শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বাবার ডায়েরির পাতা থেকে

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বাবার ডায়েরির পাতা থেকে

আজ কথা বলছি বাবাকে নিয়ে। একজন সন্তানের ভাগ্যে কত দিন তার পিতার স্নেহ বরাদ্দ রয়েছে এর কোনো সঠিক উত্তর দেওয়া কঠিন। এর হিসাব একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউই বলতে পারে না। তবে তার পরও আমার মনে হয়, এমনকি এ ভুবন থেকে পিতার প্রত্যাবর্তনের পরও তাঁর স্নেহের অদৃশ্য এক পরশে সন্তান সদা আবৃত থাকে। এ পৃথিবীতে অনেক সন্তান মাতৃগর্ভে থাকাকালেই পিতৃহীন হয়। এ সন্তান জন্মের পর কোনো দিন তার বাবাকে ডাকতে পারে না। পিতৃস্নেহের অপার স্বাদ থেকে হয় বঞ্চিত। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম¥দ (সা.) একজন পিতৃস্নেহবঞ্চিত মানুষ। তাঁর জন্মের আগেই তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। আমরা যারা পিতৃস্নেহ পেয়েছি তারা অবশ্যই অত্যন্ত ভাগ্যবান। শুধু পিতৃস্নেহ বলে কথা নয়, পিতার বিশুদ্ধ শিক্ষা ও সাহচর্যে বেড়ে ওঠা প্রতিটি সন্তান তার জীবনের পরিণত বয়স পর্যন্ত পিতার পরোক্ষ আশিসপুষ্ট পরশ অনুভব করে। পিতার দৈনন্দিন কার্যক্রম, জীবনচর্চা এবং অভ্যাস বা শখ সবকিছুই সন্তানকে প্রভাবিত করে।

আজ আমার পরম প্রিয় বাবার নবম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১২ সালে ২৮ আগস্ট তিনি এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোক গমন করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমার বাবা ডা. আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদ। তিনি ছিলেন এক অনন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বেড়ে ওঠা এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার শুদ্ধ মানুষ। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে দেখেছি তিনটি বিষয়ের প্রতি তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। বলা যায় তিনটিই ছিল তাঁর ‘হবি’ বা শখের বিষয়। একটি হলো বাগান পরিচর্যা, পড়াশোনার পাশাপাশি ডায়েরি লেখা, অন্যটি পাখি শিকার। মনে আছে, শীতকালে আমাদের নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল অনেক পরিযায়ী পাখির ছোটাছুটিতে মুখর থাকত। দেখেছি বাবা প্রায়ই ভোরবেলা ফজরের নামাজের পর বন্দুক নিয়ে পাখি শিকারে বেরোতেন। এ শিকারে আমি বহুবার বাবার সঙ্গী হয়েছি। পাখি শিকার অনেকটা নেশার মতো। পরবর্তীকালে বাবার এ অভ্যাসটি আমাকেও প্রভাবিত করেছিল। তবে পরিযায়ী পাখি শিকার আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে বাবা কোনো দিন আর পাখি শিকারে যাননি। আইনের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। আমাদের বাসায় গোলাপের বাগান ছিল। এ বাগান পরিচর্যা বাবা নিজ হাতেই করতেন। আমরা বড় দুই ভাই ও আমার চাচাতো ভাই আমরা তিনজন তাঁর সঙ্গে বাগান পরিচর্যায় সহায়তা করতাম। বাগানে গোলাপের পাশাপাশি আরও কিছু ফুলের গাছ ছিল। মৌসুমি ফুল ছাড়াও প্রায় সারা বছরই বাগানে রঙ্গন ফুল শোভা পেত। বছরের একটি সময়ে বাবা বলতেন, এখন গাছগুলো Pruning করতে হবে। এ শব্দটি বাবার মুখে প্রথম শুনি। কিন্তু শব্দটির মানে জানতাম না। জানতে চাইলে বাবা বুঝিয়ে দেন, গাছের অপ্রয়োজনীয় অংশ ঝেড়ে ফেলা বা ছেঁটে ফেলাটাকেই Pruning বলে।

আমরা তিন ভাই। বাবার আদর্শ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অনুশীলন করছি কি না জানি না। তবে চেষ্টা করি তিনি আমাদের সামনে যে আদর্শ ও জীবনভাবনা রেখে গেছেন তা আমাদের কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচার করতে। সমাজ যেন সত্য ও বিশুদ্ধ ভাবনায় জেগে থাকে।
বাবার অনেক কথাই আজ মনের মধ্যে ঘুরছে। বাবার আরেকটি বিশেষ শখের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তা হলো নিয়মিত ডায়েরি লেখা। সম্প্রতি দেখি বাবার অনেক ডায়েরি স্তুপীকৃত হয়ে বাসায় রয়েছে। ওগুলোয় একটু হাত রাখি। চোখ বোলাতে থাকি। অনেক ডায়েরি। এর পৃষ্ঠা ওল্টাতে গিয়ে দেখি ডায়েরিতে হরেক রকমের লেখা। কোথাও নিজস্ব কথা লেখা আছে। কোনো পাতায় বড় কোনো মনীষীর কথা উদ্ধৃত করা আছে। আবার কোনো কোনো পাতায় পত্রিকায় প্রকাশিত জাতীয় নেতৃবৃন্দের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ লিখে রেখেছেন নিজ হাতে। তিনি যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন সেজন্য অধিকাংশ লেখাতেই তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের প্রভাব খুব স্পষ্ট। ডায়েরির বহু জায়গাতেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক কবিতা ও গান উদ্ধৃত করা আছে। বাবা একজন একনিষ্ঠ রবীন্দ্র -অনুরাগী মানুষ ছিলেন। ১৯৮২ সালের একটি পুরনো ডায়েরিতে বাবার একটি লেখা আমাকে বেশ আলোড়িত করে। বেশ কবার লেখাটি পড়ি। লেখাটি কত তারিখে লিখেছেন তার কোনো উল্লেখ নেই। তবে ১৯৮২ সালের একটি পুরনো ডায়েরিতে তিনি এ লেখাটি লিখেছেন। লেখাটি সম্ভবত ১৯৯০ সালের পরে কোনো এক সময়ে লিখিত। লেখাটি ছিল এ রকম :

‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বলা হয় “আলমা মাটার” বা alma mater বা “জ্ঞানদাত্রী মাতা”। জ্ঞানদাত্রী মাতা দেন পৃথিবীতে জানার ও শেখার সুযোগ আর জন্মদাত্রী মাতা দেন পৃথিবীতে আসার সুযোগ। মানুষের সন্তান কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মায় না, সে মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা বা বীজ নিয়ে জন্মায় মাত্র। কিন্তু শিক্ষাই মানুষের সন্তানকে মানুষ করে গড়ে তোলে। সন্তানকে মানুষ করে গড়ে তুলতে না পারলে অন্য সবকিছুই প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন। শিক্ষকদের বলা হয় শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় পিতা, জন্মদাতা পিতা সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখায়। আর শিক্ষক দেখায় জ্ঞানের আলো। যে পিতা তার সন্তানদের অভুক্ত রেখে আহার করে সে পিতা নামের অযোগ্য। সেই রকম, যে শিক্ষক তার ছাত্রদের জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত রেখে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে সেই শিক্ষকও শিক্ষকতা পেশার উপযুক্ত নয়।’ এ বিশুদ্ধ বচনগুলো অন্য কারও বক্তব্য থেকে বাবা তাঁর ডায়েরিতে উদ্ধৃত করেছেন কি না তা উল্লেখ নেই। আবার বক্তব্যটি আমার বাবার নিজের কি না তা-ও আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। তাঁর নিজেরও হতে পারে। তবে লেখাটির মধ্যে নিহিত বক্তব্য আমার বাবা যে ধারণ করতেন বা তিনি ওই কথাগুলোর সঙ্গে সহমত পোষণ করতেন সেটিই প্রতিফলিত হয়েছে বাবার ডায়েরিতে তাঁর হাতে লেখা এ কথাগুলোর মধ্যে। বাবার সন্তান হিসেবে আমার মনে হয়েছে এ কথাগুলো কেবল কোনো কথা নয়, এগুলো চিরন্তন সত্য, যা একজন সন্তানের জীবনকে করতে পারে আলোকিত। বাবা নিজের সন্তানের লেখাপড়ার যেমন খোঁজ নিতেন, তেমনিভাবে এলাকার একজন মুরব্বি হিসেবে দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অন্যদের সন্তানের লেখাপড়ারও খোঁজ রাখতেন। আমাদের পরীক্ষায় ভালো ফললাভে বাবা যেমন আনন্দিত হতেন, তেমনি এলাকার অন্য কোনো পিতার সন্তানের ভালো ফললাভেও তিনি একই রকম আনন্দবোধ করতেন। ভালো ফলকারী ছেলেমেয়েদের উৎসাহ প্রদানের জন্য তাদের তিনি কলম, বই বা প্রাইজবন্ড উপহার দিতেন। এটা ছিল তাঁর নিয়মিত অভ্যাস যার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা।

আমরা তিন ভাই। বাবার আদর্শ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অনুশীলন করছি কি না জানি না। তবে চেষ্টা করি তিনি আমাদের সামনে যে আদর্শ ও জীবনভাবনা রেখে গেছেন তা আমাদের কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচার করতে। সমাজ যেন সত্য ও বিশুদ্ধ ভাবনায় জেগে থাকে। আজ আমার প্রিয় বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আর দৃঢ়ভাবে অকপটে বলতে চাই, আমার বাবা যে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক মানবিক মানসিকতা পোষণ করতেন, আমরা যেন সেই মানসিকতা মননে ধারণ করে সমাজপ্রগতির জন্য কাজ করে যেতে পারি। তবেই সন্তান হিসেবে আমাদের প্রতি বাবার স্নেহ চিরকাল সবুজ হয়ে রইবে।

লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর