শিরোনাম
বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ইসলামে নিষিদ্ধ

এম এ মান্নান

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ইসলামে নিষিদ্ধ

ইসলামে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বিদায় হজে বলেছেন, ‘তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না, অতীতে যারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে তারাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।’ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতার সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হলো মানবতার মুক্তির দিশারি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লিখিত মদিনার প্রথম সনদ। সহাবস্থান ও শান্তির এ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল মুসলমান, ইহুদি ও মুশরিকদের মধ্যে। মদিনা সনদে লেখা ছিল প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করতে পারবে।

ব্যক্তিজীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান। তাঁর পূর্বপুরুষ সুদূর ইরাক থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনও শুরু হয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায়। তিনি মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের অত্যন্ত সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্পর্কে অচিরেই মোহমুক্তি ঘটে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি যে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি এ সহজ সত্যটি তিনি উপলব্ধি করেন বাস্তবতার আলোকে। ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিনি। ধর্মকে কলুষমুক্ত রাখাই ছিল বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য। সব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সবার সমান অধিকার বজায় রাখতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে বলা হয়, জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রিয় ধর্ম হলো ইসলাম। আওয়ামী লীগ এ মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে শাসনতন্ত্রে সুস্পষ্ট গ্যারান্টি থাকবে পবিত্র কোরআন ও সুন্নায় সন্নিবেশিত ইসলামের নির্দেশাবলির পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন বা বলবৎ করা চলবে না। শাসনতন্ত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পবিত্রতা রক্ষার গ্যারান্টি সন্নিবেশিত হবে। সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য পর্যাপ্ত বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সংখ্যালঘুরা আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সমান অধিকার ভোগ করবে। নিজেদের ধর্ম পালন ও প্রচার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা এবং নিজ নিজ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের অধিকার শাসনতান্ত্রিকভাবে রক্ষা করা হবে। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতে বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।  কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না।’

ঢাকার আলিয়া মাদরাসার এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে পাকিস্তান আমলে ইসলামবিরোধী বহু কাজ হয়েছে। রেসের নামে জুয়া খেলা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ছিল, আপনারা আলেমসমাজ কোনো দিন এর প্রতিবাদ করেননি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সাহায্যে প্রকাশ্যে জুয়া খেলা চলত, এগুলো বন্ধ করার কোনো আন্দোলন আপনারা করেননি; কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার কথা বারবার বলেছেন। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় জুয়া ও মদক যে হারাম ঘোষণা করতে হয়, তা আপনারা জানতেন; কিন্তু আপনারা এগুলোর বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। আমি ক্ষমতায় এসে প্রথমেই ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দিয়েছি, পুলিশকে তৎপর হতে বলেছি শহরের আনাচে-কানাচে থেকে জুয়াড়িদের আড্ডা ভেঙে দিতে। আমি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলি, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মবিরোধিতা নয়। আমি মুসলমান, আমি ইসলামকে ভালোবাসি। আপনারা আমাকে সাহায্য করুন, দেখবেন এ দেশে ইসলামবিরোধী কর্মকান্ড কখনই হবে না।’ ১৯৭৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি সংসদে বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। কিন্তু ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি- ধর্মের নামে জুয়াচুরি, শোষণ, অত্যাচার, খুন এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসা শাসকরা ইসলামকে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন। ব্যক্তিজীবনে ধর্মের ধার না ধারলেও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয় অসদুদ্দেশ্য পূরণের জন্য। খোদ রসুলে করিম (সা.)-এর আমলেও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়নি। খেলাফত আমলেও এমন অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা দেওয়া হয়নি। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা দিলেও সেনাপতি শাসকদের ব্যক্তিজীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের স্থান ছিল কি না প্রশ্ন রয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেই মদ, জুয়া আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধু সরকার। মাদরাসা বোর্ড গঠনের কৃতিত্বও বঙ্গবন্ধুর পাওনা। টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জন্য সরকারিভাবে জায়গা বরাদ্দ করা হয় বঙ্গবন্ধুর আমলে। বাংলাদেশকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্য করতে বঙ্গবন্ধুই উদ্যোগ নেন।

ধর্মের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থা ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন ধার্মিক হিসেবেই তিনি সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার উৎস ছিল পবিত্র কোরআন, মদিনা সনদ ও মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজের নির্দেশ।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর