শনিবার, ৭ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনার টিকা নিয়ে বিভ্রান্তি কেন

তপন কুমার ঘোষ

করোনার টিকা নিয়ে বিভ্রান্তি কেন

করোনা সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। দেশে করোনা রোগীর প্রথম হদিস মেলে গেল বছরের ৮ মার্চ। এরই মধ্যে পেরিয়ে যাচ্ছে প্রায় দেড় বছর। কিন্তু নিয়ন্ত্রণে আসেনি করোনা। সংক্রমণ ও মৃত্যু কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। মাঝে কয়েক মাস কিছুটা স্বস্তি দিয়ে ফের চোখ রাঙাচ্ছে। কবে বিদায় নেবে করোনা, এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে। করোনা মহামারীর মধ্যেই হু হু করে বেড়ে চলেছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। একেই বলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী ফের ছড়িয়ে পড়েছে করোনা সংক্রমণ। এশিয়ায় ভয়াবহভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে করোনা। করোনার আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত চীনে নতুন সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। গোটা বিশ্বে করোনায় মৃত্যু ইতিমধ্যে ৪২ লাখ ছাড়িয়েছে।

করোনার ‘ডেল্টা’ ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন গোটা বিশ্ব। এ পর্যন্ত ১৩২ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে অতিসংক্রামক চরিত্রের এ ভ্যারিয়েন্ট। নতুন এ ধরন সম্পর্কে এর আগে যা ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়েও এটা অনেক বেশি ভয়ংকর। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট জলবসন্তের মতোই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং আগের ধরনগুলোর চেয়েও গুরুতর অসুস্থতার কারণ ঘটাচ্ছে। এ কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র। বলা হয়েছে, এ ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে টিকা নেওয়ার কোনো বিকল্প আপাতত নেই। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কাই শেষমেশ সত্য হলো। ঈদের পর করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই-ই বেড়েছে। ২৪ ঘণ্টায় প্রাণহানি ২০০ পেরিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু এরই মধ্যে ২২ হাজারের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞরা বারবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন। করোনায় এত মৃত্যুর পরও আমাদের একাংশের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। স্বাস্থ্যবিধি শিকেয় তুলে কারণে-অকারণে বাইরে বের হচ্ছি। বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তায় কান দিচ্ছি না। মাস্ক পরতে অনীহা। অজুহাতের শেষ নেই। গরিবের করোনা হয় না। মাস্ক পকেটে আছে। বেশি সময় মাস্ক পরে থাকলে অস্বস্তি লাগে। শ্বাসকষ্ট হয়। সামাজিক (শারীরিক) দূরত্ব মেনে চললে মাস্ক পরার প্রয়োজন কী- কত ছুতা। লকডাউনে দোকানপাট বন্ধ রাখা নিয়ে অলিগলিতে চোর-পুলিশ খেলা চলছে। ফেরিঘাট-লঞ্চঘাটে উপচে পড়া ভিড়। স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। বিভিন্ন পয়েন্টে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বিধিনিষেধ অমান্যকারীদের জরিমানা করা হচ্ছে। তার পরও বেপরোয়া মনোভাব।

রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলোয় এখন বাইরের রোগীর চাপ বেশি। রাজধানীর একটি কভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালের পরিচালক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মোট করোনা রোগীর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বা তারও বেশি ঢাকার বাইরের। দূরদূরান্ত থেকে আসা এসব রোগীর অনেকেই টিকা নেননি। আর যাদের টিকা নেওয়া আছে তারা আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর ঘটনা খুবই কম। বাংলাদেশে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি করোনার টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতিমতো ভারতের কাছ থেকে টিকা না পাওয়ায় টিকাদান কর্মসূচি হোঁচট খায়। পরে সরকারের বিশেষ তৎপরতায় বিভিন্ন উৎস থেকে দেশে করোনার টিকা আসা শুরু হয়েছে। এটা খুবই স্বস্তির খবর। সারা দেশে গণটিকাদানের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এখন চলছে সলতে পাকানোর কাজ। টিকাদান কর্মসূচি ফিরে পেয়েছে গতি।

করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহতা অনেক বেশি হলেও তা প্রতিরোধে মাস্ক পরা, সামাজিক (শারীরিক) দূরত্ববিধি বজায় রাখা, বারবার সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়ার মতো বিষয়গুলো এখনো কার্যকর বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান মাইকেল রায়ান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ রুখতে গণটিকাকরণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দেশে-বিদেশে টিকাবিরোধী প্রচারণা চলছে। ৩১ জুলাই বাংলাদেশ প্রতিদিন ‘টিকাবিরোধী সংঘবদ্ধ প্রচারণার নেপথ্য কাহিনি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। দেশে টিকা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে অপপ্রচার সমানে চলেছে। বয়ান করে কুসংস্কার উসকে দেওয়া হয়েছে। তবে আশার কথা, শুরুতে কিছুটা দ্বিধাদ্ধন্ধ থাকলেও অনেকেই এখন টিকা নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। টিকাদান কেন্দ্রে এখন দীর্ঘ লাইন। যারা একসময় মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিলেন তারাই এখন সুড়সুড় করে কেন্দ্রে গিয়ে টিকা নিচ্ছেন। বোধোদয় হয়েছে- টিকা ছাড়া গতি নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা স্টিফেন হারমন। বয়স ৩৪ বছর। সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। সেলিব্রেটি নন হারমন। কিন্তু তার মৃত্যুর খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কভিড ভ্যাকসিন নিয়ে নিয়মিত উপহাস করে আলোচিত হয়েছিলেন ওই যুবক। সক্রিয়ভাবে টিকার বিরোধিতা করেছেন। করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করা অবস্থায়ও বলেছিলেন তিনি কখনো টিকা নেবেন না। তার বিশ্বাসই তাকে রক্ষা করবে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে সংক্রমণ কমাতে না পারলে হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ও চিকিৎসা সরঞ্জাম বাড়িয়ে কত দূর কী করা যাবে বলা মুশকিল। চিকিৎসকদের স্পষ্ট অভিমত, করোনা রুখতে টিকা নিতে হবে। দুই ডোজ টিকা নিলেই কেল্লাফতে- এ ধারণা ভ্রান্ত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এতে সংক্রমণ কমে আসবে। আর টিকা নেওয়ার পর সংক্রমণ হলেও জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকির মাত্রা অনেক কম হবে। পুরনো প্রবাদ- সাবধানের মার নেই। ‘গরিবের করোনা হয় না’- এ বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি নেই।

লেখক : পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন।

সর্বশেষ খবর