শুক্রবার, ৩০ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

তারুণ্যকে পথে আনতে হলে...

খায়রুল কবীর খোকন

তারুণ্যকে পথে আনতে হলে...

তারুণ্যের কবি তথা যৌবনের কবি হেলাল হাফিজ ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী লড়াইয়ের আগুন ঝরানো দিনের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান সামনে রেখে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিকাশের ক্ষণে লিখেছিলেন তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। প্রধানত বাঙালি তরুণ-যুবাদের চরম আত্মত্যাগের প্রস্তুতি নিয়ে উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি বর্বরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্‌বান জানিয়েছিলেন। সেই কবিতার অমর দুটি লাইন যা এ দেশে লাখ লাখ বার উচ্চারিত হয়েছে আমাদের লড়াকু তরুণ-যুবা আর অন্যসব সংগ্রামী মানুষের কণ্ঠে এবং ধ্বনিত হবে অনাগতকাল- ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

তারুণ্যকে তার সময়ের শ্রেষ্ঠ কাজটি করার মূল আর্তি ছিল কবির প্রধান ভাষ্য। কবি তাঁর সেই কবিতায়ই বলেছিলেন, ‘কোন কোন প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়।’ তা কোন প্রেম? অবশ্যই দেশপ্রেম। একাত্তরে আমাদের দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা তরুণদের অবশ্য খুনি হতে হয়েছে। পাকিস্তানি দখলদার বর্বর সেনাদের হত্যায় উন্মত্ত হতে হয়েছে তাদের। শিল্পী কামরুল হাসানের সেই বিখ্যাত পোস্টারের ভাষা মনে আছে অনেকেরই, দানব ইয়াহিয়ার ব্যঙ্গচিত্রের নিচে- ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন, আমরা জানোয়ার হত্যা করি।’ জানোয়ার হত্যার উন্মাদনা কবি হেলাল হাফিজ উসকে দিতে চেয়েছিলেন সেই ঊনসত্তরেই। কারণ তিনি কবি, তাই তো একাত্তরকে তিনি সামনে দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে, খুব সহজেই।

তরুণ আর যুবারাই তো সব গণসংগ্রামে সামনের কাতারে এগিয়ে যায়। তাদের মিছিলের সঙ্গে বা পাশে থাকে বা পেছনে থেকে বল-ভরসা দেন বড়রা। এখন আমাদের তরুণসমাজ এগোবে কীভাবে? তাদের বিশাল অংশকে তো গ্রাস করেছে মাদক-বিষ। আর পর্নোগ্রাফি। তাদের গ্রাস করে চলেছে নানা অপরাধপ্রবণতা, নারীর প্রতি বিকৃতাচার। বিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় কিংবা যথার্থ সাহিত্যপাঠে তাদের মনোযোগ নেই। (না, করোনাকালের বিদ্যালয় ছুটির প্রসঙ্গে আসছি না, এটা নিঃসন্দেহে একটা ব্যতিক্রমী কাল, তার আগে-পরের সময়ের অবস্থা মাথায় রেখেই কথা বলছি)। তাদের ভিতরে জীবনের আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতার কোনো বোধ তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সুপ্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না। তাদের মধ্যে দেশপ্রেম কোথায়? স্বজাতির প্রতি মমত্ববোধ কোথায়?

আমাদের তরুণ-যুবাদের যে অংশটি মাদক ও পর্নোগ্রাফির দূষণ থেকে মুক্ত আছে তাদের বড় অংশ প্রচন্ড আত্মকেন্দ্র্রিক, ভয়ানক স্বার্থপর হয়ে একটা বোধহীন মূল্যবোধে আটকে আছে। তারা নিজেরা আত্মপ্রতিষ্ঠার ধান্ধায় অতিমাত্রায় ব্যস্ত, তাদের সবারই বাবা-মা-অভিভাবকরা তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার তৎপরতায় নিতান্তই মতলববাজ হয়ে যাচ্ছেন। দেশ, সমাজ, জাতি তাদের ভালো-মন্দ বিবেচনায় আসতেই দিচ্ছেন না। তার ফলে শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের তরুণদের মধ্যে আত্মপরতা, স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে ওঠার মতো মানসিকতা তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে না।

আজ দেশে যে সীমাহীন অনাচার আর নৈরাজ্য, গণতন্ত্রহীনতা আর কর্তৃত্ববাদের দুঃশাসনে সবকিছু রসাতলে যাচ্ছে এখান থেকে মুক্তির পথে সামনের কাতারের লড়াকু যোদ্ধা হবে কে? সেই তারুণ্য, যে লড়েছে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে, ঊনসত্তরে স্বৈরাচার আইয়ুব তাড়ানোর গণঅভ্যুত্থানে, যে লড়েছে সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির বিজয় নিশ্চিত করতে, যে লড়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধে, যে লড়েছে আশির দশকজুড়ে স্বৈরাচার এরশাদের দানব শাসনের বিরুদ্ধে নব্বইয়ে তাকে পদাঘাত করে গদিচ্যুত করতে। সে তারুণ্যই পারে, তাকেই তো পারতে হবে।

অত্যন্ত ব্যথিতচিত্তে সবকিছু দেখে বলছি, আজকে সেই লড়াকু তারুণ্য আর সংগ্রামী যুবকরা অস্থিরচিত্ত, নিদারুণ বিপথগামী। তাদের বিশাল অংশ এখন মাদকের নেশায় দিশাহারা। একই সঙ্গে বিপুল অংশ পর্নোগ্রাফির নেশার আসক্তিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত দশায় ডুবে মরার জোগাড়। দায়ী কে? কারা এ দেশে পর্নোগ্রাফি ছড়ায় আর কারা মাদক চোরাকারবার করে এ দেশের তরুণ-যুবাদের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব তরুণ ও যুব সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে? তাদের কেন বিচার হয় না, তারা কেন শাস্তি পায় না? বিচার হয় না বলেই মাদকের রমরমা কারবার চলে অবিরাম। অথই জলে ডুবে মরে আমাদের তারুণ্য আর যুবসমাজ।

আমরা একজন ক্ষমতাদর্পী নারীকে জানি, ওয়াকিবহাল সবাই জানেন, যিনি এরশাদ স্বৈরাচারের আমলে প্রচন্ড দাপুটে ক্ষমতাধর ছিলেন। তিনি তার দাপুটে ক্ষমতা দিয়েই তখন এ দেশের হেরোইন চোরাচালানের একজন মাফিয়া নেতা ছিলেন। সেটা তখনকার দিনে ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে পড়েছিল। তার সঙ্গে ছিল একটি বিশেষ ‘প্রভাবশালী গোষ্ঠী’র কুখ্যাত ‘ভাই’ নামধারী এবং তাদের ছোট বড় চেলা-চামুন্ডারা। কিন্তু সেই দাপুটে ক্ষমতাধর নারীর (নারী তো নয় মাফিয়া লেডি) বিচার তো হয়ইনি, উল্টো তিনি পরবর্তীকালেও ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগ করে চলেছেন দীর্ঘকাল। তার গায়ে সেই হেরোইন চোরাকারবারের জন্য সামান্য আঁচও লাগেনি, তাকে কেউ শাস্তি দেওয়ার কথা কল্পনাও করেননি। এমনকি সেই কুখ্যাত হেরোইন চোরাকারবারের সেই মাফিয়া লেডির সঙ্গীদেরও কারও আটক হতে হয়নি। বিচার অনেক দূরের কথা!

একইভাবে পর্নোগ্রাফি যারা এ দেশে তরুণ-যুবাদের মাঝে ছড়ায় তারাও ক্ষমতাধর। তাদেরও বিচারের মাধ্যমে শাস্তি হয় না, ফলে হেরোইন, ইয়াবা, আইস ইত্যাদি এবং আরও ভয়ংকর মাদক সব আসছে দেদার এ দেশে, তেমনি ইন্টারনেটজুড়ে, অশ্লীল বই পত্রপত্রিকায় এবং ফটো-অ্যালবাম হিসেবে, ভিডিও-ব্লু-ফিল্ম হিসেবে অবিরাম আসে এ দেশের ভিতরে, নষ্ট হচ্ছে আমাদের তরুণসমাজ, যুবসমাজ। আর এ দেশের ৭০ লাখ তরুণ, যুবাসহ প্রায় ৮০ লাখ মানুষ ভয়ংকর মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে জীবন ধ্বংস করছে, নিজের ও পরিবারগুলোর অর্থ ধ্বংস, শান্তি-সুখ-স্বস্তি ধ্বংস করে চলেছে, সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ধসিয়ে দিচ্ছে তারা। মাদকাসক্ত তরুণ-যুবারা অপরাধ করে পুরো রাষ্ট্র ও সমাজকে অশান্ত করে ছাড়ছে।

কিন্তু এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। এরশাদ স্বৈরাচার এ রাষ্ট্রের ওপরে সব ধরনের বলাৎকার করে যে মহাপাপ করে গেছে তার বিচার হয়নি, তাই সেই হেরোইনসম্রাজ্ঞী মাফিয়া লেডিরও বিচার হয়নি। পরিণামে অসংখ্য ছোট বড় মাফিয়ার মাদক চোরাকারবার সম্প্রসারিত হয়েছে দেশময়, তাই তো আজ মাদকের কারবার চালিয়ে দেশ ধ্বংস করছে তারা।

কিন্তু আমরা আমাদের সব লড়াই আর সংগ্রামের প্রথম কাতারের যোদ্ধাদের তো কোনো অবস্থাতেই ধ্বংস হতে দিতে পারি না। তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের পুরো জাতিকে বাঁচানোর স্বার্থে।

সে লক্ষ্যে দরকার মাদকের চোরাকারবার পুরোপুরি নির্মূল এবং অতীতের আর বর্তমানের সব মাফিয়া কারবারিকে বিচারের আওতায় এনে মাদকের জঞ্জাল চিরতরে অপসারণ। একই ব্যবস্থা নিতে পর্নোগ্রাফির মূল কারবারিদের ইবলিশ ব্যবসা বন্ধ করতে হবে আইনের কঠোর প্রয়োগ দ্বারা। তাহলেই তারুণ্য আর যুবসমাজ মুক্ত হবে দানব মাদকাসক্তি আর দৈত্য পর্নোগ্রাফির কবল থেকে।

দুনিয়াব্যাপী মাদকদ্রব্য পাচারের করিডোর হচ্ছে বাংলাদেশ। এটা প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে এ আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়া চক্রের নিরাপদ একটা রুট। কারণ এখানে সহজেই তারা রুটকর্মী হিসেবে বাহক এবং এখান থেকে বিভিন্ন দেশে পাঠানোর সমুদ্রগামী জাহাজ বা অন্য আন্তর্জাতিক পরিবহন সুবিধা পায়। তাদের রুট পাচারের মাদক অবধারিতভাবে একটা অংশ এখানে ব্যবহৃত হয় আমাদের তরুণ-যুবারা, কিছু বড়রাও তা ব্যবহার করে।

ষাটের দশকে স্বৈরাচার-আইয়ুব খাঁর তাঁবেদার গভর্নর মোনায়েম খাঁর পান্ডাদের এনএসএফ সংগঠনের কর্মীদের মতো আজকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোর পান্ডায় ভরে গেছে। তারা কঠিন করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বন্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের গেস্টরুমে ও টিএসসি এলাকায় এক পাতি নেতার জন্মদিন পালন করে কেক কেটে, শতজনের অবৈধ সমাবেশ করে। (মাসখানেক হলো এ ঘটনার রিপোর্ট ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায়)। তারা কত বড় বর্বর হলে এমন নিষ্ঠুর ও বেআইনি তৎপরতা চালাতে পারে! মোনায়েমখানি গুন্ডাপান্ডাদের মতোই এরা। এ তারুণ্য দেশের ও দেশবাসীর কোনো কাজে লাগে না। আরেকটি তারুণ্য ও যুবা গ্রুপ আছে যারা ধর্মান্ধ, তাদের অনেকে আবার মাদরাসায় পড়ে (এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও একটা অংশ) ইসলামের নামে জঙ্গিবাদী হয়ে পড়েছে। এরাও সমাজের কোনো কাজে লাগে না বরং এ দুই পক্ষই এখন দেশের মানুষের শত্রুর ভূমিকায়। এদের পাওয়া যাবে না। তাই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির সত্যিকার দেশপ্রেমিক তরুণদের সংগঠিত করতে হবে।

তাহলেই আমাদের সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা অর্জিত হবে। আমাদের তারুণ্য আর যুবাসমাজ প্রচন্ড শক্তিতে জেগে উঠবে। উঠতেই হবে তাদের। অন্য বিকল্প নেই।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর