শুক্রবার, ৩০ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

মাস্ককে হেলাফেলা নয়

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

মাস্ককে হেলাফেলা নয়

মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবারের ঈদুল আজহার শুভেচ্ছায় দেশবাসীর প্রতি একটি মানবিক আবেদন রেখেছেন। রাষ্ট্রপতি করোনা মোকাবিলায় দলমত নির্বিশেষে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য আহ্‌বান জানিয়েছেন এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন করোনার এ লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে। প্রধানমন্ত্রী বিনামূল্যে ৮০ শতাংশ লোককে টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়ন হবেই ইনশা আল্লাহ। এত বড় মহামারীতে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও কিছু সামাজিক দায়িত্ব পালন করা উচিত।

এর আগে ঈদ সামনে রেখে ১৫ জুলাই লকডাউন শিথিল করে কিছুদিনের জন্য যানবাহন চলাচল ও শপিং মল খোলার অনুমতি দিয়েছিল সরকার। ফলে লঞ্চ-স্টিমার, গরুর হাট, শপিং মল ও ঈদগাহে মানুষের ঢল ছিল উপচে পড়া। এদিকে করোনা পরিস্থিতিও এত ভয়াবহ যে দেশের প্রতিটি জেলা এমনকি গ্রামগঞ্জে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে এবং মৃতের সংখ্যা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার ৮০ শতাংশই ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা ঘটছে।

দেখা যাচ্ছে দেশে করোনা সংক্রমণের হার দিন দিন যতই বাড়ছে মানুষ যেন ততই উদাসীন এবং মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদিও মাস্ক রাখে, তা যেন থাকে পকেটে, বড়জোর থুতনিতে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা একান্ত কাম্য।

ঈদের পর ২৩ জুলাই আবারও কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে। গণপরিবহন, অফিস-আদালত, কলকারখানা এমনকি গার্মেন্টও বন্ধ থাকছে। অনেকটাই স্পষ্ট যে ঈদ সামনে রেখে যারা নাড়ির টানে গ্রামে গেছেন তারা এখন আর শহরে আসতে পারবেন না। ঈদে অবাধে মানুষের চলাফেরার ফলে করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে, তাই সরকারের এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু লক্ষণীয় যে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মাস্ক ছাড়া ঘোরাঘুরি করা, আড্ডা দেওয়া, গল্প করা, যেখানে সেখানে থুথু ফেলা ইত্যাদি চলছেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রতিনিয়ত কঠোর মনিটরিং করছেন, জরিমানাও করছেন। সরকারিভাবে অনেক আগে থেকেই ‘নো মাস্ক-নো সার্ভিস’ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। অফিস-আদালত, ব্যাংক, কলকারখানা, পরিবহনসহ সর্বত্রই এখন লেখা থাকে ‘মাস্ক পরুন-সেবা নিন’। কিন্তু এ যেন শুধুই কাগজে-কলমে, বাস্তবে এর ব্যবহার খুব একটা হচ্ছে না। অবস্থা দেখে মনে হয়, এসব কথার দিকে কারও কোনো মনোযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত মাস্ক পরতে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অপরিসীম।

তবে লকডাউনের কথা শুনলেই খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করে। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায়, খাদ্য সংকট দেখা দেয়, মানবেতর জীবনযাপন করে। হটলাইনে (৩৩৩) লাখ লাখ কলের বিপরীতে খাদ্য সহায়তা একেবারেই অপর্যাপ্ত। টিসিবির পণ্যও খুবই অপ্রতুল। আর গণপরিবহন বন্ধ থাকলে পরিবহন, কুলি, সেলুন, দর্জি শ্রমিকসহ বিভিন্ন-শ্রেণির দিনমজুর পড়ে বিপাকে। তার ওপর লকডাউনের অজুহাতে প্রতিদিন বাড়ানো হয় চাল, তেল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। তাই পেটের দায়ে এবং অভাবের তাড়নায় কর্মহীন মানুষ নিরুপায় হয়ে কঠোর লকডাউন উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে কাজের সন্ধানে। কিন্তু কারও মুখে থাকে না মাস্ক।

অনেক উন্নত দেশ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ককেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সিঙ্গাপুরে মোট জনসংখ্যার ৯২, স্পেনে ৯০, থাইল্যান্ডে ৮৮, হংকংয়ে ৮৬, জাপানে ৮৬ শতাংশই নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করেন। এটুআই ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণায় বাংলাদেশে এ সংখ্যার হার ৩০ শতাংশ, তবে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহারের হার মাত্র ১২ থেকে ১৩ শতাংশের মতো। অবশ্য অনেকেই মাস্ক ব্যবহারের পদ্ধতি এবং কতক্ষণ তা পরবেন তা-ও জানেন না। তাই এ সংকটময় পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই মাস্ককে হেলাফেলা করা ঠিক নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মতে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করলে ভবিষ্যতে লকডাউনগুলো এড়াতে এবং করোনা প্রতিরোধে অনেক সহায়তা হবে। বাংলদেশে সরকারের নির্দেশে পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মাস্ক ব্যবহারের জন্য বারবার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশেষত গ্রামবাসী, দিনমজুরসহ অধিকাংশ লোক এখনো মনে করেন করোনাভাইরাস গরিবদের জন্য নয়। তাই ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ এ কথায় তারা বিশ্বাসী। এখন ঈদ ও লকডাউনকে কেন্দ্র করে শহর থেকে গ্রামে গেছে লাখো কোটি মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৪ লক্ষাধিক শিক্ষার্থীও নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন। তারা তাদের এলাকায় অত্যন্ত স্নেহভাজন, জনপ্রিয় ও পরিচিত মুখ। তাদের আচার-আচরণ এবং কথাবার্তাও হয় মার্জিত। এলাকাবাসী তাদের যে কোনো উপদেশ সহজে গ্রহণ করেন। তাই সংক্রমণের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি গ্রাম-শহর-বাড়িতে শিক্ষার্থীরা যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই মাস্ক পরিধানের ব্যাপারে নিজ এলাকার লোকজনকে বোঝানো এবং মাস্কই যে প্রাথমিক রক্ষাকবচ সে সম্পর্কে অবহিত করতে পারেন। স্থানীয় ইমাম, পুরোহিত, গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও এ ব্যাপারে প্রচার চালাতে পারেন।

মাস্ক ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সারা দেশে একযোগে একদিন ৫ মিনিট/১০ মিনিটের জন্য মাস্ক ক্যাম্পেইনের প্রতীকী প্রোগ্রাম করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হলে জনগণ তা শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করবে এবং সাফল্য আসবে দ্রুত। পাশাপাশি গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য ন্যূনতম খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসা উচিত। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে করোনাযুদ্ধে জয়ী হবই ইনশা আল্লাহ।

লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর