শনিবার, ৭ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

শ্রীপুরে মাছের কারখানা

শাইখ সিরাজ

শ্রীপুরে মাছের কারখানা

কৃষিতে সফল হতে হলে সব সময়ই কৌশলী হতে হয়। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তির কৃষির ক্ষেত্রে সাফল্য নির্ভর করে দক্ষতা অর্জনের ওপর। এখানে শুধু অর্থের এবং সময়ের বিনিয়োগই নয়, বিনিয়োগ করতে হয় মেধা ও চিন্তার। কয়েক বছর ধরে তরুণদের মধ্যে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বায়োফ্লকে সফল হলেও ব্যর্থতার সংবাদও পাওয়া গেছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে যা পেয়েছি তা হচ্ছে, বায়োফ্লক একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। এর সর্বজনগৃহীত সহজ কোনো ভার্সন নেই। উদ্যোক্তারা নিজেদের মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ধৈর্যের পরীক্ষায় কেউ কেউ সফল হচ্ছেন, কেউ হচ্ছেন ব্যর্থ। তবে উদ্যোগ থেমে নেই। থেমে নেই বায়োফ্লক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। গত ডিসেম্বরে নোমান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ আবদুল্লাহ জাবের আমাকে ফোন দিয়ে জানালেন, বায়োফ্লক নিয়ে আমার তৈরি প্রতিবেদনগুলো ইউটিউবে দেখে শ্রীপুরে তার গার্মেন্ট কারখানার এক পাশে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন। ব্যাপারটি নিয়ে আমি খুব উৎসুক ছিলাম। এ পর্যন্ত যারা বায়োফ্লক নিয়ে উদ্যোগী হয়েছেন দু-এক জন ছাড়া মাছ উৎপাদনের চেয়ে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ প্রশিক্ষণ দেওয়ায় আগ্রহী বেশি ছিলেন। বায়োফ্লকে প্রথম সফল ও বড় উদ্যোগ দেখেছিলাম কুমিল্লার রোমেলের। যে কি না সুইমিংপুলকেও পরিণত করেছিলেন মাছ চাষের আধার হিসেবে। জাবেরের উদ্যোগটা নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। জাবের সফল হলে শিল্পোদ্যোক্তারা বায়োফ্লকে মাছ চাষে এগিয়ে আসবেন। জাবেরের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক আগে থেকেই। কৃষিপ্রেমিক জাবের জানিয়েছিলেন কৃষির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা শৈশব-কৈশোর থেকেই। নানা প্রজাতির পশু-পাখির প্রতি তার দারুণ আগ্রহ। শৈশবে যখন তার বাসার সবাই টেলিভিশনে কার্টুন, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখতে পছন্দ করতেন তার পছন্দ ছিল আমার কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান। নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপারে তিনি বেশ সচেতন। পারিবারিক চাহিদা মেটাতে কলকারখানার পাশে খালি জমিতে সবজি চাষের পাশাপাশি হাঁস-মুরগিও লালনপালন করেন। যা হোক, গত মে মাসে জাবের ফোন দিলেন। তার বায়োফ্লকে হার্ভেস্ট হবে। আমি বললাম, হার্ভেস্টের দিন আমি থাকব। আমি দেখতে চাই মাছের উৎপাদন কেমন হলো। জাবেরের কারখানায় গিয়ে দেখি শিল্পকারখানার মধ্যেই আরেক শিল্পোদ্যোগ। সাড়ে ৫ লাখ লিটার পানিতে বায়োফ্লকে শিং, গুলশা, শোলসহ বেশ কয়েক প্রকার মাছের চাষ।

আগেই বলেছি দেশের তরুণ উদ্যোক্তা ও যারা শিল্প পছন্দ করেন তাদের জন্য ইনডোর ফিশ ফার্ম একটি আকর্ষণীয় উদ্যোগ হয়ে উঠেছে। কারণ পুকুর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছ চাষ একটি সনাতন পদ্ধতি। সেখানে নানান ব্যবস্থাপনার পরও প্রকৃতির ওপর অনেক নির্ভরতা আছে। কিন্তু ইনডোর ফার্মে সব ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানসম্মত ও গাণিতিক হিসাবে চলে। এ পর্যন্ত বহুসংখ্যক বায়োফ্লক প্রকল্প দেখেছি। প্রায় সব উদ্যোগই তরুণ উদ্যোক্তাদের হাত দিয়ে এসেছে। যারা অল্প জায়গায় বেশি উৎপাদনের হিসাব কষতে পছন্দ করেন।

জাবের ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন তার টেক্সটাইল কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থা। আর বলছিলেন তার কারখানায় কর্মী আছে ৭০ হাজারের বেশি। যে কর্মীদের শ্রম-ঘামে তার কারখানা সচল, সেই শ্রমিকদের সতেজ বিশুদ্ধ খাবার নিশ্চিত করার চিন্তা থেকেই বায়োফ্লকের মতো একটি উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন। নোমান গ্রুপের বিশাল কারখানার পাশে ১৮২ বাই ৬৫ ফুট জায়গার মধ্যে বায়োফ্লকের একটি শেড। ফ্লোরের ওপর রডের খাঁচা ও পলিশেড দিয়ে তৈরি ১১টি ট্যাংক। কোনোটি গোলাকার, কোনোটি বা আয়তাকার। ফ্লোর থেকে ট্যাংকের উচ্চতা ৪ থেকে সাড়ে ৪ ফুট। ধারণক্ষমতা ১০ হাজার থেকে ১ লাখ লিটার। ট্যাংকে পানি। আর তাতে যুক্ত আছে অ্যারেটর, অক্সিজেনের বুদবুদ। একেক ট্যাংকে একেক ধরনের মাছ। জাবের জানালেন, এ শেড ও ট্যাংক তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে তার কারখানার অব্যবহৃত টিন, লোহালক্কর, রড ও পুরনো মালামাল। ফলে খরচ খুব একটা বেশি পড়েনি। গত ডিসেম্বরে এ ট্যাংকগুলোয় মাত্র ১ গ্রাম আকারের পোনা ছাড়া হয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে সেগুলো পরিণত মাছ হয়েছে।

ট্যাংকের পানি নিষ্কাশন চলতে চলতে ঘুরে দেখলাম তার পুরো বায়োফ্লক কারখানা। টেক্সটাইল মিলের অন্য শেডগুলোয় যেমন কাপড় উৎপাদন চলছে, সেখানে চলছে মাছের উৎপাদন। আমার এ লেখার শিরোনামে বলেছি মাছের কারখানা, এর কারণ সত্যি সত্যি এটি একটি কারখানা। বিজ্ঞান ও অঙ্ক কষে এর উৎপাদন ঠিক করা আছে। মাছের সাইজে ছোটবড় হতে পারে কিন্তু সংখ্যার দিক দিয়ে হেরফের হওয়ার আশঙ্কা কম। জাবেরের মাছের খামার দেখতে দেখতে মনে পড়ল এমন একটি মাছের কারখানা দেখেছিলাম চীনের জংশানে। সেখানে দোতলা বিশাল শেডে রিসার্কুলেটিং অ্যাকোয়া কালচার পদ্ধতিতে মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি ও কচ্ছপের চাষ দেখেছি। বিশাল বিশাল ট্যাংকে চাষ হতে দেখেছি বড় বড় মাছ। জাবেরের বায়োফ্লক কারখানাটি যেন চীনে দেখা সেই মাছ কারখানারই ছোট ভার্সন। এর মধ্যে যে দুটি ট্যাংক থেকে মাছ তোলা হবে, সে ট্যাংক দুটির পানি নিষ্কাশন প্রায় শেষ। একটি ট্যাংকে শিং মাছ, অন্যটিতে ট্যাংরা। পুরো ট্যাংক মাছে গিজগিজ করছে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে যা হয়, অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ। ছোট্ট একটা জায়গায় অসংখ্য মাছ দেখে মন ভরে যায়। ১০ ফিট বাই ১০ ফিট ছোট্ট একটি জায়গায় ১০ হাজার লিটার পানির ট্যাংকটিতে যে পরিমাণ মাছ চাষ হয়েছে, তা চাষ করতে ১ বিঘা জলায়তনের পুকুরের প্রয়োজন হতো। প্রথমে আমরা শিং মাছের ট্যাংকটির সামনেই গেলাম। এখানে দায়িত্বে থাকা আরিফ জানালেন, বায়োফ্লকে মাছ চাষের ক্ষেত্রে পোনা একটি বড় বিষয়। ভালো পোনা না হলে বৃদ্ধি যেমন কম হয়, কাক্সিক্ষত সাইজে আনাটা কঠিন। শীতকালে পোনা ছাড়ার কারণে মাছ বড় হতে সময় একটু বেশি লেগেছে। এমনিতে এ পদ্ধতিতে শিংজাতীয় মাছ উৎপাদনে চার মাস লাগে। আমার প্রশ্ন ছিল, তাদের উৎপাদনে কেন ছয় মাস লাগল। জাবের ও আরিফ প্রায় সমস্বরে বলে উঠলেন, পোনার গুণগত মান তেমন ভালো না হওয়ায় সময়টা বেশি লেগেছে। যখন পোনা ছাড়া হয়েছিল তখন ১ কেজিতে পোনা ছিল ১ হাজার। আর এই সময়ে মাছ বর্ধন হয়েছে ৭০-৮০টিতে ১ কেজি হিসেবে। এটি সন্তোষজনক বর্ধন না হলেও তিনটি সমস্যা চিহ্নিত করা গেছে। এক. বায়োফ্লকে পোনা ছাড়তে হবে শীত শুরুর আগে। দুই. শিংয়ের ফিমেল পোনার বর্ধন বেশি হয়। তিন. বায়োফ্লকের জন্য অবশ্যই গুণগত ভালোমানের পোনা বাছাই করতে হবে।

প্রথম পর্যায়ে সময় একটু বেশি লাগলেও এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাছের বিশুদ্ধতা নিয়ে দারুণ আশাবাদী উদ্যোক্তা মোহাম্মাদ আবদুল্লাহ জাবের। তিনি বলেন, এ মাছের রং ও স্বাদ নদীর মাছের মতোই। দেখলাম জাবেরের কথাই ঠিক। এমন উজ্জ্বল শিং মাছ অনেক দিন দেখিনি। গুলশা বা টেংরা মাছগুলোর রংও চকচকে। অন্য নয়টি ট্যাংকে ভিয়েতনামি শৌল, কই, মনোসেক্স তেলাপিয়া ও পাবদা মাছের চাষ চলছে।

প্রথম ছয় মাসে পরীক্ষামূলক উৎপাদন সাফল্যেই বেশ খুশি তারা। তাদের স্বপ্নটা অনেক বড়। কোম্পানির ৭০ হাজার কর্মীকে কম মূল্যে নিরাপদ খাদ্য হিসেবে এ মাছ পৌঁছে দিতে চান তারা। অর্থাৎ বাজারও তাদের প্রস্তুত। শুধু নিরাপদে ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন করে যেতে হবে। কিন্তু জাবেরের স্বপ্ন শুধু ৭০ হাজারেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি বললেন, ‘আমরা যেহেতু বিশুদ্ধ উপায়ে মাছ উৎপাদন করছি। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বের প্রথম সারির কয়েকটি দেশের একটি আমাদের দেশ। তবে কেন এ মাছ আমরা রপ্তানি করতে পারব না! নিশ্চয়ই পারব।’ বোঝা গেল, শিল্পোদ্যোক্তা জাবেরের স্বপ্নের বীজ অনেক গভীরে প্রোথিত। জাবেরের স্বপ্নের সঙ্গে আমি যে স্বপ্ন মনে-প্রাণে ধারণ করে রেখেছি, শিল্পোদ্যোক্তারা কৃষিতে বিনিয়োগ করলে আমাদের কৃষি আরও উৎপাদনশীল হবে, আমরা বিশ্ববাজার ধরতে পারব, সে কথাই জাবেরের কণ্ঠে শোনা গেল। আমি বিশ্বাস করি এমন স্বপ্নবান উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই কৃষিশিল্পে বিপ্লব সাধিত হবে। ঐতিহ্যভিত্তিক সনাতন কৃষি এখন দ্রুত চলে আসছে বাণিজ্যনির্ভর কৃষিতে। কোন উৎপাদনব্যবস্থায় দ্রুত আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে সেদিকেই ঝুঁকছেন বাণিজ্যিক উদ্যোক্তা। এ ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করার জন্যই কৃষিতে যুক্ত হয়েছে নানান প্রযুক্তি, ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এতে কৃষি গতিশীল হয়েছে, উৎপাদন বেড়েছে। যান্ত্রিক গোলযোগ না হলে উৎপাদনে লোকসানের আশঙ্কা নেই বললেই চলে। এর ফলে কৃষি ও যে কোনো খামার উদ্যোগে যুক্ত হচ্ছেন বেকার তরুণ থেকে শুরু করে সবচেয়ে বড় অর্থশালী শিল্পোদ্যোক্তা পর্যন্ত। দুই পক্ষই চাইছেন দ্রুত আর্থিক সাফল্য। সঠিক ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করে অনেকেই সাফল্য অর্জন করছেন। কিন্তু শুধু অর্থের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে কেউ কেউ ব্যবস্থাপনায় পিছিয়েও পড়ছেন। গত কয়েক বছর নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় একটি বিনিয়োগের স্বপ্ন জাগিয়েছে বায়োফ্লক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ‘বায়োফ্লক’ মাছ চাষের একটি পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা। বিশ্বব্যাপীই এ ব্যবস্থাটির সামনে পেছনে অনেক পদ্ধতির প্রতিযোগিতা চলছে। রয়েছে রাস, বটম-ক্লিন রেসওয়ে, আইপিআরএস পদ্ধতি। আবার নিবিড় ও আধানিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য চলছে নানান পদ্ধতির অনুশীলন। আসলে সব জায়গাতেই গভীর মনোযোগ রাখার বিষয়। বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করার বিষয়। এখানে সূত্রের বাইরে কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। যদি কোনো উদ্যোক্তা বিষয়টি পুরোপুরি না বুঝে বিনিয়োগে নামেন তাহলে ভুল হবে। সব উদ্যোক্তার সাফল্য কামনা করি। সেই সঙ্গে আশা করি, উৎপাদনমুখী বাণিজ্যিক কৃষি উদ্যোগের ক্ষেত্রে আগে পদ্ধতিগত জানা-শোনার দিকে বেশি জোর দেবেন।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর