মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

দেশের মর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতু

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

দেশের মর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের সেতুবন্ধে তৈরি হবে নতুন মাত্রা। দ্রুত যাতায়াতের পাশাপাশি তৈরি হবে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ। পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষ হতে চলায় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাসছেন পদ্মার দুই পারের মানুষ। আনন্দ-আবেগে ভাসছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশ ও বাঙালির গর্বের প্রতীক, আনন্দের ঝরনাধারা। পদ্মা সেতু এখন দেশের মর্যাদার প্রতীক। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন এ পদ্মা সেতু।

ইতিমধ্যেই সেতুর দুই পাশে বিশাল এলাকা ঘিরে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠছে শিল্প। শিল্পোদ্যোক্তারা শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য বিশাল এলাকাজুড়ে জমি কিনে রেখেছেন। গড়ে উঠছে অনেক স্থাপনা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি প্রস্তুত সেখানে শিল্পায়নের জন্য। তারা অনেকে জমি কিনেছেন। এখন তাদের প্রতীক্ষা- কবে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হলে, ব্যবসায়ীরা পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার নিশ্চয়তা পেলে শিল্পায়নের ধুম পড়বে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিও বাড়বে। পদ্মা সেতুর জন্য অপেক্ষা প্রায় দুই যুগের। ১৯৯৮ সালে এ সেতুর প্রাকসম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। এরপর জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা বিস্তারিত সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়। সেনাশাসিত ফখরুদ্দীন সরকারের সময় ২০০৭ সালে একনেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস হয়। তখন এ প্রকল্প ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এরপর প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন না করে ২০১৮ সালের জুনে আবারও ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে আরেক দফা প্রস্তাব সংশোধন করতে হতে পারে। ২০০৯ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়। চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কিন্তু মাঝপথে থেমে যায় পদ্মা সেতুর কাজ। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় শুরু হয় দেশবাসীর বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ।

নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দ্রুত এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। কর্মযজ্ঞের ধারাবাহিকতায় স্বপ্নের সেতুটিতে আর মাত্র একটি স্প্যানে ৭০টি রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো বাকি রয়েছে। সেতুর ১২ নম্বর স্প্যানে স্ল্যাব বসানো গেলেই শেষ হবে বড় একটা কাজ। এ কাজটি শেষ হলে হেঁটেই পার হওয়া যাবে পদ্মা সেতু। আগস্টের মধ্যেই সেতুতে রোডওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন পদ্মা সেতুর প্রকৌশলীরা।

গত মাসে সেতুতে রোডওয়ে স্ল্যাব বসানোয় রেকর্ড করেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। এ মাসে সর্বোচ্চসংখ্যক স্ল্যাব বসানো হয়েছে। জুলাইয়ে সেতুর স্প্যানে ১১০টি রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো হয়েছে। এর আগে এক মাসে সর্বোচ্চ ১০৩টি স্ল্যাব বসানো হয়েছিল। ৬.১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থের পদ্মা সেতুতে ৪১টি স্প্যান রয়েছে। ইতিমধ্যে ৪০টি স্প্যানে স্ল্যাব বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। সেতুর মোট ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে বসানো হয়েছে ২ হাজার ৮৪৭টি। আর মাত্র ১৫০ মিটার জায়গায় ৭০টি স্ল্যাব বসিয়ে দিলেই শেষ হবে সেতুর মূল কাজের বড় একটি অংশ। এ কাজও এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। ১৩ জুলাই সেতুতে পরীক্ষামূলকভাবে পিচ ঢালাইয়ের কাজ করা হয়। সেতুর জাজিরা প্রান্তের ৪১ নম্বর স্প্যান থেকে ৩৭ নম্বর স্প্যান পর্যন্ত রোডওয়ে স্ল্যাব, প্যারাপেট ওয়াল ও রোড ডিভাইডার বসানো হয়েছে। এ সড়কটুকুতে বাতি ছাড়া প্রায় সব কাজই শেষ। এদিন সেতুর ৪০ নম্বর স্প্যানের ওপরের সড়কে পিচ ঢালাইয়ের কাজ হয়। এর আগে এ স্প্যানের ওপরের সড়কে ১০ মিটার প্রস্থ এবং ৬০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ওয়াটারপ্রæফ মেমব্রেন বিছানো হয়েছিল। যেটি পানি নিরোধক একটি প্রলেপ। তার ওপরের পিচ ঢালাই করা হয়।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। একই সঙ্গে চলতে থাকে রোডওয়ে, রেলওয়ে স্ল্যাব বসানোসহ অন্যান্য কাজ। সেতুর মূল আকৃতি দোতলা। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।

দুটি সংযোগসড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সেতুর কাঠামো। ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই এ সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ জানে, ফেরি পাড়ি দিয়ে পদ্মা পার হওয়া ভয়ানক এক অস্বস্তিকর ও দীর্ঘ ভোগান্তির কাজ। এর মধ্যে যথেষ্ট বিড়ম্বনা ও ঝুঁকিও রয়েছে। রয়েছে মৃত্যুঝুঁকিও। ফলে ৭-৮ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা লেগে যায়। প্রতিদিনই এ ধরনের অমানবিক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। অনেক সময় বৈরী আবহাওয়ার কারণে ফেরি বন্ধ থাকে। আর এটা চলে আসছে যুগের পর যুগ। বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ যেভাবে যাতায়াত সুবিধা ভোগ করতে পারছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ সেভাবে পারছে না। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৭ কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে এ সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ।

সর্বশেষ খবর