রবিবার, ২২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

পাচার রোধে চাই নারীর নিজের লড়াই

খায়রুল কবীর খোকন

পাচার রোধে চাই নারীর নিজের লড়াই

নারী পাচারের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী কাহিনিটি চলচ্চিত্র হয়েছে ১৯৮১ সালে, ভারতের প্রখ্যাত পরিচালক মুজাফফর আলীর হাতে। ‘উমরাও জান’ সেই ছায়াছবির নাম। এ চলচ্চিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে রেখা (পুরো নাম-ভানুরেখা গণেশন) এক দুর্দান্ত অভিনয়শিল্পীতে পরিণত হয়েছিলেন এবং তিনি অবধারিতভাবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী নির্বাচিত হন। সে চলচ্চিত্রটি বাণিজ্যিকভাবে ‘সুপারহিট’ তো হয়েছিলই, এমন ‘মুম্বাই-মার্কা’ সাধারণ ‘বাণিজ্যিক মসলাদার’ ফিল্ম না হওয়া সত্ত্বেও।

মির্জা হাদি রুসওয়া রচিত উর্দু উপন্যাস (১৮৯৯ সালে প্রকাশিত) ‘উমরাও জান আদা’র কাহিনি অবলম্বনে মুজাফফর আলীর মতো দক্ষ চলচ্চিত্রকার নির্মিত ফিল্মটির সেই দৃশ্যগুলো যে কোনো উদারচিত্ত মানবিক দর্শকের হৃদয় ভেঙেচুরে খানখান করে দিতে পারে। (উপন্যাসকার মির্জা হাদি বলেছিলেন এটি এক সত্য কাহিনি থেকে লেখা)। নায়িকা কিশোরী আমিরান ব্রিটিশ-ভারতের ফয়েজাবাদ এলাকার বাড়ির কাছ থেকে অপহৃত হওয়ার পর লখনৌর বাইজিপাড়ায় বিক্রি হয়ে রূপান্তরিত হন উমরাও জানে। নিম্নমধ্যবিত্ত ভদ্র পরিবারের কিশোরী মেয়েটি অপহৃত হয়েছিলেন তার পিতার বয়সী এক ইবলিশ পুরুষের দ্বারা। উমরাও জান (প্রকৃত নাম ‘আমিরান’) সেখানে আটকে পড়ে নৃত্যশিল্পী (এবং সংগীত রচয়িতা ও কণ্ঠশিল্পী)তে রূপান্তরিত হন, তার পেশাদারি নাম ছিল ‘বাইজি’। অনেক বছর ধরে প্রচন্ড লড়াই করতে করতে আমিরান (উমরাও জান) অনেক কষ্টে লখনৌর বাইজিবাড়ি থেকে পালিয়ে একবার তার পিতৃ পরিবারের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন, কিন্তু তার আশ্রয় মেলেনি, সবাই তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। উমরাও জানের সেই কাহিনিচিত্র দেখে অনেক অনুভূতিপ্রবণ দর্শকেরই বুক ফেটে কান্না ঝরেছে। আমি অনেক বোদ্ধা, চলচ্চিত্র স্টাডি করা বিদগ্ধ ব্যক্তির কাছেও শুনেছি- ওই ছবি দেখতে গিয়ে তাদের হৃৎকম্প শুরু হয়ে যায়। অসহনীয় বেদনা তাদের গ্রাস করে নেয় আমিরানের (উমরাও জান) পাচার হয়ে যাওয়ার পর প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘বাইজি’ পেশায় নিজের জীবনমান সবকিছু বিলিয়ে দেওয়ার ঘটনায়।

কথা হচ্ছিল নারী পাচারের মর্মন্তুদ পরিণতি নিয়ে। শত শত বছর ধরে নারী সারা দুনিয়ায় এক প্রথম শ্রেণির পণ্য- বিক্রিতে কোনো সমস্যাই নেই। শত শত কেন, হাজার হাজার বছর ধরেই তো বলা চলে। এমনকি মানবসভ্যতার প্রারম্ভিককাল থেকে ধরে বললেও তো ভুল কিছু বলা হবে না। পুরুষ তাদের যৌন বিকৃতাচার চরিতার্থ করার জন্য সব সময়ই নারীকে ইচ্ছামতো পণ্য হিসেবে বেচাকেনা করতে চেয়েছে। নারীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের ওপর পুরুষের বিকৃতাচার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সর্বদা। তাই তো নারী এখনো সবচেয়ে দামি পণ্য বিশ্ব মানব পাচারের বাজারে। কম বয়সী পুরুষরাও পাচার হয়, তবে তাদের শ্রমদাস হিসেবে যে দামে বেচা যায়, নারীকে যৌনদাসী বানিয়ে বাজারে বিক্রিতে মাফিয়া গোষ্ঠীর লাভ তার তুলনায় অনেক গুণ বেশি।

সাম্প্রতিককালে ভারতে নারী পাচারের এক মারাত্মক ঘটনা প্রকাশিত হয়ে পড়ার ফলে দেশে এখন নারী পাচারবিরোধী বেশ তৎপরতা চলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্যোগে। ঢাকার ও দেশের অন্যসব এলাকার বেশ কিছু তরুণী এক (বা একাধিক) ‘টিকটক’ বাটপাড়ের পাল্লায় পড়ে ভারতে পাচার হয়ে অনেক কৌশল করে দেশে ফিরতে সক্ষম হয়। ইতিমধ্যে তাদের কেউ কেউ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। প্রায় কৈশোর-উত্তীর্ণ তরুণী এসব নারী নিজেদের বেকুবপনায় তথাকথিত ‘টিকটক’ প্রোগ্রামে কাজ লাভে আকৃষ্ট হয়ে ওই ইবলিশ তরুণদের পাল্লায় পড়েছিল। ওই তরুণরা আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী মাফিয়া চক্রের এজেন্টরূপে কাজ করছে কম শ্রমে বেশি উপার্জনের লালসায় পড়ে। তাদের পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যরা মদদদান করেছে এমনটাই প্রমাণ পাওয়া যায়। সেটাই চিরন্তন সত্য।

তারপর বেরিয়ে এসেছে নারী পাচারের ভয়ংকর ঘটনাগুলো। এসব পাচারকর্ম অবশ্য সাড়ে চার দশক ধরেই চলে আসছিল। তবে কখনো কখনো দুই দেশের (বাংলাদেশ ও ভারতের) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা একটু বাড়ে, হয়তো বিশেষ কোনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কিছু সৎ বা আধা সৎ মন্ত্রী বা দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের কৃপায়। হয়তো তারা সাময়িকভাবে হলেও কিছু একটা ‘ভালো কাজ’ প্রদর্শন করতে ভালোবাসেন। তখন নারী পাচার কিছুটা কমে বা কিছু পাচারকারী ধরা পড়ে।

এরই মধ্যে মাসখানেক আগে একটি জাতীয় বাংলা দৈনিক পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে- সীমান্তের এপার-ওপার নারী পাচারকারী চক্রের প্রায় ৫০টি ‘সেফ হোম’ রয়েছে। এসব ‘সেফ হোম’ নারীদের পাচারে বিশেষভাবে সহায়তাদান করে পাচারকারী চক্রকে এবং তাদের এজেন্টদের। এখন প্রশ্ন হলো, সীমান্তের এপার আর ওপারে স্থানীয় প্রশাসন আছে, পুলিশ আছে, পুলিশের গোয়েন্দা শাখার লোকজন আছেন। সর্বোপরি এপারে বর্ডার গার্ড বালাদেশ (বিজিবি) আর ওপারে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। এ দুই বাহিনীরই নিজস্ব গোয়েন্দা শাখার লোকজন তৎপর সদা। তারা সীমান্তের সংলগ্ন থানা বা উপজেলার সব এলাকার প্রতিটি বাড়ি অবধি চেনে। তাদের কাছে রয়েছে এলাকার মানচিত্র, যাতে প্রতিটি বাড়ি খুঁজে বের করা সম্ভব। সেসব বাড়িতে কে কে কখন কখন আসা-যাওয়া করে তার বিস্তারিত রিপোর্ট থাকে উভয় বাহিনীর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে; সেই অফিসে নিয়মিত রিপোর্ট জমা দেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা, উভয় রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষীদেরই এসব রুটিন কাজ। তাদের চোখ এড়িয়ে একজন মানুষ (সে নারী-পুরুষ যা-ই হোক না কেন) তো দূরের কথা, একটি গরু বা ছাগলও পার করা সোজা নয়। তাহলে এসব ‘পাচারকারী সেফ হোম’ কীভাবে ওই নারী পাচারের দস্যুদের জন্য ‘সেফ হোম’ থাকে? এত বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার লোকজন, নিয়মিত টহলের সদস্যদের নজর এড়িয়ে কীভাবে নারী পাচার চলে? কীভাবে বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার নারী বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে প্রথমে ভারতে চলে যায়? ওই পাচারকৃত নারীদের একটা অংশকে ভারতের বিভিন্ন নগরীর পতিতালয়ে বিক্রি করা হয় এবং বাকি নারীদের পাকিস্তানে পাচার করা হয়। সেখানেও এ নারীদের একটা অংশ বিভিন্ন শহরের পতিতালয়ে বেচাকেনা চলে। আবার একটা অংশকে মধ্যপ্রাচ্যে আরও চড়া দামে বিক্রির জন্য পাচার করা হয়।

ঢাকার একশ্রেণির জনশক্তি রপ্তানিকারক এ চক্রের এ-দেশি মাফিয়া হোতা, ভারতে আছে আরেক গোষ্ঠী মাফিয়া হোতা, একইভাবে পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যেও রয়েছে মফিয়া চক্র। এ মাফিয়া গোষ্ঠীগুলোর রয়েছে নিজস্ব এজেন্ট বাহিনী। তারা পাচারের কাজে বাহক হিসেবে কাজ করে। প্রতিটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহায়তা ছাড়া এ মাফিয়া গোষ্ঠীগুলো এবং তাদের এজেন্টরা কোনো তৎপরতাই চালাতে পারে না। প্রতিটি রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং ভিতরকার নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খুবই শক্তিশালী। তাদের নজর এড়িয়ে এসব মাফিয়া চক্র ও তাদের এজেন্টরা কোনোভাবেই তৎপরতা চালাতে পারবে না এটা ওয়াকিবহালদের সবারই জানা।

এখন নারী পাচার ঠেকানোর উপায়টা কী? প্রতিটি নারীকে সে কিশোরী বা তরুণী যে-ই হোক না কেন তার নিজের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কারও আশ্বাসে লোভে পড়া চলবে না। একজন কিশোরীও মোটামুটি বুঝতে পারে, পারতে হবে তার প্রধান শত্রু তার নিজের শরীর। ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’- মানে হরিণ তার নিজের সুস্বাদু মাংসের কারণেই শিকারির আকর্ষণে আসে, তার নিজ মাংসই তার বড় শত্রু। নারীও তাই, দুষ্ট পুরুষের যৌন লালসার কারণে নারীকে পণ্য বানিয়ে বেচাকেনা করতে চায়। এটা নারীকে, মানে প্রত্যেক তরুণী ও কিশোরীকে উপলব্ধি করতে হবে। সবার আগে এটা বুঝতে হবে প্রত্যেক বাবা-মাকে, কন্যাশিশুর অভিভাবককে। তাই তার নিরাপত্তার ব্যাপারে অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করবেন তার মা-বাবা, বড় ভাই-ভাবী, চাচা-চাচি, মামা-মামি মানে প্রকৃত অভিভাবক।

সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বর্তায় রাষ্ট্রের ওপর। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে তার প্রতিটি নাগরিকের সব ধরনের নিরাপত্তাবিধান। মানে তার ভিতরে পাচারের চক্রের হাত থেকে রক্ষা করাও বোঝায়। কিন্তু এ কাজা করবে যে আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই বাহিনীর ভিতরেই রয়েছে অসাধু লোকজন, তাদের অর্থলোভের কারণে পাচারকারীরা সহযোগিতা পায় তা তো ‘ওপেন সিক্রেট’। আর আছে সমাজ-সংগঠনগুলোর দায়দায়িত্ব যারা এসব অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। স্রেফ তরুণরা বিশেষভাবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি নিজ নিজ গ্রামে, মহল্লায় ছোট ছোট ‘টিম’ করে পাহারা বসায় তাহলে পাচারকারীদের এজেন্টকে ধরতে পারবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার ওপরে তারা এলাকার কিশোরী, তরুণী, যুবা-নারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে, যাতে পাচারকারী চক্র সম্পর্কে সচেতন হয়, তাদের ফাঁদে পা না দেয়।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।  

সর্বশেষ খবর