বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা

মধ্যমণিদের মধ্যে রয়েছেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, চিহ্নিত সন্ত্রাসী আর অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি আর্মি জেনারেল

প্রতিদিন ডেস্ক

দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে (চীন ছাড়া) ‘ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের কল্যাণে কাজ করছে’ ভঙ্গি দিয়ে মানবতাবাদীদের থেকে অর্থ সংগ্রহের পর আত্মসাৎ করার কাহিনি ফাঁস করে দেয় এশিয়ার প্রথম ডিসইনফো ল্যাব নামক ডিজিটাল গবেষণা সংস্থা। এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হচ্ছে ভুয়া সংবাদ আর প্রচারণার ব্যাপারগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরা। এ পর্যায়ে সম্প্রতি ইসলামের নাম ব্যবহার করে যারা প্রতারণায় লিপ্ত তাদের কুকীর্তি প্রকাশ করে এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে সম্বল করে বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত এক লে. জেনারেল কী কী অনাচার করেছে তার বর্ণনা দেয়। ‘দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা’ শীর্ষক সেই প্রতিবেদন ব্যাপক আলোড়ন তোলে। বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৪ আগস্ট থেকে পর্যায়ক্রমে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করছে। আজ তৃতীয় কিস্তি উপস্থাপন করা হলো-

মুসলিম এইড বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন দেশে আত্মপ্রকাশ করেছে বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডিং থাকাটা জরুরি ছিল যাতে অতীতের কর্মকান্ড তাদের তাড়া করতে না পারে। সে অনুযায়ী মুসলিম এইড ২০১৩ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত হয়। তারা একটি সোশ্যাল মিডিয়াও (ফেসবুক) পেজ চালু করে।

মুসলিম এইড তার সমমনা সংগঠন ‘ইমানা’ ও অন্যদের মতো ভারতের নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুসরণ করে। তাদের ওয়েবসাইট ও অন্যান্য প্রকাশনায় পাকিস্তানের অনুমোদিত মানচিত্র ব্যবহার করে। কিন্তু ভারত বা ভারতের পক্ষ থেকে অনুদান চাওয়ার সময় ভারত সরকারের অনুমোদিত মানচিত্র ব্যবহার করে। বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানের মানচিত্রই ব্যবহার করে, পাকিস্তানের অনুমোদিত মানচিত্র নয়। এ প্যাটার্ন শুধু প্রদর্শিত বিষয়েই সীমাবদ্ধ নয়।

তাদের সাহায্য প্রচারাভিযানের পাশাপাশি ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের নকশা চিহ্নিত করার একটি প্যাটার্ন রয়েছে যা একটি ধারণার উদ্ভব করে যে সংস্থাগুলো এক জায়গা থেকে পরিচালিত। ইমানা ও মুসলিম এইড ভারতে সক্রিয় এবং উপস্থাপিত না থেকেও এর বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে ভারতের দুর্যোগ মোকাবিলায় তহবিল সংগ্রহ করছে।

মুসলিম এইড ২০২১ সালের আগে তাদের ওয়েব পেজে ভারত বিষয়ে মাত্র তিনবার উল্লেখ করেছে। ভারতের উল্লেখ আছে ২০১৯ ও ২০২০ সালে যার সবটাই গরু কোরবানির নিয়ম শেখানো সংক্রান্ত এবং কেরালার বন্যা বিষয়ে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালে মুসলিম এইড যুক্তরাষ্ট্র একটি ফেসবুক প্রচারণায় ১৩-১৪ আগস্ট গরু কোরবানিবিষয়ক কথাবার্তা প্রচার করে। একইভাবে ২০১৮ সালে ভারতের নামে আরেকটি তহবিল সংগ্রহকারী ছিল কেরালার বন্যার সময়। অন্য ক্ষেত্রের মতোই সংস্থাটি মোট তহবিল সংগ্রহ ও ব্যবহারের কোনো বিবরণ প্রদান করেনি। এটা মনে রাখা জরুরি যে সংকটের সময় এ ফ্রন্টগুলো যেসব তহবিল তছরুপ করে তার প্রকৃত অর্থ হলো একটি সত্যনিষ্ঠ সংগঠন এটি থেকে বঞ্চিত ছিল। যা সংকটকে বাড়িয়ে তোলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আবারও ২০১৯ সালের আগস্টে মুসলিম এইড একটি তহবিল সংগ্রহ প্রচারণা চালায় মূলত কোরবানির গরুর অংশ ভাগাভাগির বিষয়ে। গরুর অংশ ভাগাভাগির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ উদ্যোগ ঘন ঘন করা হয়েছে কিন্তু এ ধরনের কোনো সাহায্য নেওয়া হয়েছিল কি না তা প্রকাশ না করেই। স্মরণযোগ্য যে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ এবং প্রচারণার পোস্টারটি সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের প্রতি উসকানিমূলক।

ইন্ডিয়া প্রধান শব্দ ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রস্থ মুসলিম এইডের একটি টুইট টাইমলাইন প্লটে দেখা যায় ২ জুলাই, ২০২০-এর একটি পোস্ট ছাড়া টুইট অঙ্গনে ভারতের টুইট শূন্য ছিল। এখানে প্রাপ্ত প্রায় সব টুইটেই ছিল পাকিস্তানের ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়া। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ভারত সম্পর্কে মার্কিনভিত্তিক দাতব্য সংস্থার সামাজিক মাধ্যম পোস্ট শুধু পাকিস্তানি ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ পায়। এটা তো হওয়ার নয়, যদি না পাকিস্তান থেকে এ প্রচেষ্টা চালানো হয়।

‘ইন্ডিয়া’ কথাটি ব্যবহার করে ২০১৮ জানুয়ারি ৮ থেকে ২০২১ সালের ২৬ জুন পর্যন্ত করা টুইটের একটি টাইমলাইন উপস্থাপনা। সেখানে মোট ৪০টি টুইট ছিল যার মধ্যে ১৩টি মুসলিম এইড ইউকে এবং বাকিগুলো ছিল মুসলিম এইড ইউএসএ থেকে। অন্য কোনো চ্যাপ্টার থেকে ইন্ডিয়া কিওয়ার্ড ব্যবহার করে কোনো টুইট করা হয়নি। প্রথম টুইট করা হয় ১ মে, ২০২১ যাতে বলা হয়েছিল ভারতে কভিড-১৯ জরুরি অবস্থা। যদিও এবার মুসলিম এইড কভিড-১৯ জরুরি অবস্থার ১২টি টুইট করেছিল মে ১ থেকে জুন ১৩, ২০২১ পর্যন্ত।

মজার ব্যাপার! ভারত কভিড-১৯ সংকটের মধ্যে পড়েছিল ২০২০ সালে, মুসলিম এইডের কোনো চ্যাপ্টার থেকে ভারতে সাহায্যের জন্য সে সময় কোনো টুইট করা হয়নি। মুসলিম এইড ইউএসএ থেকে ২০২০ সালে টুইট করা হয় ২০ জুলাই কোরবানির ঈদ উপলক্ষে অনুদান চেয়ে। যখনই তারা সংকটের অজুহাতে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় তখনই কভিড-১৯ সম্পর্কে টুইট প্রচারিত হয়। এ ব্যাপারে প্রথম টুইট আসে ১ মে, ২০২১ সালে মূলত ভারতের ভ্রাতৃপ্রতিম পীড়িত মানুষের সেবায় এবং চিকিৎসার তহবিল চেয়ে। মে ১ থেকে জুন ১৩, ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা ‘হেল্পিং ইন্ডিয়ান ব্রাদার্স’ প্রচার চালায় ১২ বার। যদিও তাদের ১৪ জুন তারিখের টুইট ছিল কেবল অনুদান সংগ্রহের ব্যাপারে।

এটা অনুমান করা জটিল নয় যে ইমানা কর্তৃক ভারতের কভিড-১৯ সংকটের নামে তহবিল সংগ্রহের সফলতায় সমমনা অন্য সংগঠনগুলো আপাতত চুপচাপ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেহেতু ইমানা এরই মধ্যে নিশ্চুপ থাকার কারণ ইমানার সাফল্য দেখে তুষ্ট নতুন নতুন সংস্থাগুলোও ডলারসমৃদ্ধ তহবিল আনার জন্য কিছু কিছু কৌশলের পরিবর্তন আনবে।

সর্বশেষ খবর