শনিবার, ৩১ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও রবীন্দ্র বিতর্ক

গাজী আজিজুর রহমান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তিতে কিছু লিখব যখন ভাবছিলাম তখনই করোনার করাল থাবায় সব ভেস্তে গেল যেন। ১৯১১-তে বঙ্গভঙ্গ বাতিলের পর মুসলিমসমাজের ক্ষোভ নিবারণে ব্রিটিশ সরকার ১৯১২ সালে হিন্দু নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে তা কার্যকরে লেগে যায় নয় বছর। অবশেষে সব বাধাবিপত্তি-সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ১৯২১ সালের ১ জুলাই একাডেমিকভাবে যাত্রা করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। পূর্ববঙ্গের মুসলমান ছাত্রছাত্রীরা এর সুফল বেশি ভোগ করলেও শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটির আদর্শ ছিল উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক ও বিশ শতকের প্রগতি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অগ্রতম পীঠস্থান হিসেবে। ঔপনিবেশিক শক্তির ছায়াতলে থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়টি শুরু করে এক বৈপ্লবিক আলোক যাত্রা। সে যাত্রার ফল ১৯২৬-এ ‘বুদ্ধির মুক্তি’র যে আন্দোলন তারও সূতিকাগার ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তা এক উজ্জ্বল ইতিহাস। বলা যায়, বাঙালির যত আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ ও অর্জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধারণ করে আছে সে মহত্ত্ব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অগ্রযাত্রায়, অর্জনে শতবর্ষে প্রাণ দিতে হয়েছে শত শত ছাত্রকে, শিক্ষককে। রক্ত দিতে হয়েছে অগণিত জনকে, ভোগ করতে হয়েছে জেল-জুলুম-অত্যাচার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস রক্ত-মৃত্যু আর আত্মত্যাগের ইতিহাস যেমন তেমনি উজ্জ্বলত্বের আলোকের ঐশ্বর্যের। এখানে  পড়তে পারাটা তাই অনেক গর্বের ও অহংকারের। তবে দুঃখের বিষয়, প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ৫০-৬০ বছরের যে অর্জন তা বিগত ৪০ বছরে হয়েছে অনেক ম্লান ও অনুজ্জ্বল। ১০০ বছর পর নতুন অভিযাত্রায় সেই গ্লানি থেকে, অনাদর্শ থেকে, প্রতিক্রিয়াশীলতা থেকে, কূপমন্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে নতুন শপথে ঝলমল করে উঠতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে এ বিদ্যাপীঠের জন্য স্বভাবতই একটা ভালোবাসা রয়ে গেছে। আমাদের প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় প্রিয় রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে চেষ্টা চলেছে তিনি এর প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছেন, করে অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছেন যা আমাদের অবাক না করে পারে না। এর কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই, অনুমানের ওপর এই মহাজনকে কলঙ্কিত করার অপপ্রয়াস চলছে। আমৃত্যু শিক্ষাব্রতী একজন আধুনিক মানবিক অসাম্প্রদায়িক উদারনীতির মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ চিরনমস্য এক ব্যক্তিত্ব। হাজার বছরে তাঁর সমতুল্য আর কোনো বাঙালি আছে! অথচ তাঁরও নিস্তার নেই নিন্দুক বাঙালির হাতে। মহান গ্যেটের মতো আলোকিত মানুষকেও এমন নিন্দা সইতে হয়েছে। ওই যে বলে বড়র অনেক বিড়ম্বনা, এ-ও তাই।

রবীন্দ্রনাথ সব যুগের সব মানুষের জন্য এক অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর শিক্ষা, চিন্তা, সাহিত্য, জ্ঞান-দর্শন সব সময় ইতিবাচক ও গতিশীল। তাঁর কোনো চাওয়ার মধ্যে সংকীর্ণতা ছিল না। তিনি অফুরান চিরপ্রবহমান। তাঁর জীবনের শেষ দিনটিও ছিল রঙিন, উজ্জ্বল, আলোকময়। সেই মানুষ নামের ঈশ্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাদ সেধেছিলেন এমন বিশ্বাস কেবল তারাই করতে পারে যারা চাঁদে কলঙ্ক খোঁজে, ফুলে কীট খোঁজে। যথার্থ প্রমাণ ছাড়া কাউকে চোর বলাও একটা অপরাধ। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল আনন্দ ও মুক্তি, যুক্তি ও বিজ্ঞান, মানুষ হওয়া ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করা, বিকশিত হওয়া, নদীর মতো ঊষার মরুর বুক চিরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা এবং শিক্ষা হবে সর্বজনীন, মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। তিনি শিক্ষা দিয়ে মানুষে মানুষে সেতুবন্ধ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। আমি এযাবৎকাল রবীন্দ্রবিষয়ক যত গ্রন্থ পড়েছি তার কোথাও পাইনি যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধী ভূমিকায় নেমেছিলেন। শিক্ষা ভাবনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ২২টি প্রবন্ধ, ৩৬টি পত্র, ২২টি অভিভাষণ এবং ২৪টি প্রতিক্রিয়া ও আলোচনা, আটটি স্মৃতিকথা। এ বিশাল যজ্ঞে তিনি কোথাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কোনো মন্তব্য করেননি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ প্রবন্ধে (ডিসেম্বর, ১৯৩২) তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র। সাধারণভাবে বলা চলে সে সাধনা বিদ্যার সাধনা।... আমার বলার মোট কথাটি এই যে, বিশেষ দেশ, বিশেষ জাতি যে বিদ্যার সম্বন্ধে বিশেষ প্রীতি গৌরব ও দায়িত্ব অনুভব করেছে তাকেই রক্ষা ও প্রচারের জন্যে স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সৃষ্টি।’ সে বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ১৯১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ড. রাসবিহারী ঘোষের সভাপতিত্বে কলকাতা টাউন হলে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাব সমর্থন করার জন্য অনুষ্ঠিত হয় সেখানে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি উপস্থিত হতে পারেননি, পরে সেটি অগ্রহায়ণ ১৯১১ সালে ‘প্রবাসী’-তে ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে প্রকাশিত হয়। অসাম্প্রদায়িক রবীন্দ্রনাথ দেখে গেছেন ১৯৩৭ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার। কট্টর রবীন্দ্র সমালোচক ডি এল রায় বা মোহিতলাল মজুমদার কেউ তাঁর বিরোধী ভূমিকার কথা লেখেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবকালে (১৯১১-১২) ড. রাসবিহারী ঘোষ, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ রাজনীতিবিদ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাতিস্বার্থিক দি-দৃক্ষা থেকে বিরোধিতা করতে পারেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো রাজনীতিবিদ নন, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী নন, হিন্দুস্থানি নন- তিনি ছিলেন কবি দার্শনিক শিল্পী সাধু বিশ্বনাগরিক। মিলনই মৌলিক ছিল ধ্যানজ্ঞান ফলে এ ধরনের বিরোধিতা তাঁকে মানায় না, তিনি করেনওনি জ্ঞানত। ১৯১১ সালের শেষের দিক থেকে এক বছর চার মাস তিনি বিদেশে ছিলেন। তার পরই নোবেল প্রাপ্তি, বিশ্বযুদ্ধ, জাপান ভ্রমণ, শান্তিনিকেতন নিয়ে ব্যস্ততা, কাব্য ও উপন্যাস সৃষ্টিতে বিভোর থাকা এবং ১৯২০-এর জুন থেকে প্রায় গোটা ১৯২১ সাল বিদেশে অবস্থানকালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়। ফলে তাঁর বিরোধিতা করার কোনো সুযোগ ছিল না। আর যদি তিনি তা করতেন তাহলে ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয় তাঁকে সংবর্ধনা দিত না।

শুধু তাই নয়, এ অপরাধে যদি তিনি অপরাধী হতেন তাহলে ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করত না। অবশ্য সেটা গ্রহণ করতে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি সশরীরে উপস্থিত হতে পারেননি। সেটা নিশ্চয় তাঁর পলিটিক্স নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়বিদ্বেষ নয়।

                লেখক : শিক্ষাবিদ।

সর্বশেষ খবর