মঙ্গলবার, ৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

একটি কালরাত ও বিষণ্ণ সকাল

তুষার কণা খোন্দকার

একটি কালরাত ও বিষণ্ণ সকাল

বাঙালি জীবনে শোকের মাস আগস্ট। ১৯৭৫ সালের পরে বছর ঘুরে যতবার আগস্ট ফিরে আসে ততবার এ মাসের অনেক স্মৃতি মনের পর্দায় ফিরে এসে আমাকে বিষণ্ণ করে তোলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাত আজও আমার মনে টাটকা স্মৃতি। সে সময় আমি ইডেন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ি। কলেজের পুরনো হোস্টেলের দোতলার কোনায় ১৯/ক নম্বর রুম আজিমপুর চৌরাস্তার মোড় থেকে খুব কাছে। ১৯/ক নম্বর রুমের বাসিন্দা আমরা চার রুমমেট সে বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী। অক্টোবরে পরীক্ষার তারিখ পড়েছে। আমরা চার রুমমেট রাত জেগে পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করি। একজন ঘুমাতে গেলে আরেকজনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিই। ১৫ আগস্ট রাতে আমরা চারজন ১০টা না বাজতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম ঠিক মনে নেই। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে বাইরে থেকে সমবেত কণ্ঠের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু...’ ধ্বনি কানে এলো। আজিমপুর চৌরাস্তা অর্থাৎ বেবি আইসক্রিমের মোড় পেরিয়ে পশ্চিম দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলে আজিমপুর গোরস্থান। শহরের মধ্যে তখনো ট্রাকে করে লাশ গোরস্থানে নেওয়ার চল গড়ে ওঠেনি। কাঠের কিংবা বাঁশের খাটিয়ার চার কোনা চার বাহকের কাঁধে ঠেকিয়ে লাশ বয়ে নেওয়ার সময় শবযাত্রীরা একসঙ্গে গলা মিলিয়ে কলমা পড়ত। হোস্টেলের রুমে প্রায় রাতে আমি একা জেগে থাকতাম আর রাস্তা থেকে ভেসে আসা সমবেত গলার কলমার ধ্বনিতে আমার গা ছমছম করত। আমি জানতাম, রাস্তা থেকে সমবেত কণ্ঠে যে কলমার ধ্বনি ভেসে আসছে এটি একজন মৃত মানুষের চিরবিদায়ের বিষাদভরা ঘোষণা। ইডেনের হোস্টেলে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যতবার আমি সমবেত কণ্ঠে কলমা শুনেছি ততবার ভয় ও বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। ১৫ আগস্ট রাতে শবযাত্রার কলমার ধ্বনি দূরে মিলিয়ে যেতে আমি বিছানা ছেড়ে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম। আমি জানতাম, উচ্চতর বাংলা বিষয়ের পরীক্ষার খাতায় অনেক কোটেশন লিখতে না পারলে আমার কপালে দুঃখ আছে। কাজেই বিষাদমাখা কলমার রেশ মন থেকে দূর করার জন্য আমি গুনগুন করে মুখস্থ করতে শুরু করলাম, ‘দেখ দেখ নীলাম্বরে মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদ পেয়েছে প্রকাশ। কি বৃহৎ লোকালয় কি সুন্দর আকাশ। এক জ্যোৎনা বিস্তারিয়া সমস্ত জগৎ/কে নিল কুড়ায়ে বক্ষে।’

রুমমেটদের ঘুম ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় খুব নিচু গলায় পড়া মুখস্থ করতাম। আমার নিজের গলার স্বর নিচু থাকায় বাইরের সব শব্দ অনায়াসে আমার কানে চলে আসত। প্রতি রাতের মতো সে রাতেও আমার পড়ার গুনগুন স্বরের সঙ্গে সংগত করে কয়েকটা ঝিঁঝি পোকা দেয়ালের পাশের তেঁতুল গাছের গোড়ায় টানা ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ আওয়াজ তুলে যাচ্ছিল। জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকার বিরামহীন ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ আওয়াজ পাঠ্য কবিতার সঙ্গে ছন্দায়িত হয়ে আমার নিজস্ব রাত যেন আমার নিজের সুরে বেজে চলেছিল। টানা অনেকক্ষণ পড়া মুখস্থ করতে গিয়ে একসময় চোখে ঘুমের দুলুনি চলে আসায় ভাবছিলাম এবার খানিক ঘুমিয়ে নিই। আধো জাগা আধো ঘুম চোখে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে একঝাঁক গুলির শব্দে চমকে উঠে আমার নিজস্ব নির্জনতার নিপাট বুননের সুতা ছিঁড়ে গেল। সে রাতের গুলির আওয়াজের মধ্যে কি একটা অস্বাভাবিকতা ছিল যা আমাকে চমকে দিয়েছিল। কথাটি এজন্য বলছি যে ইডেন কলেজের পুরনো হোস্টেলের কোনার রুম থেকে প্রায় রাতেই রাইফেলের গুলির আওয়াজ শুনতাম। ইডেন কলেজ থেকে পিলখানা বিডিআর ক্যাম্প বেশ কাছে। অনেক সময় গভীর রাতে পিলখানায় বিডিআর ক্যাম্প থেকে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসত। ক্যাম্পে টানা রাইফেলের গুলির আওয়াজ শুনলে আমরা বলতাম পিলখানায় চাঁদমারি হচ্ছে। পিলখানার বিডিআররা মাঝরাতে কেন গুলি করে চাঁদ মারে তার কারণ জানা না থাকলেও আমি জানতাম চাঁদমারিতে চাঁদ কিংবা মানুষ কেউই মরে না। যে গুলি শুধু চাঁদকে তাক করে মারা হয়, যাতে মানুষ কিংবা পাখি কেউ মরে না অমন নির্দোষ গুলির আওয়াজে দোতলার ঘরে আমি কিংবা নিচে তেঁতুল তলার ঝিঁঝির দল কেউ ভয় পেতাম না। কিন্তু ১৫ আগস্ট শেষ রাতের গুলির আওয়াজ চমকে ওঠার মতো অস্বাভাবিক জোরাল ছিল যাকে আমি চাঁদমারির সঙ্গে মেলাতে না পেরে মনের মধ্যে অস্থির বোধ করছিলাম। সে রাতে রাইফেলের গুলির আওয়াজ চাঁদমারির ছাড়াছাড়া রাইফেলের আওয়াজের চেয়ে অনেক বেশি জোরাল ছিল। মনে হচ্ছিল গুলির শব্দের উৎস বিডিআর ক্যাম্প নয়। আরও কাছে অন্য কোনো উৎস থেকে টানা রাইফেলের গুলির ঠা-ঠা-ঠা আওয়াজ আসছে। গুলির শব্দ নিয়ে মনে খটকা লাগায় আমি বারবার কান খাড়া করে শব্দের উৎস আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু ঠাহর করতে পারছিলাম না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও অবিরাম গুলির শব্দ চারদিক কাঁপিয়ে তোলায় আমার মনের মধ্যে ভয়ের আনাগোনা বেড়ে গেল। বিডিআরের চাঁদমারির গুলির আওয়াজ কখনো এত বেশি সময় ধরে চলে না। কিন্তু ১৫ আগস্ট রাতে বিরামহীন গুলির আওয়াজ ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। অনেকক্ষণ কান পেতে শুনে আমি নিশ্চিত হলাম গুলির আওয়াজ উত্তর দিক থেকে আসছে। রাইফেলের গুলির সঙ্গে মর্টারের কড়কড়াৎ আওয়াজ মিশে যেতে আমি আতঙ্কিত বোধ করলাম। মর্টারের গোলা ছুটে যাওয়ার শব্দে আমার মনে একাত্তরের যুদ্ধের স্মৃতি ফিরে এলো। একাত্তর সালে আমি অনেকবার অনেকরকম গুলির শব্দ শুনেছি। গুলির শব্দ শুনে অস্ত্রের পরিচয় চেনার চেষ্টা করা একাত্তর সালে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। ১৫ আগস্ট রাতে উত্তর দিক থেকে ভেসে আসা ভারী অস্ত্রের গুলির শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল ঢাকা শহরে গুরুতর কিছু ঘটে যাচ্ছে। শেষ রাতে এত গোলাগুলির কারণ কী হতে পারে তা অনুমান করতে না পেরে মনের অস্বস্তি বেড়ে গেল। ঘরের আলো নিভিয়ে আমি গুলি থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাইফেলের গুলির আওয়াজ ছাপিয়ে মাঝেমধ্যেই মর্টারের শেল ছোড়ার আওয়াজ পেয়ে রুমমেট শেফালিকে ডেকে তুললাম। বললাম, ‘খুব কাছে কোথায় যেন ভয়ানক গোলাগুলি হচ্ছে। আমার ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে খুব কাছে কোথাও খুব খারাপ কিছু ঘটছে।’ ঘুম থেকে ডেকে তোলায় মহাবিরক্ত শেফালি আরাম করে পাশ ফিরে শুয়ে বলল, ‘বিডিআরে চাঁদমারি হচ্ছে। এতে ভয় পাওয়ার কী আছে। এটা নতুন কিছু নাকি! যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।’ শেফালির কথায় আমার মনের দ্বিধা কাটল না। মনের ওপর ভয়ের ভার নিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে পড়ার আগে মনের মধ্যে হরেক প্রশ্নের আনাগোনা চলতে থাকল। ভাবলাম, জাসদের গণবাহিনী কি ঢাকা শহর আক্রমণ করেছে? গণবাহিনীর সঙ্গে কি সেনাদের যুদ্ধ হচ্ছে? সে সময় দেশে জাসদের গণবাহিনী এখানে-সেখানে আক্রমণ করত। আমি ভেবেছিলাম শহরের মধ্যে জাসদের গণবাহিনী বড় কোনো প্রতিষ্ঠান আক্রমণ করেছে। গণবাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে আমাদের সেনাবাহিনী কিংবা পুলিশের সঙ্গে ওদের যুদ্ধ বেঁধে গেছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে মনের মধ্যে ভয় নিয়ে একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সকালে শেফালির আতঙ্কিত গলার ডাকাডাকিতে চমকে  ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ওর মুখে শুনলাম, কাল রাতে সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে খুন করে সৈন্যরা রেডিও, টেলিভিশন স্টেশন দখল করে নিয়েছে। আচমকা ঘুম ভেঙে আতঙ্কিত গলায় শেফালিকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘রেডিওতে কি পাক সার জমিন সাদ বাদ বাজাচ্ছে? দেশটা কি আবার পাকিস্তান হয়ে গেছে?’ শেফালি বিষণ্ণœ গলায় বলল, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না। রেডিওতে পাক সার জমিন সাদ বাদ বাজাচ্ছে না, তবে বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও পাকিস্তানের ঢঙে রেডিও বাংলাদেশ বলছে।’ শেফালির কথা শুনে বুকের মধ্যে অজানা ভয় গুড়গুড় করে উঠল। শেফালির গলার স্বরে ভয়ের কাঁপন গোপন থাকল না। আমি ওর মুখের দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থেকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সবাইকে মেরে ফেলেছে? কেউ বেঁচে নেই?’ আমার প্রশ্নের জবাবে শেফালি সেদিন কী বলেছিল সে কথা মনে নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে মনের মধ্যে আমার সমবয়সী একটি মেয়ের মুখ ভেসে এলো। মেয়েটিকে এক সকালে বকশীবাজার বদরুন্নেছা কলেজের বারান্দায় একটু সময়ের জন্য দেখেছিলাম। ’৭৪ সালে ইডেন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমরা কয়েকজন দল বেঁধে বকশীবাজার মহিলা কলেজে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ওখানে কলেজের আঙিনায় কাঁঠাল গাছের ওপাশে নিচু টিনের চালা ঘরের টানা বারান্দায় একসারি শাল কাঠের খুঁটি। শ্যামলা রঙের একটা মেয়ে তারই একটা খুঁটি ধরে মনের আনন্দে ঘুরপাক খাচ্ছিল। একটা খুঁটি ধরে গা ছেড়ে দিয়ে ঘুরপাক খাওয়ার খেলাটা আমারও খুব প্রিয় ছিল। বকশীবাজার কলেজের নিচু চালের টিনের ঘরের বারান্দায় আরও অনেক খুঁটি খালি থাকলেও আমি খেলাটা না খেলে চুপচাপ সেই মেয়েটির খেলা দেখছিলাম। ইডেন কলেজ হলে অনায়াসে খুঁটি ধরে ঘুরপাক খেলা খেলতে শুরু করে দিতে পারতাম কিন্তু অন্যদের কলেজে বেড়াতে এসে খুঁটি ধরে ঘুরপাক খেলা খেলতে সেদিন লজ্জা করছিল। আমি আঙিনার কাঁঠালতলায় দাঁড়িয়ে মেয়েটার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে ছিলাম। মেয়েটার দিকে আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাশে দাঁড়ানো কাজল বলেছিল, ‘ওই মেয়েটা রেহানা। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। আমাদের সঙ্গে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।’ আমি দেখলাম, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মেয়েটার চেহারায় অনেক মিল। মেয়েটার থুতনিতে মৃদু ঢেউ ওকে ওর বাবার চেহারার খুব কাছে নিয়ে গেছে। আগের বছর বকশীবাজার কলেজের বারান্দায় এক ঝলক দেখা মেয়েটার মুখ-চোখের সামনে ভেসে আসতে আমি ভাবলাম, সৈন্যরা কি সেই মেয়েটিকেও মেরে ফেলেছে? আমার হতবিহ্বল চোখের সামনে রেহানা নামের মেয়েটির প্রাণবন্ত মুখ অনেকক্ষণ ভেসে ছিল।

১৫ আগস্ট কালরাতের শেষে ভয়ানক বিষণ্ণ সেই সকালের কথা আমি কোনো দিন ভুলব না। আমরা সবাই রুম ছেড়ে বারান্দায় এসে জড়ো হয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবর সত্য নাকি মিথ্যা আমরা নিশ্চিত কিছু জানতাম না। আমরা বারান্দায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভয়ানক উদ্বেগ আর বিষণ্ণœতা আমাদের মনের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। সেই সকালে পুরনো হোস্টেলের বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখি আঙিনার ভেজা ঘাসের ডগায় সকালের রোদ গা এলিয়ে বিছিয়ে আছে। আমার মনে হলো সকালের রোদের গা থেকে কেউ আলোর ঝিলিক মুছে নিয়েছিল। ঘাসের আঙিনায় বিষণ্ণœতার জমাট ছায়া। হয়তো আমার বিমূঢ় মনের বিষণ্ণœতা সেদিন ইডেনের আঙিনার রোদ থেকে আলো শুষে নিয়ে আঙিনাকে আরও বিষণ্ণœ করে তুলেছিল। বছর ঘুরে আগস্ট দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভীতি জাগানো রাত এবং উদ্বেগভরা সকাল আজও আমার মনে ফিরে এসে আমাকে বিষণ্ণ করে তোলে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর