রবিবার, ২৫ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ফকির আলমগীর : শোকগাথা

ফরিদুর রেজা সাগর

ফকির আলমগীর : শোকগাথা

১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। তখন সংগীতের এক বিশেষ ধারা পপসংগীত তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একদল নবীন শিল্পী তখন পপ গান গাইছে। ওদের গান তখন মানুষের মুখে মুখে। প্রচন্ড জনপ্রিয়। এই নতুন ধারার গান, নতুন জাগরণ তুলল আমাদের সংগীত জগতে। স্কুল, কলেজ ও হলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মঞ্চ, বেতার ও টেলিভিশনে পপশিল্পীদের উপস্থিতি নিয়মিত। সে সময় আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনে ছোটদের প্রচুর অনুষ্ঠান করি। প্রযোজক ছিলেন বিখ্যাত কাজী কাইয়ুম। অসম্ভব মেধাবী প্রযোজক। ছোটদের জন্য বহু অনুষ্ঠান তিনি প্রযোজনা করেছেন। সেসব অনুষ্ঠান এখন ইতিহাস। নাচ-গানের পরিবেশনা ছাড়াও পাপেট শো, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি এমনকি নতুন কুঁড়িরও প্রযোজক তিনি। সে সময় কাজী কাইয়ুম একদিন আমাকে বললেন, সাগর, পপ গান তো এখন খুব জনপ্রিয় হচ্ছে। এ গানগুলো নিয়ে ছোটদের জন্য কোনো অনুষ্ঠান করা যায় কি না দ্যাখো। আমি সবিনয়ে বললাম, ছোটরা কি পপ গান গাইবে? কেমন লাগবে ওদের কণ্ঠে?

কাজী কাইয়ুম স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ছোটরা কেন গাইবে? পপ গানের শিল্পীরাই পপ গান গাইবেন। ছোটদের অনুষ্ঠানে বয়স্ক শিল্পীরা অংশ নিতে পারবে না এমন তো কথা নেই।

কাজী কাইয়ুমের পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুষ্ঠান নির্মাণে তৎপর হয়ে উঠলাম। সে অনুষ্ঠানে পাঁচজন শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। একজন শিল্পীর নাম এ মুহুর্তে কিছুতেই মনে করতে পারছি না। বাকি চারজন হলেন ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাঁই ও ফকির আলমগীর। সেই বিশেষ অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের আগে ফকির আলমগীর ছোটদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমরা ভিন্নধারার গান করি। এ গানগুলো খুব জনপ্রিয় অর্থাৎ পপুলার। পপুলার শব্দটার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো পপ। সে কারণে আমরা আমাদের গানকে বলি পপ গান।’

ফকির আলমগীরের কথাগুলো আমার খুব মনে ধরে। সারা জীবন তা মনে গেঁথে আছে। ফকির আলমগীর বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড়। তাকে অগ্রজদের সম্মান দিতাম। কিন্তু তিনি ছিলেন বন্ধু ভাই সব। ৫০ বছর ধরে তার সঙ্গে সম্পর্ক। টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের বাইরেও বহুবার বহু জায়গায় বহুভাবে তার সঙ্গে সময় কেটেছে। ঢাকা, ঢাকার বাইরে, বিদেশে কত মধুর স্মৃতি তার সঙ্গে। একেবারেই মাটির মানুষ ছিলেন তিনি। সবার সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারতেন। হাটে মাঠে ঘাটে সবখানেই গান গাইতেন। তাই তিনি হয়ে উঠলেন গণশিল্পীর প্রতীক। মুকুন্দ দাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ধারায় ফকির আলমগীর নিজেকে বদলে ফেললেন। বাংলাদেশের যে কোনো গণআন্দোলন ফকির আলমগীরের পরিবেশনা ছাড়া অসমাপ্ত থেকে যেত। দুই যুগ ধরে ফকির আলমগীর বারবার নিজেকে বদলে ফেলেছেন। ‘ও সখিনা গেছস কি না’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’- এ ধরনের গান গেয়ে তিনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের সংগীত ভুবনে ঋষিজের অবদান বিশাল। পয়লা বৈশাখের সকালে শিশু পার্কের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আয়োজন হতো বর্ষবরণের। ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে শুরু হতো ফকির আলমগীরের নেতৃত্বে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর পরিবেশনা। বর্ষবরণের এ ধারায় ঋষিজও এখন ইতিহাস। পয়লা মে মানেই ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর পরিবেশনা। ফকির আলমগীরের দরাজ কণ্ঠস্বরে মেহনতি মানুষের পক্ষে সংগীত পরিবেশন।

দেশপ্রেম, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি অমর হয়ে থাকবেন সবার মধ্যে। অনেক কাজ করতেন তিনি। কিন্তু কখনই তার মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। তিনি সাধারণ মানুষের মতো মেলামেশা করতেন। যে কোনো সমালোচনাকে সহজভাবে নিতে পারতেন। মানুষের ভালোবাসা ছিল তার শক্তি।

অনেকের হয়তো জানা নেই যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছেন। দীর্ঘ সময় তিনি চাকরি করেছেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল করপোরেশনে।

খুব অস্থির ও ছটফটে ছিলেন নতুন কিছু করার জন্য। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, চে গুয়েভারা, নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন কিংবা মে দিবস- এসব বিশেষ দিবস মানেই ফকির আলমগীর। তিনি গান গেয়ে এসব দিন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বেতার, টেলিভিশন ও মঞ্চে তার গান অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এ এক অসাধারণ সাফল্য। আমি প্রায় ঠাট্টা করে বলতাম, ফকির ভাই এ বছর কবার নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন পালন করলেন?

ফকির ভাই হো হো করে প্রাণ খুলে হাসলেন। এসব ঠাট্টা তিনি কখনই গায়ে মাখতেন না। নিজের কাজের প্রতি ছিল অসীম নিষ্ঠা ও অগাধ আস্থা। চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। যখন যা ইচ্ছা হতো সে অনুষ্ঠানই তিনি নির্মাণ করেছেন চ্যানেল আইয়ের জন্য। গান দিয়ে শুরু, বিশেষ দিনের সংগীত, বিজয় মেলা- নিজের অনুষ্ঠান মনে করে নিজেই শিডিউল করে নিজের মতো অংশ নিতেন। তার ছোট ভাই ফকির সিরাজ সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। চ্যানেল আইয়ের আর্কাইভে ফকির আলমগীরের কত গান যে আছে তার হিসাব নেই।

নিজের কাজের ব্যাপারে খুব আস্থাবান ছিলেন ফকির আলমগীর। তাই স্মৃতিকথা ধরনের বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। তিনি ছিলেন জীবন্ত আর্কাইভ। তার স্মৃতিতে ছিল অসংখ্য ঘটনা। অনর্গল গল্প করতে পারতেন। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো ফকির আলমগীরকে দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই তিনি কতটা গোছানো-জীবন যাপন করতেন। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া কিছুই করতেন না। ফকির আলমগীরের মতো শিল্পী দুই বাংলাতেই বিরল। তিনি আর গান গাইবেন না- এ কথা ভাবতেই পারছি না।  

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর