সোমবার, ১৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনুন

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনুন

‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত,/ বঙ্গবন্ধু মরে নাই।/যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো,/বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।/তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা,/আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।’

হাসান মতিউর রহমানের লেখা, মলয় কুমার গাঙ্গুলীর সুর করা এবং সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গাওয়া এ গানটি যেন শুধু একটি গান নয়, কোটি কোটি বাঙালি এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর মনের কথা। আজ থেকে ৪৬ বছর আগের এই দিনে শেষ রাতের দিকে বাঙালি জাতিকে মুক্তির আলো দেখানো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল মানুষ নামের কীট, ক্ষমতালোভী, চক্রান্তকারী কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য। ঘাতকরা ওই দিনে নিরীহ নারী ও শিশুদেরও রেহাই দেয়নি, যা ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার পর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে পুরো বাঙালি জাতি। ১৯৪৭, ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭০সহ বিভিন্ন সময়ে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু বারবার ফিরে এসেছিলেন, ১৯৭১-এ পাকিস্তানি হায়েনারা যা করতে পারেনি সে কাজটিই অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে সম্পাদন করে পাপিষ্ঠ বাঙালি ঘাতকরা। ওরা মানুষ নামের হায়েনার দল, ওরা শয়তানের প্রেতাত্মা, ওরা জঘন্য, ওরা হিংস্র জানোয়ারের দল। একদিন যে আঙুল উঁচিয়ে বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স¦াধীনতার সংগ্রাম’। ভাবতে অবাক লাগে সেই স্বাধীন দেশের মানুষই তার আঙুল চিরদিনের জন্য নিস্তেজ করে দেয়। আর কোনো দিন ওই আঙুল আমাদের প্রেরণা দিতে আসবে না, দেবে না মুক্তির বারতা।

মানুষ মরণশীল বলেই সবার মৃত্যু হয়। তবে কোনো কোনো মানুষের শুধু দেহাবসানই ঘটে, মৃত্যু হয় না। তারা থাকে মৃত্যুহীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তেমনি একজন মানুষ। তিনি মৃত্যুহীন, তিনি অমর। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ঘাতকরা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাড়িতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁকে সপরিবারে নিঃশেষ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শিশু শেখ রাসেল, সদ্যবিবাহিত পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরকে হত্যা করা হয়। মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি এবং তৎকালীন মন্ত্রী অবিসংবাদিত কৃষকনেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে, তার একমাত্র মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত এবং আত্মীয় আবদুল নঈম খান রিন্টুকে। আরেক বাসায় হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণিকে। তারা বর্তমান যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র ফজলে নূর তাপসের বাবা-মা। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণ হয়েছে শুনে সেখানে যাওয়ার জন্য রওনা দেন বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। তাঁকে ৩২ নম্বরের সামনে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ওই দিন ৩২ নম্বরের বাড়িতে কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও হত্যা করা হয়। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর বড় সন্তান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। শেখ হাসিনার স্বামী প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় বেঁচে যান শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। সেই নারকীয় হামলার পর দেখা গেছে, ভবনটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। তাঁর তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। পাশেই পড়ে ছিল তাঁর ভাঙা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমের পাশে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ। রক্তে ভেজা লাশ দেখে খুনিদের প্রতি চরম ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর ভাষা খুঁজে পান না মানবতাবাদী বিশ্বের কোনো মানুষ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পরই খন্দকার মোশতাক আহমদ যে কিন া বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিল, সে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। এবং খুনিদের বাঁচানোর জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে। এরপর দীর্ঘ ২১ বছর সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার আইনি বাধা অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে এ হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার দায়ে ১২ জন খুনির ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। অন্য ছয়জন পলাতক।

জাতির প্রত্যাশা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর যেসব খুনির এখনো ফাঁসি দেওয়া যায়নি তাদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করা হবে।

লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর