বছর দেড় ধরে কভিডের এ সময়টাতে লকডাউনে ঘরেই থাকা হচ্ছে বেশি সময়। ফোনে অনলাইনে অফিসের কাজকর্ম তো চলছেই। তার পরও যে সময়টুকু পাওয়া যাচ্ছে কোরআন পড়ছি, ইবাদত করছি, বই পড়ছি, দিনলিপি লিখছি। এ বছর ‘করোনাকালে বহতা জীবন’ শিরোনামে বইও প্রকাশ করেছি। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামাচা’, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সে সময়টাতে মুগ্ধ হয়ে পড়ে ছিলাম বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইটি। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল যেন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠই শুনতে পাচ্ছি। সহজপাঠ্য এমন সরল সুন্দর লেখনী! পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম বঙ্গবন্ধুর কৃষিভাবনা নিয়ে। এমন করে এ দেশের কৃষক নিয়ে, কৃষি নিয়ে কে ভেবেছে কোনো দিন! ‘কৃষক যে জিনিস উৎপাদন করে তার দাম (চীনে) আমাদের দেশের মতো কম হতে পারে না। আমাদের দেশে যখন ধান পাট চাষির ঘরে থাকে, তখন দাম অল্প হয়। যখন মহাজনদের ঘরে থাকে তখন দাম বাড়তে থাকে। চাষি উৎপাদন খরচও পায় না। আর অন্যান্য জিনিস যা কৃষকের কিনতে হয়, যেমন নুন, তেল, কাপড় এগুলোর দাম এত বেশি থাকে আমাদের দেশে যে কৃষক যা উৎপাদন করে তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। কিন্তু নয়াচীনে একটা সামঞ্জস্য বিধান করেছে, কৃষক যা বিক্রি করে তার দাম দিয়ে ভালোভাবে অল্প দামে তেল, নুন, কাপড় কিনতে পারে। এতে তাদের ফসলের দাম দিয়েই সংসার চালানো সহজ হয়েছে। গরিবদের ৫ টাকায় ১ মণ পাট বিক্রি করে ৪ টাকায় ১ সের ডাল তেল কিনতে হয় না তাদের দেশে। প্রত্যেক এলাকায় সরকারি দোকান আছে সেখানে সস্তায় সমস্ত জিনিস পাওয়া যায়। কোনো দোকানদার ইচ্ছা করলেই বেশি দাম নিতে পারে না। কারণ যদি লোকে জানতে পায় যে কোনো দোকানদার বেশি দাম নিচ্ছে তখন তারা সরকারি কর্মচারীদের খবর দিয়ে নিজেরাই ধরাইয়া দেয় এবং মিটিং করে ঠিক করে ওই দোকানদারের দোকানে কেউই জিনিসপত্র কিনতে পারবে না। এতে চাষিদের যথেষ্ট উপকার হয়েছে। দেশের ভিতর গণজাগরণ এসেছে বলে এটা সম্ভবপর হয়েছে।’ সূত্র : অসমাপ্ত আত্মজীবনী।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। এরপর আর তাঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। একাধিকবার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছি বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখেছেন এমন বয়স্ক লোকজনের খোঁজে। জন্মভিটার আশপাশে বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের মুখে মুখে জাতির জনকের স্মৃতি শুনেছি। কৃষকসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে মুজিব সাধারণ মানুষ নন। যাঁরা তাঁকে নিজ চোখে দেখেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন উন্নত বিশ্বে জন্ম নিলে মুজিব হতেন সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা। কৈশোর পার করতে না করতেই কৃষক-মজুরের সংগ্রামী জীবনই যেন তাঁকে রাজনীতিতে উসকে দিয়েছিল। ছাত্রজীবনেই রাজনীতির বীজ ভালোমতো বপিত হয়েছিল তাঁর মনে, তখনই মেহনতি কৃষক -মজুরের পক্ষে শুরু হলো তাঁর অনন্য সংগ্রাম। আর জেলায় জেলায় গণসংযোগ, বক্তৃতা, মেহনতি মানুষকে জাগ্রত করার কাজে মুজিব হয়ে উঠলেন অপ্রতিদ্ব›দ্বী এক নাম। প্রিয় এক নেতা।
পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগ সরকার দাওয়ালদের ধানের নৌকা আটকাতে শুরু করল। ধান সরকারি ভান্ডরে জমা না দিলে ধান ও নৌকা বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল। শেখ মুজিব দাওয়ালদের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। জেলায় জেলায় সমাবেশ করে কৃষক-মজুরদের পক্ষে সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। যখন গোটা ভূমির মানুষই রুদ্ধ, তখন তাদের মুক্তির সোপান স্বপ্ন রচনা করতে গিয়ে বারবার অন্তরিন থাকতে হয়েছে প্রিয় নেতাকে। এ স্মৃতিও আজ এক হীরকখন্ড কারও কারও কাছে। এক প্রবীণ কৃষক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর একটি স্মৃতিকথা শুনিয়েছিলেন- পাকিস্তান আমল। ঋণের দায়ে জর্জরিত এক কৃষকের ঘরের চালাও খুলে নিয়ে যাচ্ছিল সরকারের লোকজন। খবর পেয়ে শেখ মুজিব ছুটে এলেন। শুনলেন কত টাকা ঋণ। নিজের পকেট থেকে সেই ঋণ শোধ করে দিলেন। সরকারের পেটোয়া বাহিনী চলে যাচ্ছিল। তখন পেছন থেকে তিনি ডাক দিলেন। বললেন, ‘টাকা তো শোধ হয়েছে, এবার যেসব নিয়ে যাচ্ছেন আর এলোমেলো করেছেন, সেগুলো ভদ্রলোকের মতো ঠিক করে দিয়ে যান।’বঙ্গবন্ধু বাল্যবেলা থেকেই যেখানে অনিয়ম দেখেছেন, বৈষম্য ও শোষণ দেখেছেন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তিনি শোষণহীন এক সমাজ কামনা করেছেন। গোপালগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী, সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়ে তিনি শুধু নিজের ভাগ্য আর ক্যারিয়ার গড়ার জন্য ব্যস্ত থাকেননি, মানুষ যেখানে বঞ্চিত হচ্ছে, শোষিত হচ্ছে সেই জায়গায় নিজের ভূমিকা নিয়ে হাজির হয়েছেন। ভেবেছেন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই। যে কারণে সে সময়ে তিনি প্রান্তিক কৃষক, কৃষিশ্রমিক, খেতমজুর সবার পক্ষেই কাজ করেছেন এবং সত্যি কথা বলতে, বঙ্গবন্ধু একজন বড় নেতা হয়ে ওঠার পেছনে যে নিয়ামকগুলো কাজ করেছে তার অন্যতম দিক হলো তিনি খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট বুঝেছেন। তিনি অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন, এ জাতির বঞ্চনার জায়গাটি কোথায়। তিনি নিশ্চিত হন কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি ছাড়া বাঙালি জাতির মুক্তি নেই।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করানোর পর বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতে কৃষকের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেব। আর ১০ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না। আইয়ুবি আমলে বাস্তুহারা হয়েছে বাংলার মানুষ। সরকারের খাসজমিগুলো বণ্টন করা হয়েছে ভুঁড়িওয়ালাদের কাছে। তদন্ত করে খাসজমি কেড়ে নিয়ে তা বণ্টন করা হবে বাস্তুহারাদের মধ্যে। ভবিষ্যতেও সব খাসজমি বাস্তুহারাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে এবং চর এলাকায়ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আমি কৃষক ও শ্রমিকদের কথা দিচ্ছি- আওয়ামী লীগ তাদের আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।’ বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ও আন্দোলন যেমন ছিল কৃষকজীবী মানুষের জন্য। তিনি স্বপ্নও দেখেছিলেন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির। সেভাবেই সূচনা করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কাজ। বঙ্গবন্ধু গভীর চিত্তে উপলব্ধি করেছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রয়োজন কৃষি ও কৃষকের সামগ্রিক উন্নতি। ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। খাদ্য ঘাটতি সংকুলানে বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীনতার পর দুই বছর খাদ্যে ভর্তুকি প্রদান করেছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষি সেচ সুবিধায় বেশি বিনিয়োগ ধরা হয়েছিল। ১৯৭২-৭৩ সালে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল। তার মধ্যে ১০১ কোটি টাকা শুধু কৃষি উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছিল। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে সেচে বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি ৬৬ লাখ, শস্য উৎপাদনে ৩০ কোটি ২১ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষিতে বরাদ্দ ছিল মোট এডিপির ১৩.১৪% যা সময়ের প্রেক্ষাপটে ছিল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
কৃষির উন্নয়নে কৃষি গবেষণার বিকল্প নেই- এ সত্য উপলব্ধি থেকেই ১৯৭৩ সালে কৃষিতে গবেষণা সমন্বয়ের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। ১৯৭৩ সালে ১০ নম্বর অ্যাক্টের মাধ্যমে নতুন নামে পুনর্গঠন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।
১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দান করেন। সেদিন সে আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এবং পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামছুল আলম। এক সোনালি বিকালে তাঁর বাসভবন প্রাঙ্গণে বসে সেদিনের স্মৃতি শুনেছি তাঁর মুখ থেকে। সে স্মৃতির প্রভায় তাঁর চোখমুখ যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
তিনি দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমবায়ের কথা ভেবেছিলেন। তাঁর সমবায় ভাবনা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। সে সময়ের সক্রিয় গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা এখনো সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। আমি কৃষি অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মোয়াজ্জেমের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। গত বছর করোনার আগে আগে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমবায়ের ধারণাটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ’৭৫-এর ১৬ আগস্ট জাতির জনকের সঙ্গে তাঁদের বৈঠক ছিল। তাঁরা সব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। প্রণীত পরিকল্পনা সংশোধন করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে যায়। প্রফেসর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন আমার সঙ্গে ইন্টারভিউ দিতে তাঁর কান্না ধরে রাখতে পারছিলেন না। যা হোক, আমি বলতে চাই বঙ্গবন্ধুর এ আন্তরিক প্রত্যাশাগুলোয় আমাদের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। নতুন করে এসব সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন।
জাতির জনক কৃষি, গ্রামোন্নয়ন, সমবায়সহ সব উন্নয়ন চিন্তার সফল বাস্তবায়নে গ্রহণ করেন ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ কর্মসূচি। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর আবেগময় ভাষণে দ্বিতীয় বিপ্লবের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘আর কত দিন বন্ধু রাষ্ট্রগুলো আমাদের খাদ্য আর সহায়তা দিয়ে যাবে? আমাদের অবশ্যই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবে। আমি কোনো ভিক্ষুক জাতির নেতা হতে দিতে চাই না।’
১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের চারটি উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিপ্লব হলো উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবার পরিকল্পনা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং জাতীয় ঐক্যের একমাত্র পদক্ষেপ। এর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো শোষণমুক্ত এমন একটি সমাজ গঠন করা যেখানে কোনো অত্যাচার, দমন-নিপীড়ন, অবিচার বা দুর্নীতি হবে না এবং যার উদ্দেশ্য হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদাকে ধরে রাখা।
দ্বিতীয় বিপ্লবের অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি। ৪০ বছর ধরে কৃষি ও কৃষক নিয়ে কাজ করছি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে বহুবার। একান্তে কথা বলার সুযোগও হয়েছে একাধিকবার। যতবার কথা বলেছি দেখেছি কৃষি বিষয়ে তিনি কত সচেতন, সাম্প্রতিক ও আধুনিক কৃষি বিষয়েও তাঁর গভীর চিন্তার পরিধি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নই যেন তিনি বহন করে চলেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষিতে আমাদের উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ একদিন কৃষি অর্থনীতিনির্ভর দেশ হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। কৃষি ও কৃষক নিয়ে যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন তা সফল হবে।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।