সোমবার, ১৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা

মধ্যমণিদের মধ্যে রয়েছেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, চিহ্নিত সন্ত্রাসী আর অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি আর্মি জেনারেল

প্রতিদিন ডেস্ক

দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে (চীন ছাড়া) ‘ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের কল্যাণে কাজ করছে’ ভঙ্গি দিয়ে মানবতাবাদীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের পর আত্মসাৎ করার কাহিনি ফাঁস করে দেয় এশিয়ার প্রথম ডিসইনফো ল্যাব নামক ডিজিটাল গবেষণা সংস্থা। এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হচ্ছে ভুয়া সংবাদ আর প্রচারণার ব্যাপারগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরা। এ পর্যায়ে সম্প্রতি ইসলামের নাম ব্যবহার করে যারা প্রতারণায় লিপ্ত তাদের কুকীর্তি প্রকাশ করে এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে সম্বল করে বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত এক লে. জেনারেল কী কী অনাচার করেছে তার বর্ণনা দেয়। ‘দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা’ শীর্ষক সেই প্রতিবেদন ব্যাপক আলোড়ন তোলে। বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৪ আগস্ট থেকে পর্যায়ক্রমে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করছে। আজ দ্বিতীয় কিস্তি উপস্থাপন করা হলো :

‘আমরা ইমানার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ শুরু করলাম। আমাদের আগ্রহের একক প্রধান বিষয় হলো কীভাবে কোনো সংগঠন ভারতে উপস্থিত না থেকে কিংবা স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়াই চলমান করোনাভাইরাস সংকটের সহযোদ্ধা হতে পারে।’

ইমানার অর্থ সংগ্রহের কৌশল আমাদের দৃষ্টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসমূহের দিকে নিয়ে গেল বিশেষজ্ঞ যাদের ভারতের জন্য অর্থ সংগ্রহের কার্যক্রম থাকলেও ভারতে কোনো উপস্থিতি নেই। তাদের অন্যতম পছন্দের প্ল্যাটফরম ছিল Launch Good, এটি আমাদের একটি নয় বরং অনেকটি অনুরূপ কেলেঙ্কারির উন্মোচনের দিকে নিয়ে যায়। এতে স্পষ্ট হয় কীভাবে একই জনগোষ্ঠী এবং সংস্থা তহবিল সংগ্রহের জন্য প্রতিটি সংকটকে কাজে লাগায় এবং পরিশেষে এ উদ্যোগকে শিল্পে রূপ দেয়।

লক্ষ্য করা জরুরি যে এগুলো ‘মুসলিম সংগঠন’ নয় যদিও তেমনটিই দাবি করা হয়। এগুলো প্রতারণামূলক সংগঠন যারা বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায় ও বিশ্ববাসীকে ঠকিয়ে তহবিল সংগ্রহ করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও এ সংগঠনগুলো জাকাতনির্ভর তহবিল সংগ্রহের প্রচারণা চালায়। সংগৃহীত তহবিল যদিও হঠকারী সন্ত্রাসী চক্র, স্বার্থান্বেষী পরিবার ও পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনার পেছনে ব্যয় করা হয়। এ একই জনগোষ্ঠী এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে সংযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে এ প্রতারণা কার্যক্রম চালু রাখে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে উন্নত দেশে এরা বিলাসী-জীবন যাপন করে। এসব সংগঠন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সামন্তবাদ ও স্বজনপ্রীতির সমন্বয়ের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এ প্রকৃতির একটি সংগঠনের নাম ‘মুসলিম এইড’।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ একটি বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত সবচেয়ে বড় গণহত্যার কাহিনি। সেই গণহত্যা একটি বিশেষ নিষ্ঠুরতার জন্যও কুখ্যাত ছিল যা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা স্থানীয় জনতার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল শুধু জন্ম হতে-যাওয়া নতুন রাষ্ট্রটির নেতৃত্ব বিনাশ করে দেওয়ার জন্য। এ বিষয়টি একাত্তরে বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- হিসেবেও যথেষ্ট পরিচিত। পাক বাহিনী ও তাদের দোসর উগ্র ডানপন্থি ইসলামী মিলিশিয়া গোষ্ঠী ‘আলবদর’ স্বাধীনতাপন্থি বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞে নিয়োজিত ছিল যা পরে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল।

হেনসার ফিলিপ তাঁর The war Bangladesh can never forget গ্রন্থে লিখেছেন, যুদ্ধ যখন শেষ হতে চলেছে, নতুন জাতির নেতাদের নির্মূলের উদ্দেশ্যে যতটা সম্ভব বুদ্ধিজীবী হত্যার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল।

বাংলাপিডিয়া অনুসারে শতাধিক বাঙালি বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, সাংবাদিক, ডাক্তার, শিল্পী, প্রকৌশলী এবং লেখক হত্যা করা হয়েছিল। নিহতের বেশির ভাগকেই তাদের ঢাকাস্থ বাসভবন থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা ও তাদের স্থানীয় দোসর আলবদর। চোখ বেঁধে তাদের মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগ এবং অন্যান্য নির্যাতন কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল। পরে তাদের সবাইকে হত্যা করা হয় প্রধানত রায়েরবাজার ও মিরপুরে। পরবর্তীকালে ঢাকার একটি বিশেষ আদালত ২০১৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আলবদর হত্যা স্কোয়াডের নেতা আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মইনউদ্দিনকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অপরাধীর অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে।

মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত এ দুই ব্যক্তির মধ্যে চৌধুরী মইনউদ্দিনের পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে মইনউদ্দিন একাত্তরেই পালিয়ে লন্ডন চলে যেতে সমর্থ হন। তিনি সেখানে ‘মুসলিম এইড’ নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। পরে তিনি মুসলিম এইডের চেয়ারম্যান পদে উন্নীত হন এবং প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য বনে যান। বেশ কবছর ধরে ‘মুসলিম এইড’ তার শাখা বিস্তৃত করেছে বিভিন্ন দেশে। যার মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, বসনিয়া ও সুইডেন। এসব দেশের মধ্যে অনেকেই প্রতিষ্ঠানটির ‘গোপন কর্তব্য কী’ জানত না। ওদের বদামি জানতে পারায় বাংলাদেশে মুসলিম এইডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে মদদের অভিযোগে স্পেন ও ইসরায়েলেও প্রতিষ্ঠানটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। কাজেই এটা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয় যে ‘মুসলিম এইড’ হলো একটি প্রতিষ্ঠান যা ভারতে করোনা অতিমারী মোকাবিলার অজুহাতে তহবিল সংগ্রহ করছে। এক জায়গা থেকে নয়, তারা তহবিল সংগ্রহ করছে কমপক্ষে তিনটি ফ্রন্ট- মুসলিম এইড (ইউকে), মুসলিম এইড (অস্ট্রেলিয়া) এবং মুসলিম এইড (ইউএসএ) ব্যবহার করে।

নাম : চৌধুরী মইনউদ্দিন ছিলেন ঢাকায় সাংবাদিক। তার জন্ম ২৭ নভেম্বর, ১৯৪৮। বাংলায় স্নাতকোত্তর এ লোকটি পরে হয়ে গেলেন আলবদর বাহিনীর প্রধান।

পেশা : সাংবাদিক ও আলবদর প্রধান।

একাত্তরে ১৮ জন বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল হোতা তিনি। যুক্তরাজ্যের নাগরিক হওয়ার পরও তার স্বভাব বদলায়নি। ১৯৮৯ সালে এই চৌধুরীই সালমান রুশদির একটি বইয়ের বিরুদ্ধে ইসলামী দাঙ্গার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

সর্বশেষ খবর