সোমবার, ২৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রথম যখন

হোসেন আবদুল মান্নান

৩১ ডিসেম্বর ১৯৮৯। দিনটা কেমন ছিল, হুবহু স্মৃতি থেকে তুলে ধরা সহজ কাজ নয়। তবুও স্মরণ করার শক্তিই যদি মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হয় তবে রোমন্থন করতে ক্ষতি কী? মানুষ এমনিতেই অতীতমুখী এবং অতীত বন্দনার সুগায়ক।

জ্ঞানীরা বলেন, অতীতই তোমাকে ভবিষ্যতের সিঁড়ি রচনা করে দিবে। উইনস্টন চার্চিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও দুর্দান্ত বাগ্মী হিসেবে আজও বিশ্বালোচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নে তাঁর বক্তৃতা ‘We shall fight on the beaches’ তো এখনো সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর স্মৃতি শক্তিরও অনেক জনশ্রুতি আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি যতদূর পিছনে তাকাবে, ততদূর সামনে দেখতে পাবে’। আর একজন ভালো বক্তা মানে একজন অসাধারণ স্মৃতিধর মানুষ। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তো এর উৎকৃষ্ট নজির।

এ লেখাটির শিরোনাম ধার করেছি একজন বিখ্যাত বাঙালি লেখক শ্রী পান্থের কাছ থেকে। জন্মসূত্রে তিনি ময়মনসিংহের মানুষ ছিলেন। জীবন কাটে কলকাতায়। তার প্রশংসিত বই ‘পড়ার বইয়ের বাইরে পড়া’র একটি প্রবন্ধের নাম ‘প্রথম যখন’।

খুব ভোরে উঠে বসে আছি। বাইরে প্রচন্ড শীত। অস্পষ্ট কুয়াশাচ্ছন্ন সূর্যোদয়। রিকশা বা বাসস্ট্যান্ড কোন দিকে ঠিক বুঝে নিতে পারছিলাম না। অন্যদিকে আমার মধ্যে খানিকটা উত্তেজনা ও উদ্দীপনা কাজ করছিল। নতুন জায়গা, নতুন চাকরি, নতুন জীবন। বলা যায়, একদম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রভাষক বন্ধুর অনুকম্পায় তার সঙ্গে ‘জুবেরী হাউস’ নামে পরিচিত শিক্ষক কোয়ার্টারে রাত যাপন করেছিলাম। মতিহার ক্যাম্পাসে ‘জুবেরী ভবন’ সবাই চেনে। তাকে পেয়ে মনে হচ্ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল থেকে সরাসরি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আসা। কারণ আমার হলের বন্ধুটি মাত্র কিছুদিন হলো এখানকার মার্কেটিং বিভাগে যোগদান করেন।

কুয়াশা ভেদ করে সামনে এগিয়ে গিয়ে একটি রিকশা পেয়ে যাই।

বিনাবাক্যেই চড়ে বসি।

বললাম, ভাই আমাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে চলুন।

সে বলে, এখান থেকে অনেক দূরে বাসস্ট্যান্ড।

আমি বললাম, চলুন, ভাড়া যা দেব, ঠিক আছে।

আমি তেমন কিছু চিনি না। পুরো আত্মবিশ্বাসের ওপর যাত্রা। বিশ গজ দূরেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হাড়-কাঁপা শৈত্যপ্রবাহের মতো। তখনকার দিনে শীত বলতে নর্থ বেঙ্গলকেই সবাই জানত। হাত-পা পাথর। সব মিলিয়ে ৪০ মিনিটের মতো সময় গেল। লোকাল বাস বেশ কটি দাঁড়িয়ে। তবে যাত্রী কোথায়? কার দায় পড়েছে আমার মতো এত সকালে ঘরছাড়া হতে? সিট পূর্ণ হবে তবে চাকা ঘুরবে। হাতে একখানা ব্রিফকেস নিয়ে দুই পায়ের ওপর হয়ে অপেক্ষমাণ আমি। বেলা বাড়ছে, মানুষ আসছে। ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি চলছে। উঠে বসলাম, সিটও পেলাম।

শহর ছাড়তেই রাস্তার বেহাল দশায় নিমিষেই মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। বাসের গতি ২০ কিমি বেশি হবে না। প্রায় ৭০ কিমি পথ, গোটা রাস্তাজুড়ে খানাখন্দের বিড়ম্ব^না। গরু-মহিষের গাড়ির দীর্ঘ মিছিল। সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য এদের নৈমিত্তিক জীবনযাপনের মধ্যে লক্ষ্য করার মতো। রাস্তার দুই পাশ বৃক্ষহীন, ছায়াহীন। অনেকটা বিরান বরেন্দ্রভূমি। যেতে যেতে চোখের কোণে জমে উঠেছিল অশ্রুবিন্দু।

পথ যেন শেষ হতে চায় না। সহযাত্রী কাউকে জিজ্ঞেস করলে, চাঁপাই আর কতদূর? অবলীলায় বলে দেয়, এই যে চলে এলাম। এদিকে আমার কোমরের হাড় নড়ে ওঠার উপক্রম। পুরো সাড়ে চার ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর যুদ্ধের পর গন্তব্যের সন্ধান পেয়ে আহা! কী আনন্দ, আকাশে বাতাসে। মাটিতে পা স্পর্শ করেই বললাম, রক্ষা কর প্রভু।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে তখনো সার্কিট হাউস হয়নি। গেস্টরুম বলতে বিভিন্ন বিভাগের গোটা তিনেক ডাকবাংলো। দু-চারটি কক্ষ নিয়ে গঠিত। সরকারি কোনো সিনিয়র কর্তাব্যক্তি এলে এতে থাকতে পারেন। তেমনি একটি ছোট্ট রেস্ট হাউসে আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। এতেই আমি সীমাহীন খুশি। তবে শীতের প্রকোপ যেন বেড়েই চলেছে, কারণ এটি তখন এক বালুময় সীমান্তবর্তী এলাকা। ঠান্ডা হিমেল হাওয়ায় অপরাহ্ণের আলোতেই জমে যাওয়ার মতো অবস্থা আমার।

আগামীকাল ১ জানুয়ারি। খ্রিস্টীয় নববর্ষ ১৯৯০। সকালেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিতে যোগ দিতে যাচ্ছি। কাজ কী হবে, কী কী করণীয়? শত কোটি ভাবনা যেন ভিড় করে আছে আমাকে ঘিরে। ভবিষ্যতের কত স্বপ্ন-মধুর বাসনা জেগে আছে হৃদয়ের গহিন-ভিতর।

অনেক পথ পাড়ি দিয়ে, অনেক দেখা, অনেক পাওয়া-না পাওয়ার কল্পনার রথে চড়ে আজও নিরন্তর বেরিয়ে চলেছি এই আমি। তবুও বেঁচে থাকার আনন্দ-বেদনার কোনো তুলনা হয় না। কেননা, এ পৃথিবী শেষ পর্যন্ত শুধু মানুষের।

১ জানুয়ারি ১৯৯০ সাল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একতলা রেস্ট হাউসে রাতযাপন করি। সকাল সকালই ঘুম ভেঙে যায়। তাপমাত্রা হিসাব করে দেখার কোনো অভিজ্ঞতা তখনো হয়নি। তবে দেশের শ্রীমঙ্গলের কাছাকাছি শীত হবে। আগের দিনের মতনই খানিকটা কুয়াশার শুভ্র জালে ঝাপসা হয়ে আছে ডাকবাংলোর চারদিক। মনে হলো, খুব কষ্ট করে সূর্য উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাইরে তাকিয়ে ঈষৎ বিস্মিত হই। কেবল আম গাছের ছড়াছড়ি। মাটির শুষ্কতা ও রুক্ষতা নজরে পড়ে। এদিকে গতকালই আরও দুজন ব্যাচমেট যথাক্রমে শৈলেন্দ্র মন্ডল এবং মোস্তাফিজ এসে পৌঁছে যায়। প্রথম দিন আমরা এ ত্রিরত্ন একই বাংলোয় তবে পৃথক কক্ষে রাত কাটাই। তিন নবাগত আজ পূর্বাহ্ণে একই সময়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে যোগদান করব। প্রথম দিনের অফিস। তখনো গায়ে ছাত্রত্বের গন্ধ লেগে আছে। রওনা হওয়ার প্রাক্কালে আনন্দ ও সংশয়ভরা মনে যেন নির্ভুল এক প্রস্তুতি চলছে। কেমন পোশাক হবে? হাতে কী থাকবে? কার কাছে প্রথম সাক্ষাৎ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আজ বছরের প্রথম দিন। অফিস সময়ের একেবারে সঠিক প্রহরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এসে পৌঁছি। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজে ঘেরা বিস্তীর্ণ আম্রকানন। মুকুলিত সময়ের অপেক্ষায় সারি সারি আমগাছ দাঁড়িয়ে। জেনে নিলাম, দোতলায় এনডিসি ও এডিসিদের কক্ষ। প্রাথমিক পরামর্শ নিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সা.) এর কক্ষে প্রবেশ করি। অমায়িক, বন্ধুবাৎসল ভাষায় তিনি আমাদের স্বাগত জানান। বললেন, তোমাদের প্রতীক্ষায় আছি। সেখানে তখন তিনজন এডিসি যথাক্রমে হানিফ উদ্দিন সরকার, এরশাদ খান এবং নিকুঞ্জবিহারি নাথ। সৌভাগ্য যে, তিনজনকেই একসঙ্গে পেয়ে যাই। আলাপ পরিচয়পর্ব শেষে আমাদের সঙ্গে নিয়ে এডিসি (সা.) জেলা প্রশাসকের অফিস রুমে যান। নাম-ধাম, জেলা, শিক্ষা, বিষয়ে যৎসামান্য আলোচনা করেই জেলা প্রশাসক সাজ্জাদ হোসেন নির্দেশ দিলেন, ‘আগামীকাল এদের মধ্য থেকে যে কোনো দুজনকে রহনপুর উপজেলায় পাঠানো হোক। তারা সেখানে থেকে ওসি, এলএসডির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অনুযায়ী গোডাউনে রক্ষিত সমস্ত চাল সরেজমিন পুনঃপরিমাপের কাজ করবে। যতদিন প্রয়োজন তাদের সেখানে থাকতে হবে। আবাসন ও খাবার-দাবারের সব এন্তেজাম ইতিমধ্যেই করে রেখেছি। আশা করি কোনো সমস্যা হবে না।’ উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, তখনকার জেলা প্রশাসক ও তিনজন এডিসি সবাই ‘৭৩ ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা ছিলেন। আমরা খানিকটা শঙ্কিতবোধ করছিলাম। এখানকার কিছুই দেখিনি, বুঝিনি, কী হবে- আবার কোন দুজনকে যেতে হবে? কাউকে বলা বা বোঝার কোনো অবকাশ নেই। অনেকটা লটারির ফলাফলের মতন। তিনজনের মধ্যে দুজন যাবে। ঘণ্টা দেড়েক যেতেই সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, আমি এবং মোস্তাফিজ যাব এবং সকালে গাড়ি প্রস্তুত থাকবে।

চাকরির দ্বিতীয় দিন। জেলা শহর থেকে ৩৫ কিমি উত্তর-পূর্ব দিকে রহনপুর উপজেলা। দক্ষিণে ইলামিত্রের নাচোল, পূর্বে নওগাঁর পোরশা উপজেলা, উত্তর-পশ্চিমে গোমস্তাপুর, ভোলাহাট ও ভারতের মালদা জেলার সিঙ্গাবাদ রেলস্টেশন। বরেন্দ্র এলাকা, আশপাশে মাটির ঘরের সারি। গরু-মহিষের গাড়ি ধীরগতিতে সর্বত্র হাঁটছে। সীমান্তবর্তী জনপদ, মানুষ মূলত ব্যবসানির্ভর। অভাব-অনটন কমই ছিল বলে স্পষ্ট মনে পড়ে। গাড়িতে ঘণ্টাখানিক লেগেছিল, রাস্তা মোটামুটি চলাচল মানের। স্থানীয় জেলা পরিষদের বাংলোয় দুজনের থাকার সাময়িক ঠিকানা হলো। বিকালেই হেঁটে গোডাউন দেখতে বের হই। ঘুরে ফিরে দেখলাম, কাছেই রেলস্টেশন, পুনর্ভবা নদী, রেলসেতু, বিরাট হাট ইত্যাদি। বাইসাইকেল, হোন্ডাওয়ালারা বেশ বিত্তবান ব্যবসায়ী। দুয়েক দিনের মধ্যেই জানলাম রহনপুরে দুজন মুসা আছেন। একজন মুসা মার্সেন্ট অপরজন মুসা সরকার। উভয়ই যথেষ্ট বিত্তশালী। এঁদের পেশা ব্যবসা।

আমাদের খাওয়া দাওয়া চলবে জনৈক ধনবান ব্যবসায়ী মুসা মার্সেন্টের বাড়িতে। তাঁর বাড়ি স্টেশনপাড়ায়। এ সিদ্ধান্ত জেলা প্রশাসক মহোদয়ের। জানা যায়, ১৯৭৪ সালে জেলা প্রশাসকও রাজশাহীর ম্যাজিস্ট্রেট থাকার সময় এখানে এমন এক সরকারি কাজে এসে মুসা মার্সেন্টের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। আমরা প্রায় পাঁচ সপ্তাহের মতো তাঁর মেহমান হয়ে সেখানে ছিলাম। সকালে প্রাতরাশ সেরে গোডাউনে চলে যাই। ৭-৮টা বিশাল আকৃতির গোডাউন, অসংখ্য লেবার, হিসাবরক্ষক, দাঁড়িপাল্লার সরঞ্জাম, অনবরত চালের বড় বড় বস্তা গুনে সরানো হচ্ছে আর হাতে নোট বই নিয়ে আমরা সতর্ক মিলিয়ে দেখছি। প্রচন্ড ধুলো উড়ছে, ডাস্ট অ্যালার্জিতে আক্রান্ত। দু-তিন পরে মুখে রুমাল বেঁধে কাজ করি। এখন ভাবী, এ কাজ আমার নয় তারুণ্যের। প্রথম আগ্রহ আর উদ্দীপনার কারণেই বোধকরি এমন কঠিন ও কঠোর দায়িত্ব পালন সম্ভব ছিল।

মার্সেন্ট অসাধারণ অতিথিপরায়ণ, নির্মোহ ও ভালো মনের একজন সজ্জন মানুষ। প্রায় ৮২ বছর বয়সে মুসা মার্সেন্ট আমার এবং সহকর্মী মোস্তাফিজের সঙ্গে আজ অবধি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। মাঝে মধ্যে কল করেন, সেই ভাষা, সেই হাসি-খুশি সম্বোধন; ভাই, ঢাকা এলে সাক্ষাৎ করব, আপনি ভালো আছেন তো, দোয়া করি ইত্যাদি।

আজকাল আমি সত্যিই অবাক হই! লোকটি বিগত ৩০ বছরে কোনো দিন আমার কাছে কিছু চাননি বা কোনো কাজের বিষয়েও বলেননি। মোস্তাফিজের ক্ষেত্রেও একই। পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা বন্ধুবর মোস্তাফিজ দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে সম্প্রতি অবসরে গিয়েছেন। আমার পালাও দরজায় কড়া নাড়াচ্ছে। অথচ সময়টা দিব্যি চোখের সামনে নেচে উঠে জানান দিচ্ছে, এসব কিছু নয় শুধু গতকাল।

লেখক : গবেষক ও গল্পকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর