাথের কত গানের যে তিনি স্বরলিপিকার সে কথা আজ রবীন্দ্র শিক্ষার্থীদের অবিদিত নয়। বহু রবীন্দ্রসংগীতের সুর তাল লুপ্ত হয়ে যেত যদি না শৈলজারঞ্জন তাঁর অসাধারণ স্মৃৃতিশক্তি বলে সেসব ধারণ করে না রাখতেন। রবীন্দ্রসংগীতকে স্বরলিপিতে বেঁধে যারা ভাবীকালের সংগীত শিক্ষার্থীদের পথ সুগম করে গেছেন শৈলজারঞ্জন তাদের অন্যতম।’ এমনকি রবীন্দ্রনাথের যে নাতনি বিশিষ্ট গায়িকা অমিয়া ঠাকুর তিনিও বলেছেন, ‘রবীন্দ্র দাদা মশায়ের মৃত্যুর পর শৈলজা বাবু কলকাতায় আমাদের বাড়িতে এসে আমাদের দুটি গান যত্ন দিয়ে শেখান। গান দুটি হলো- “সম্মুখে শান্তি পারাবার” ও “হে নূতন দেখা দিক আরবার” রেকর্ড করার জন্য ওই গান দুটো আমাকে শেখান।’ (শৈলজারঞ্জন মজুমদার স্মারকগ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৯৮, সম্পাদনা - মুহম¥দ আকবর)।

দেশের প্রতি এই গুণী মানুষটির টান ছিল নিখাঁদ এক নাড়ির টান। ১৯৭৪ সালের আগে শৈলজারঞ্জন মজুমদার কখনো বাংলাদেশে এসেছেন তা শুনিনি। দ্বিতীয়বার এসেছিলেন ১৯৭৫ সালে। তখন তিনি আমার বাবার আতিথ্যে আমাদের মোহনগঞ্জের বাসা ‘ছায়ানীড়ে’ দু-তিন রাত অবস্থান করেছিলেন। এ বিষয়টি আমি আমার অন্যান্য লেখায়ও উল্লেখ করেছি, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের মতো মানুষের সঙ্গে আমাদের একটি পারিবারিক সম্পর্ক ছিল বা আছে এটি ভাবতে আমার খুবই আনন্দবোধ হয়, গর্ব হয়।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে সস্ত্রীক গিয়েছিলাম কলকাতায় স্ত্রীর চিকিৎসার কারণে। করোনা সংক্রমণের সময় বিদেশভ্রমণ একটি বিড়ম্বনা ছাড়া কিছুই নয়। করোনার টেস্ট করে বিমান ভ্রমণ। ফেরার পথেও একই অবস্থা। আবারও কলকাতার এ্যাপোলো হসপিটালসে করোনা টেস্ট করে বিমানে উঠতে হয়েছে। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতিদের জন্য নির্মিত গেস্টহাউস ‘বিজন ভবন’ সল্ট লেকের ৩ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত। কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির পূর্বানুমোদনক্রমে বাংলাদেশের বিচারপতিগণও তাদের ভ্রমণকালে সেখানে থাকার সুযোগ পান। নজরুলতীর্থ এবং রবীন্দ্রতীর্থ দুটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রই এ গেস্টহাউসের বেশ কাছে। ইতিপূর্বে নজরুলতীর্থে গেলেও রবীন্দ্রতীর্থে আমার কখনো যাওয়া হয়নি। স্ত্রীর চিকিৎসাসংক্রান্ত রিপোর্ট পেতে আরও এক দিন অপেক্ষা করতে হবে। তাই হাতে ছিল অফুরন্ত অবসর।

এ অবসরেই একদিন আমরা দুজন গেলাম রবীন্দ্রতীর্থে। গাড়ি পার্ক করে এদের প্রধান কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলাম, বুঝতেই পারছিলাম না এখানে এদের কোনো লোকজন আছেন কি না। একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে জিজ্ঞাসা করে তাকে সঙ্গে নিয়ে তার পথনির্দেশে অফিসের দিকে যাই। দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করি। সেখানে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, তাঁর নাম অনুপ কুমার মতিলাল। তিনি ভারত সরকারের একজন সাবেক সচিব। বর্তমানে রবীন্দ্র এবং নজরুল উভয় তীর্থের প্রধান কর্তাব্যক্তি। অত্যন্ত বিনয়ী এবং ভদ্রলোকের এক প্রতিভূ এই অনুপ কুমার মতিলাল। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে প্রণাম জানিয়ে আমাকে বললেন, ‘স্যার আপনি ঢাকা থেকে এসে আজ রবীন্দ্রতীর্থ দেখতে এসেছেন, বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দের।’ কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘কলকাতার মানুষদের আজকাল খুব একটা সময় নেই এখানে আসার। অনুষ্ঠান যখন থাকে তারা শুধু তখনই এখানে আসেন।’

অনুপ কুমার ঘুরে ঘুরে তীর্থস্থানটি দেখান। মিউজিয়ামসহ অন্যান্য অংশ আমাদের দেখান। কিছু স্যুভেনির আমাদের শুভেচ্ছা উপহার দেন। কথায় কথায় যখন শৈলজারঞ্জন মজুমদারের প্রসঙ্গটি আমি তুললাম তখন লক্ষ্য করি তিনি অধীর আগ্রহে জানতে চান শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় কীভাবে হয়েছিল ইত্যাদি। উত্তরে বলেছিলাম, তাঁর সঙ্গে আমাদের জন্মজন্মান্তরের পরিচয়। বলেছিলাম এই মহান মানুষটির জন্মস্থান ও আমার জন্মস্থান একই জায়গায়, আমরা উভয়েই একই মাটির সন্তান। আমার মোবাইলে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সঙ্গে আমার ও আমার পরিবারের ছবি দেখে তিনি আপ্লুত হয়ে ওঠেন এবং আমাকে ছবিগুলো তাঁকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি জানান, তাঁর স্ত্রী এবং তার পরিবারের অনেকেই শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সরাসরি ছাত্র। শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে নিয়ে অনুপ কুমারের আগ্রহ ও শ্রদ্ধামাখা উচ্ছ্বাস দেখে আমি নিজেও অভিভূত হয়ে পড়ি।

১৯৯২ সালের ২৪ মে ভোররাতে শৈলজারঞ্জন মজুমদার কলকাতায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নেত্রকোনায় খবরটি পৌঁছাতে এক-দুই দিন সময় লাগে। তখনকার নেত্রকোনার গণ্যমান্য ব্যক্তিবৃন্দ নেত্রকোনা পাবলিক হলে এক নাগরিক শোকসভার আয়োজন করেছিলেন। মোহনগঞ্জের গুণী শিল্পী আমার বাল্যবন্ধু দুলালচন্দ্র ধরসহ অনেকেই সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। দুলালের কাছে শুনেছি সে শোকসভায় সেসহ নেত্রকোনার বেশ কিছু শিল্পী রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। আর শোকসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন আমার বাবা ডা. আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদ।

১৯৯১ সালের জুলাইয়ে পালিত হয়েছিল শৈলজারঞ্জন মজুমদারের শেষ জন্মদিন। সে দিনটি কীভাবে পালিত হয়েছিল এর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায় শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জীবনী নিয়ে লেখা সঞ্জয় সরকারের গ্রন্থে। তিনি উল্লেখ করেছেন- ১৯৯১ সাল। শৈলজারঞ্জনের বয়স ৯১। তিনি প্রায় শয্যাশায়ী। ভক্তরা এবার পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উপস্থিতিতে তাঁর জন্মদিন পালনের উদ্যোগ নিলেন। ভক্তদের আগ্রহে সানন্দে রাজি হলেন জ্যোতি বসু। অতিথিকে গেয়ে শোনানোর জন্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার নিজেই কয়েকটি গান বাছাই করে দিলেন। বাংলাদেশ থেকে চার-পাঁচ জন কিশোর-কিশোরী রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার্থীকে নিয়ে হাজির হলেন ওয়াহিদুল হক। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সঙ্গে করে হাজির হলেন জ্যোতি বসু। এসেই শৈলজারঞ্জন মজুমদারের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। এরপর তাঁর শয্যাপাশে বসে গান শুনলেন। চারটি গান দিয়ে ছোট্ট অনুষ্ঠান শেষ হলো। গানগুলো ছিল- ‘কবে আমি বাহির হলেম’, ‘সুরের গুরু’, ‘তুমি খুশি থাক’ ও ‘কি পাইনি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নাহি রাজি।’ অনুষ্ঠান শেষে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু শৈলজারঞ্জনের দুই হাত ধরে বললেন, ‘আপনার মতো খাঁটি মানুষের অনেক বেশি প্রয়োজন। আপনি অনেক অনেক দিন থাকুন।’ শৈলজারঞ্জনের বাহামের বাড়ি সরকারি খাসজমিতে পরিণত হয়েছে দেশ বিভাগের বেশ আগে। সেখানে আসাম থেকে আসা কিছু উদ্বাস্তু বাস করে অনেক দিন যাবৎ। শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে আমরা আমাদের মাটিতে ধরে রাখতে পারিনি এ অঞ্চলের বিরূপ রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল অবধি শৈলজারঞ্জন মজুমদার কখনো তাঁর জন্মভিটায় আসেননি। যদিও বা তাঁর মাতা-পিতা এ দেশেই মৃত্যুবরণ করেন এবং এ দেশেই তাঁদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। তবে তাঁর স্মৃৃতি ধরে রাখার চেষ্টা আমরা করছি, করে চলেছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় শৈলজারঞ্জন মজুমদার জাতির পিতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন বঙ্গবন্ধু তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। বঙ্গবন্ধু শৈলজারঞ্জনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারে আর ছাড়ুমই না’। শৈলজারঞ্জন মজুমদার তখন বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি উদ্বাস্তুদের দখলে, শহরের বাড়িতে মসজিদ হয়েছে, থাকার জায়গা কোথায়?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু জোর দিয়ে বলেন, ‘ছাইড়্যা দেন। আমি আপনেরে বাড়ি দিমু, গাড়ি দিমু, ডোমিসিল দিমু। আপনার জায়গার অভাব হবে না।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর এ আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন শৈলজারঞ্জন। তাই তিনি তাঁর জীবনীসংক্রান্ত বই ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’-এ বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতিগুলো উল্লেখ করে নিজের অভিব্যক্তি এভাবে প্রকাশ করেছেন, ‘সে আমিও আমার অন্তরের  অন্তস্তলে উপলব্ধি করেছি।’

শৈলজারঞ্জন মজুমদারের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুদের অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করে অবশেষে বাড়িটি আমাদের চেষ্টায় সরকার উদ্ধার করেছে। শৈলজারঞ্জন মজুমদারের বাড়িটিতে আমার ছোট ভাই সাজ্জাদুল হাসান (সাবেক সচিব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) ও আমাদের সবার উদ্যোগে শৈলজারঞ্জন সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ সংস্কৃতি কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার জন্য ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। আমি ডিসেম্বর, ২০২০ সালের শেষের দিকে সংস্কৃতি কেন্দ্রটি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। প্রকল্পটি এ বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাবের কারণে এটি একটু প্রলম্বিত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এ বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এ সংস্কৃতি কেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হবে। ২.৩২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত ‘শৈলজারঞ্জন মজুমদার সংস্কৃতি কেন্দ্র’টি নেত্রকোনা জেলা তথা সারা বাংলাদেশের একটি অন্যতম সংস্কৃতি কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। আমি নির্মাণাধীন ভবনটির ছবি কলকাতায় রবীন্দ্রতীর্থের প্রধান কর্তাব্যক্তি শ্রী অনুপ কুমর মতিলালের কাছে পাঠাই।

অনুপ কুমার মতিলাল আশা প্রকাশ করে আমাকে বলেছিলেন, ‘শৈলজারঞ্জন মজুমদার সংস্কৃতি কেন্দ্র’টির কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলে তিনি এবং ওপার বাংলার রবীন্দ্রপ্রেমী অনেকেই এটি দেখতে আসবেন। বাংলাদেশের রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসর, দক্ষিণডিহি, কুষ্টিয়ার ট্যাগোর লজ যেমন রবীন্দ্রপ্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয় তেমনি রবির কিরণে সিক্ত ও তাঁর আলোয় আলোকিত শৈলজারঞ্জন মজুমদারের প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি কেন্দ্রটিও একদিন উভয় বাংলার রবীন্দ্রপ্রেমীর কাছে একটি দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠবে। ১৯ জুলাই শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মদিন। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁকে স্মরণ করে এ প্রত্যাশায় শেষ করছি- ‘শৈলজারঞ্জন মজুমদার সংস্কৃতি কেন্দ্র’টি সবাইকে রবির কিরণে সিক্ত অনন্য মানুষটির কর্ম ও কীর্তির কাছে নিয়ে আসবে।

লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর