বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

আহলে বাইতের মর্যাদা

এম এ মান্নান

আহলে বাইতের মর্যাদা

প্রতিটি মুসলমান যখন প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ আদায় করেন তখন যে দরুদ শরিফ পাঠ করেন তাতে আল্লাহর কাছে রসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর বংশধর অর্থাৎ আহলে বাইতের জন্য দোজাহানের শান্তি ও রহমত কামনা করা হয়। নামাজ হলো অবশ্য পালনীয় এক ইবাদত। সক্ষম অবস্থায় যা থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ নেই। সেই নামাজে মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধরদের প্রতি আল্লাহর কাছে শান্তি ও রহমত কামনা তাদের বিশেষ মর্যাদাই নির্দেশ করে। পবিত্র কোরআনে আহলে বাইতদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘হে (রসুলের) আহলে বাইত। নিশ্চয় মহান আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে সব অপবিত্রতা ও পাপ-পঙ্কিলতা দূর করতে এবং তোমাদের পূর্ণ রূপে পবিত্র করতে (সুরা আহজাব-৩৩)।

অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আল্লাহ তাঁর ইমানদার ও সৎকর্মশীল বান্দাদের জান্নাতের এই সুসংবাদই দিয়ে থাকেন। হে আমার হাবিব (সা.) আপনি বলুন, আমি তোমাদের আল্লাহর পথে ডাকার জন্য তোমাদের কাছে নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালো ব্যবহার ছাড়া কোনো প্রতিদান চাই না। কেউ কোনো ভালো কাজ করলে আমি তার জন্য তাতে কল্যাণ বাড়িয়ে দেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, প্রতিদান দানকারী (সুরা শুরা : ২৩)।

ইমাম শাফি (রহ.) আহলে বাইতের দিকে লক্ষ্য করে শ্রদ্ধা ভরে বলেছেন, ‘হে রসুলুল্লাহ আহলে বাইত তোমাদের ভালোবাসা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ এবং তা তিনি পবিত্র কোরআনে অবতীর্ণ করেছেন তোমাদের গর্বের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট, যে ব্যক্তি তোমাদের ওপর দরুদ পড়বে না তার নামাজই হবে না।’ (দিওয়ান)।

ইমাম শাফি (রহ.)-এর বক্তব্যে দুটি বিষয় লক্ষণীয়- প্রথমত, তিনি বলছেন আহলে বাইতকে ভালোবাসা আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন কোরআন শরিফের আয়াত নাজিল করে। দ্বিতীয়ত, আহলে বাইতের মর্যাদার গর্ব করার জন্য তিনি বলেছেন, তাদের ওপর সালাত পাঠ করাই যথেষ্ট, কেননা তাদের ওপর সালাত পাঠ না করলে নামাজ পরিপূর্ণ হয় না। যেমন- আমরা নামাজের শেষ বৈঠকে যখন দরুদ শরিফ পাঠ করি, তখন বলি- আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ এখানে আলি মুহাম্মদ অর্থ হলো মুহাম্মাদ (সা.)-এর পরিবারবর্গ। এবং এ দুরুদ ছাড়া নামাজের পূর্ণতা আসে না।

এখানে উল্লেখ্য, যারা আহলে বাইতের গুরুত্ব উপেক্ষা করেন তারা এ আয়াতের তাফসিরে বুখারি শরিফের একটি হাদিস দিয়ে বলেন যে, এখানে কুরাইশদের কথা বলা হয়েছে। হাদিসটি হচ্ছে- হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা তাকে ইল্লাল মাওয়াদ্দাতা ফিল ক্কুরবা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর (কাছে উপস্থিত) হজরত সাইদ ইবনে যুবায়ের (রা.) বললেন, এর অর্থ নবী পরিবারের আত্মীয়তার বন্ধন। (এ কথা শুনে) হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, আপনি তাড়াহুড়া করে ফেললেন। কেননা কুরাইশের এমন কোনো শাখা ছিল না যেখানে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর আত্মীয়তা ছিল না। রসুলুল্লাহ (সা.) তাদের বলেছেন, আমার এবং তোমাদের মাঝে যে আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে তার ভিত্তিতে তোমরা আমার সঙ্গে আত্মীয়সুলভ আচরণ কর। এ আমি তোমাদের থেকে কামনা করি।

আসলে দুটি হাদিসের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই, যেহেতু আহলে বাইতের সদস্যরা কুরাইশ বংশের মানুষ। সুতরাং দুই হাদিসকে আমরা মেনে আহলে বাইতকে ভালোবাসতে কোনো বাধা নেই।

সালমান ফার্সি (রা.)-এর কাছ থেকে বর্ণিত। মহানবী (সা.) বলেছেন- হাসান ও হোসাইন আমার দুই পুত্র (নাতি)। যে তাদের ভালোবাসে সে আমাকেই ভালোবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে মহান আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। আর যাকে মহান আল্লাহ ভালোবাসেন তাকে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে তাদের ঘৃণা করে সে আমাকেই ঘৃণা করে, আর যে আমাকে ঘৃণা করে মহান আল্লাহ তাকে ঘৃণা করেন। আর যাকে মহান আল্লাহ ঘৃণা করেন তাকে তিনি জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন (আলামুল ওয়ারা)।

জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : “রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে গেলাম, যা তোমরা মজবুতভাবে ধারণ (অনুসরণ) করলে আমার পর কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তার একটি অপরটির চাইতে অধিক মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ : আল্লাহর কিতাব যা আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত প্রসারিত এবং আমার ইতরাৎ (বংশধর ও সন্তান) আমার আহলে বাইত। এ দুটি কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না হাউসে কাওসারে আমার কাছে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত। অতএব, তোমরা লক্ষ্য কর আমার পরে এতদুভয়ের সঙ্গে তোমরা কীরূপ আচরণ কর।’ (তিরমিজি)।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) ‘ফাজায়েলুস সাহাবা’ গ্রন্থে আমেরের সূত্রে বর্ণনা করেছেন, উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হলে সাহাবাগণ মহানবী (সা.)-কে বললেন : আপনার নিকটাত্মীয় কারা।

যাদের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা আমাদের ওপর ওয়াজিব করা হয়েছে?’ মহানবী (সা.) তাদের বললেন : আলি, ফাতেমা এবং তাদের দুই পুত্র। এ কথা তিনি তিনবার বললেন। 

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, যখন এ আয়াত নাজিল হলো তখন সাহাবারা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ (সা.) কারা আপনার নিকটাত্মীয়? যাদের মুয়াদ্দাত (আনুগত্যপূর্ণ ভালোবাসা) পবিত্র কোরআনে উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়েছে। উত্তরে রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হজরত আলী (রা.), হজরত ফাতেমা (রা.), হজরত হাসান (রা.) ও হোসাইন (রা.)-এর মুয়াদ্দাত (আনুগত্য)। (জুরকানি আলাল মাওয়াহিব, দুররে মানসুর, সাওয়ায়িকে মুহরিকা, আশরাফ আলী থানভি (রহ.) লেখা কোরআন শরিফ, তাফসিরে মাজহারি, তাফসিরে নুরুল কোরআন ও মাদারেজুন নবুয়াতসহ আরও বহু কিতাবে এসেছে)।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর