শুক্রবার, ২৭ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

মননে মননশীলতায় আমরা গণতান্ত্রিক

নূরে আলম সিদ্দিকী

মননে মননশীলতায় আমরা গণতান্ত্রিক

ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বনবৃক্ষের মতো কভিড আক্রান্ত বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা। অবারিত অর্থনীতির মহাসড়কে বাংলাদেশ ধীরগতিতে হলেও পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছিল। কভিড-১৯ তাকে একেবারে নিস্তব্ধ করতে না পারলেও অনেকটাই শক্তিহীন, দুর্বল ও মন্থর করে দিয়েছে। আশার কথা, সম্ভাবনার প্রোজ্জ্বল প্রবৃদ্ধি একেবারে নিভে যায়নি। অমানিশার অন্ধকারে বা অনিশ্চয়তার গহ্‌বরে নিমজ্জিতও হয়নি। দেশের অগণিত মানুষ কভিডের এ ধ্বংসলীলার মধ্যেও অনেকটাই উজ্জীবিত রয়েছে, কভিডের করাল গ্রাসকে উপেক্ষা করে মাথা উঁচু করে মেরুদন্ড খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত রয়েছে। এরূপ একটি অনবদ্য আকাক্সক্ষা, এমন জাতীয় ঐক্য ও চেতনা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করার সোনালি মুহুর্তে প্রতিভাত হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই আমরা এ অভূতপূর্ব চেতনাকে পরিপূর্ণভাবে ধরে রাখতে পারিনি। জীবনসায়াহ্নে এসে রোগাক্রান্ত শরীরে রণক্লান্ত সৈনিকের মতো যখন পেছনের দিকে তাকাই, তখন আমি অপলক দৃষ্টিতে দেখতে পাই- স্বাধীনতার অল্প কিছুদিন পরই ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে গেল, যে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর মূল হাতিয়ার হিসেবে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ছয় দফাকে বাংলার মানুষের মুক্তিসনদ হিসেবে গ্রহণ করে মানুষের হৃদয়ের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে পেরেছিল সফলভাবে।

এখানে জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, স্বাধীনতার পূর্বকালেও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে দ্বিধাবিভক্তি অব্যাহত ছিল। সে বিভাজনের রেশ টেনে আজও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, আমি নাকি স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছি। তাদের এ অলীক ও মনগড়া অভিযোগের প্রতিউত্তরে আমার প্রত্যয়দৃঢ় বক্তব্য হলো, তখন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে একটি শক্তিশালী গ্রুপ ’৭০-এর নির্বাচন পাশ কাটিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার অলীক স্বপ্ন দেখত এবং মুখরোচক ও চটকদার স্লোগান দিত। তাদের কণ্ঠে বজ্রনিনাদে উচ্চারিত স্লোগান ছিল- ‘নির্বাচন নির্বাচন/বর্জন বর্জন’, ‘নির্বাচনের কথা বলে যারা ইয়াহিয়া খানের দালাল তারা’, ‘মুক্তির এক পথ/সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। তার উত্তরে আমরা (যারা মুজিববাদী হিসেবে প্রতিভাত) বলতাম- ’৭০-এর নির্বাচন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সোপান নয়। বরং পাকিস্তানের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ও শৃঙ্খল ভাঙার একটি গণম্যান্ডেট। আমরা আরও বলতাম- বাংলার মুক্তিকে ত্বরান্বিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন ও ভারতের সমর্থন সহযোগিতাই নয়, বাংলার মানুষের বুকনিঃসৃত সমর্থন মুক্তির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে আমাদের পৌঁছে দেবে। অবাস্তব, চটকদার বিপ্লবের রোমান্টিসিজমের বিরুদ্ধে ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয় ও তার ফলকে ফলপ্রসূ করার প্রাণান্ত চেষ্টা আমরা করেছি।

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও জীবনসায়াহ্নে এসে আমার কৃতজ্ঞচিত্তের অভিব্যক্তি- যৌবনের উন্মাদনার মধ্যেও ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্তটি নির্ভুল ছিল। ওই নির্বাচনের ম্যান্ডেটই বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মানুষের হৃদয়ের সিংহাসনের মুকুটহীন সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। ৭ মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার একক ও অনবদ্য অধিকার বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন। ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট না পেলে স্বাধীনতার ডাক দেওয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব হতো না। আর ডাক দিলেও তা বিচ্ছিন্নতাবাদের গহিন অন্ধকারে নিপতিত হতো। বিশ্বদরবারে কোনো স্বীকৃতিই পেত না। অযাচিত, অনভিপ্রেত এবং অনিশ্চিত গহিন অন্ধকারে আমরা নিপতিত হতাম। আমি বহুবার বলেছি আবারও বলতে চাই, নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলার গণমানুষের ম্যান্ডেট ছাড়া স্বাধীনতার যে কোনো রোমান্টিক আহ্‌বান ব্যর্থতার অতল গহ্‌বরে আমাদের নিপতিত করত। আমি পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে অবলোকন করেছি, দু-এক জন বহুরূপী রোমান্টিক ডিগবাজি খাওয়া তথাকথিত ভ্রান্তমতাবলম্বী নেতা বলার অপচেষ্টা করছেন আমি নাকি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলাম! ম্যান্ডেট ছাড়া স্বাধীনতার আহ্‌বান হঠকারী আত্মঘাতী ও বিপথগামী ছিল, এটা সেদিনও ভাবতাম, আজও বিশ্বাস করি।

আমাদের এ বিশ্বাস নিগূঢ়, সত্যাগ্রহী এবং বাস্তবধর্মী। ঐতিহাসিক বিচারে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যারা ক্ষণে ক্ষণে রংধনুর মতো রং বদলায়, তাদের প্রচারমাধ্যম এতটাই শক্তিশালী যে যখন যেমন তখন তেমন এ লজ্জাকর অবস্থানকেও তারা সুকৌশলে জাজ্বল্যমান করে তুলতে পারে। তবু বাংলার জাগ্রত জনতা ও ছাত্রলীগের অযুত-নিযুত দুঃসাহসী ও দুর্দমনীয় সৈনিকের কাছে আমার বিনম্র উচ্চারণ- আমি গণতন্ত্রের পথপরিক্রমণ হতে কখনো একচুল সরে আসিনি। গণতন্ত্রের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে পারিনি বলেই বাকশাল গঠনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে মেরুদন্ড খাড়া করে শুধু বিরোধিতাই করিনি, রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হওয়ার দুর্ভাগ্যবরণের পরিণতিও মেনে নিয়েছি। আজও ভাবী, এ দেশের রাজনীতিতে তারাই কি বিজয়ী হবে যারা সুবিধাবাদের কেতন ওড়াল? রাজনীতিতে ব্যক্তিগতভাবে কী পেয়েছি, কী পাইনি তার হিসাব আমি কখনো করি না। আমার হৃদয়ের সিংহাসনে বিবেকের যে জাগ্রত দেবতা, তাঁকে সর্বদাই সত্যের অর্ঘ্য প্রদান করেছি- এ-ই আমার বড় সান্ত্বনা।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রবিবর্জিত রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। একে স্বৈরশাসনের নামান্তর বললেও অত্যুক্তি হবে না। এক ব্যক্তির শাসন ও আমলাতন্ত্রের বল্গাহীন দৌরাত্ম্যে সমগ্র দেশের আজ নাভিশ্বাস। তবু এ অবস্থার জন্য সরকারকে এককভাবে দায়ী করা যাবে না। গণতন্ত্রকে বাস্তবধর্মী করার জন্য যে ধরনের সাহসী, অকুতোভয়, নিষ্ঠাবান, আপসহীন ও আদর্শে সূর্যস্নাত নেতৃত্বের প্রয়োজন তার বড়ই আকাল। বিবেকের দুর্ভিক্ষ চলছে এ দেশে। ভাষা আন্দোলনের ঊষালগ্ন থেকে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনার দীর্ঘ পথপরিক্রমণে ছাত্রসমাজের বিশেষ করে ছাত্রলীগের যে অনবদ্য প্রোজ্জ্বল ও সাহসী ভূমিকা ছিল, আজ তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। স্বাধীনতা-পূর্বকালে ছাত্রদের দুঃসাহসী ভূমিকা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং আন্দোলনের পথপরিক্রমণ যেমন অবশ্যম্ভাবী ও অনবদ্য ছিল, আজকের প্রেক্ষাপট অবশ্য ভিন্ন। আজ ছাত্রদের ঋষিবালকের মতো জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন থাকতে হবে। এ দেশের ভাগ্য বিনির্মাণে নিখুঁত কারিগর হিসেবে তাদের প্রস্তুত হতে হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তাদের ‘উদ্ধত, উদ্গত, পূর্ণায়ত’ বিবেককে গলা টিপে হত্যা করা যাবে না। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ডিগ্রি গ্রহণের নিমিত্তমাত্র নয়, বরং জ্ঞান আহরণ ও চরিত্র গঠনের পাদপীঠ। শুচিশুদ্ধ মননশীলতা নিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি বিনির্মাণে তারা যেমন নির্ভীক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবে, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রকে তাদের সাধনালব্ধ জ্ঞান ও প্রতিভাকে কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। একটি ছাত্রকে সুশিক্ষিত করার জন্য রাষ্ট্রের ব্যয় তার পরিবারের ব্যয়ের প্রায় তিন গুণ। লেখাপড়া সমাপ্ত করে একটি ছাত্র যদি তার প্রতিভাকে দেশের বিনির্মাণে কাজে লাগাতে না-ই পারে তাহলে ওই ছাত্রটির সাধনা ও রাষ্ট্রের বিনিয়োগ একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ে। উন্নত রাষ্ট্রসমূহে, এমনকি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বিশ্বাসী দেশসমূহেও শিক্ষিত বেকারের হার একান্তই সীমিত। এ দেশের অভিজ্ঞ বিজ্ঞজনের অভিমত- অত্যন্ত সূক্ষè পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই শিক্ষাঙ্গন থেকে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত করে বের করে আনা উচিত। রাষ্ট্র ও পরিবারের বিপুল অর্থব্যয় এবং শিক্ষার্থীর অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গন থেকে নানাবিধ উচ্চ ডিগ্রি গ্রহণ করে মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে যদি বেকারত্বের শিকার হতে হয় তাহলে তার জীবনে হতাশা ছাড়া আর কীই-বা থাকতে পারে।

শুনেছি শতাব্দীতে প্যান্ডেমিক আসে মানবতাকে বিধ্বস্ত করতে। তবে এবারের কভিড-১৯-এর হিংস্র পৈশাচিক থাবা বিশ্বজোড়া মনুষ্যসমাজকে প্রচন্ডভাবে যে আঘাত হেনেছে তা সত্যিই বিরল ও ভয়ংকর। যে দেশ যত উন্নত ও শক্তিশালী, যে দেশ যত পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারে সুসজ্জিত সে দেশগুলি কভিড-১৯-এর আক্রমণের শিকার হয়েছে তত বেশি। সর্বাধিক আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের মতো দেশগুলোয়। আর এর সূত্রপাত তো হয়েছিল আরেক শক্তিধর দেশ চীনে।

সে হিসাবে আল্লাহর কাছে শোকরানা আদায় করি, পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি যেভাবে কভিডে বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারত, আল্লাহর রহমতে তা হয়নি। যদিও প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ভরা, তবু অলৌকিক কারণে আমরা অনেকটাই বেঁচে গেছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত ব্যক্ত হতে দেখেছি, পৃথিবী এখনো সম্পূর্ণভাবে কভিড শঙ্কামুক্ত নয়। বিধ্বংসী কালবৈশাখী ঝড়ের মতো আবারও কভিডের বিষাক্ত আক্রমণ আঘাত হানতে পারে। তাই সরকার ও জনগণকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো জাগ্রত থাকতে হবে। কভিডের যে কোনো আক্রমণকে প্রতিহত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। টিকা সংগ্রহ একেবারে দুঃখজনক পর্যায়ের না হলেও অনেকটা অপ্রতুল। এখানে সরকারকে যুদ্ধকালীন জরুরি সতর্কতা নিয়ে কভিড প্রতিরোধের টিকা সংগ্রহ এবং তা জনগণকে প্রদানের ব্যাপারে সতর্ক ও সৎ থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে সতর্কতার বিন্দুমাত্র অভাব জাতির জন্য একটা মারাত্মক বিপর্যয় টেনে আনতে পারে। জনসচেতনতার প্রশ্নে প্রচার বেশ ভালোই হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে প্রথম দিকে টিকা গ্রহণে গা-ছাড়া ভাব থাকলেও এখন আগ্রহ অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রশ্নে জাতীয় দৈন্য তেমন কমেনি।

ইতিমধ্যে সরকার-ঘোষিত নির্দেশনার মধ্যে ১ তারিখের মধ্যে সবাইকে যোগদানের যে অকস্মাৎ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, সেটি একটি অমার্জনীয় ভুল। এটিকে অনিচ্ছাকৃত বলেই মনে করি। তবু এ ধরনের খামখেয়ালিপূর্ণ প্রজ্ঞাপন ভবিষ্যতে যাতে না হয় তার জন্য সর্বৈব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের দেশ নিবিড় ঘনবসতিপূর্ণ তো বটেই, শিক্ষিতের হারও তেমন উন্নত নয়। মানুষের হৃদয়ও অনেকটা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। তবু এসব প্রতিকূলতা দূর করে কভিডসহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার অবাধ ও অবারিত পথ বিনির্মাণে আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কোনোভাবেই যাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্য সুতীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের সাধারণ মানুষের হৃদয় সংস্কারাচ্ছন্ন হলেও কুটিল নয়। বোঝালে তারা বোঝে। জাগ্রত করার প্রচেষ্টা হলে তারা মাথা উঁচু করে জাগ্রত হয়। মননে মননশীলতায় আমরা গণতান্ত্রিক। সেই অবিভক্ত ভারতে এ বাংলাই ছিল স্বাধীনতার চেতনা ও বিশ্বাসের পাদপীঠ। বঙ্গবন্ধুকে তো বটেই, শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী; তারও আগে খেলাফত আন্দোলনের হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমির, মাস্টারদা সূর্যসেন, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদাররা স্বাধীনতা আন্দোলনের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমণের বাঁকে বাঁকে গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপন করেছেন। সেসব ঐতিহ্যের আবির মেখেই বাংলাদেশের মানুষ হিংস্র পাকিস্তানি সৈনিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করেছে, স্বাধীনতার প্রোজ্জ্বল সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছে। জগজ্জোড়া এ গৌরব বাঙালির। তবে মনে রাখতে হবে, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের বুকে সাফল্যের তরণি বাইতে হলে সুদক্ষ, সাহসী ও প্রত্যয়ী নাবিকের প্রয়োজন হয়।

একদিন বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির সঙ্গে তুলনা করে কটাক্ষ করা হতো। আমেরিকার ইহুদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে এরূপ কটূক্তি করেছিলেন। আজকের প্রত্যয়দৃঢ় বাংলাদেশ আপন গৌরবে উন্নত শিরে তার যোগ্য উত্তর দিতে পেরেছে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ আজ একটি সুপরিচিত নাম। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন, গণতন্ত্রের প্রতি এ জাতির অনবদ্য আকর্ষণ, আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য উদগ্র চিত্তের বাসনা বিস্মিত নয়নে পৃথিবী আজ উপলব্ধি করে। তবে শুধু কভিড মোকাবিলাই নয়, জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্রমাগত গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা আমাদের বিরামহীনভাবে করে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীল রাষ্ট্রগুলোকে অনুসরণে কোনো লজ্জা নেই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, এমনকি ভারতের মানুষও কখনো সামরিক শাসনের দৌরাত্ম্য দেখেনি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা গণতান্ত্রিক সূর্যালোকে স্নাত। তাই তাদের রাজনীতি নির্মল, নিষ্কলুষ ও তুলনামূলক সহনশীল। কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সামরিক শাসন বা স্বৈরাচারের কুজ্ঝটিকায় তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই নেই। আমরা কবে সেই অবশ্যম্ভাবী পরিবেশ তৈরি করতে পারব তা-ই আজ বড় প্রশ্ন।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর