বুধবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

চাই আত্মসংযমের বোধশক্তির উত্থান

খায়রুল কবীর খোকন

চাই আত্মসংযমের বোধশক্তির উত্থান

যুগের বিবর্তনে বাংলাদেশে যেমন সারা দুনিয়ায়ই তো তেমনি মানুষের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষা লাভের সুযোগ বাড়ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিজ্ঞান-চেতনাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দী অবধি পৃথিবী নামের এ গ্রহে মানবসভ্যতা বিকাশের অপরিহার্য সঙ্গী হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সম্প্রসারণ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মানুষের মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষা লাভের সুযোগ-সুবিধা- সমাজ-সংস্থার মাধ্যমে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ অনুশীলন এবং সাহিত্যচর্চা, সংস্কৃতিচর্চা। কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ, তার দুর্ভোগ ও প্রাণহানি এবং এর পরিণামে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট প্রমাণ করে দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে যথাযথ শিক্ষালাভ থেকে সৃষ্ট প্রকৃত সচেতনতা যথার্থ সক্রিয় নয়। ভোগবাদী বিশ্বে মানুষ যেনতেনভাবে আনন্দ-স্ফূর্তির মধ্যে দিন কাটাতে চায়, কোনোমতেই তারা আত্মসংযমের ধারেকাছে আসতে চায় না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অতি সহজ হওয়া সত্ত্বেও ৯০ শতাংশের বেশি মানুষই তা মানতে নারাজ।

প্রথমত চীন একটি শিক্ষিত ও বিজ্ঞান-চেতনাসমৃদ্ধ মানুষের রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও তাদের অতিমাত্রার অর্থলোভের পরিণামে সারা দুনিয়ার মানুষকে বাজার-দাস বানানোর প্রবণতা থেকে তারা একটানা অনাচার চালিয়েই যাচ্ছে। এই যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ চীনের উহান নগরীতে শুরু হলো ২০১৯ সালের আগস্টে (যেটা চীন দাবি করছে ৩০/৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯), সেটা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যেভাবেই ছড়িয়ে থাকুক না কেন চীন সরকার সময়মতো নিজের সীমান্ত বন্ধ করেনি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে দুনিয়ার সব রাষ্ট্রকে সাবধান করেনি। উল্টো চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. তেদ্রোস আধানম গেব্রেইসুসকে প্রচন্ড চাপ দিয়ে অনুরোধ করেছিলেন যাতে তিনি বিষয়টি তখনই সারা দুনিয়াকে না জানান। কেন তা করলেন শি জিন পিং সন্দেহ দেখা দেওয়া কি অযৌক্তিক? তারপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের উৎস ও সংক্রমণ প্রক্রিয়া গবেষণার জন্য অনেক চেষ্টা করে মাত্র দুবার কোনোমতে উহান অবধি পৌঁছতে পেরেছেন, একবার শুরুর দিকে গত বছরের প্রথম ভাগে, আরেকবার এ কয়েক মাস আগে। কিন্তু চীনা বিজ্ঞানী ও সরকারি প্রশাসন নিদারুণ অসহযোগিতা করেই থামেনি, তাদের বিভ্রান্তিকর তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিয়েছে; এরপর তারা আরও গবেষণার কাজে উহানে যাওয়ার চেষ্টা করলেও চীন সরকার ঢুকতে দিচ্ছে না যা শতভাগ অযৌক্তিক। কেন তারা কেবল করোনাভাইরাসের উৎস ও সংক্রমণ প্রক্রিয়া গবেষণা-কাজে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার’ হওয়ার অজুহাত তুলে বাধা দিচ্ছে?

চীনের এই যে অসাধুতা, এই যে নীতিহীনতা, এই যে নৈতিকতার অবক্ষয় এর কি কোনো প্রতিকার আছে? চীনের মতো এক উন্নত রাষ্ট্রের শিক্ষিত, বিজ্ঞানচেতনাসমৃদ্ধ মানুষের সমাজে কীভাবে বোধশক্তির এমন অধঃপাত ঘটে! তাদের মধ্যে মানবিকতার লেশমাত্রও খুঁজে পাওয়া যায় না।

এখন আসছি সারা দুনিয়ার মানুষের বেকুবপনার বিষয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরুতে কিছুটা ‘পিছিয়ে পড়া’ দশায় থাকলেও এপ্রিলের (২০২০) দিকে তারা বেশ তৎপর হয়। যদিও তাতে দক্ষতা খুব সামান্যই ছিল। করোনা কিয়ামত যেভাবে ধেয়ে আসছিল সেভাবে জানুয়ারিতে (২০২০) তারা বিষয়টা জানামাত্রই বিশ্বব্যাপী ঝাঁপিয়ে পড়ে কার্যকর-তৎপরতা চালালে আর দুনিয়ার সব রাষ্ট্রকে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিধান বোঝাতে সক্ষম হলে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির এতটা অবনতি ঘটতে পারত না।

তবে একই সঙ্গে আরেকটা সত্য হচ্ছে, দুনিয়ার মানুষের মধ্যে ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এমন প্রোথিত হয়ে প্রত্যেকের হৃদয়-মগজ দখল করে নিয়েছে যে কাউকে শতবার বলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা যায় না। অশিক্ষিত ও পিছিয়ে থাকা সমাজের রাষ্ট্রগুলোর মানুষের স্বাস্থ্যবিধি অবজ্ঞা করার কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না, এমনকি সুসভ্য সমাজের শিক্ষিত এবং উঁচু বিজ্ঞানচেতনা ও সংস্কৃতির মানুষ এমনভাবে বিষয়টি নিয়ে হেলাফেলা করেছে যেন ‘আসলে এ মহামারী পরিস্থিতি তেমন কিছুই নয়’।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবদুল মান্নানের একটি লেখায় (গত বছরের মধ্যভাগে একটি দৈনিকে প্রকাশিত) মজার (তবে বেদনারও) একটি ঘটনা ছাপা হয়েছে গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর আমেরিকা ও ইউরোপ মহাদেশ পর্যুদস্ত দশায় যখন। ঘটনাটি এ রকম : ‘ব্রিটেন থেকে অতি উৎসাহী একদল পর্যটক (সংখ্যায় ২০০ বা কমবেশি) একটি বড় উড়োজাহাজ চার্টার করে বিনোদন-ভ্রমণের উদ্দেশে ফ্রান্সের এক সমুদ্রসৈকত-সংলগ্ন বিমানবন্দরে নামে। যুক্তরাজ্যের মতো ফ্রান্সেও তখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের মহামারী ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। লোকগুলো এমনি বেকুব যে ফ্রান্সে সেই বিনোদন কেন্দ্র ও সমুদ্রসৈকত সরকার যে বন্ধ করে দিয়েছে সে খবরটাও জানার চেষ্টা করেনি। সেখানে ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষীয় লোকজন ওইসব কান্ডজ্ঞানহীন পর্যটকের আক্কেল দেখে হতবাক হয়ে যান। তারা প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ওইসব পর্যটককে সেই প্লেনে উঠিয়ে দিয়ে বললেন, তোমাদের যুক্তরাজ্যে করোনায় প্রাণহানি এমনি বেড়ে গেছে যে লাশ দাফনের লোক পাওয়া যাচ্ছে না, দেশে ফিরে যাও এবং মৃতদেহের সৎকারে কাজ কর, সেটাই এ মুহূর্তে জরুরি।’

আমার এ লেখাটার বিষয়বস্তু কিন্তু এটাই- মানুষের মধ্যে, এমনকি শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও মানবিকতার, এমনকি নিজেকে সুরক্ষা দেওয়ার সংযমী বোধশক্তি লোপ পেতে চলেছে। ভোগবাদ তাদের বোধশক্তিহীন করে দিয়েছে, চেতনাহীন মূর্খে পরিণত করে ছেড়েছে। আর তাই চীনের উহানে শুরু হওয়া এ করোনা সংক্রমণ মহামারী সারা বিশ্বে এত সহজে ছড়িয়ে পড়ে ২২২টি রাষ্ট্রকে (রাষ্ট্র এবং ‘অঞ্চল’) চরম দুর্দশায় ফেলেছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, কিউবা, নিউজিল্যান্ড এসব দেশে একটু নিয়ন্ত্রিত থাকলেও ২২২টি রাষ্ট্রেই কমবেশি করোনা সংক্রমণ ছড়িয়েছে। সবচেয়ে খারাপ দশা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত, ইতালি, রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যের।

এ রাষ্ট্রগুলোসহ দুনিয়ার ৯৫ ভাগ রাষ্ট্রই তার নাগরিকদের কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানানো, সময়মতো নিজ নিজ সীমান্ত (স্থল-নৌ-আকাশ) কঠোরভাবে বন্ধ রাখার কাজটি যথাযথভাবে করতে পারেনি। সবকিছুতে ছিল একটা ঢিলেঢালা ভাব। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের (চীনসহ ব্যতিক্রম যে রাষ্ট্রগুলো- ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, কিউবা ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলোর রেজিমেন্টাল প্রশাসনের কারণে) নাগরিকদের কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার মতো সংযমী আচরণে উদ্বুদ্ধ করা গেলে আর প্রতিটি দেশ তার সীমান্ত বন্ধ রাখার কঠিন-কঠোর ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি সর্বোচ্চ নয় মাসের মধ্যে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণে চলে আসত। আর সে সময়টাতে সংক্রমণ সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ ১ লাখে সীমিত রাখা আর প্রাণহানি সর্বোচ্চ ২০ হাজারে আটকে দেওয়া সম্ভব হতো। তা করার একটাই উপায় ছিল- করোনাভাইরাসের উৎসস্থল চীনের উহান নগরী থেকে সংক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে সারা বিশ্বের ২২২টি রাষ্ট্রকে একটা সমন্বিত শক্ত কর্মসূচির আওতায় এনে দুনিয়ার সমগ্র জনসমষ্টিকে (যার সংখ্যা ৭৮০ কোটি প্রায়) কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শৃঙ্খলার মধ্য নিয়ে আসতে হতো।

কিন্তু চীন তার ‘অর্থনৈতিক স্বার্থান্ধতা’ বা একই রকম ‘মতলববাজি’র কারণে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা বড় রাষ্ট্রশক্তির কাছ থেকে ‘ঘুষ খেয়ে দায়িত্ব-এড়ানোর ফলে’ বা অদক্ষতার কারণে বিশ্বমানবসমাজকে করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষায় ‘চরম ব্যর্থ’ প্রমাণ করেছে। আসলে আমাদের পৃথিবী নামের মানবগ্রহে একটা ‘জীবাণুযুদ্ধ’ হয়ে গেল কি না সেটাই ভাবার বিষয়। কারণ সমগ্র দুনিয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তি এখন একেকটা ‘মাফিয়া-মার্কা ইবলিশ-দানব’- কেউ যদি এ রকম করোনাভাইরাস ছড়িয়ে সারা বিশ্বটাকে তছনছ করে দিয়ে নিজের অর্থনীতিকে সেরা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সেটা তো সম্ভব, তার পক্ষে তো যুক্তি রয়েছে। আর ব্রাজিল বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি আর ভারত সরকার এবং তার জনগণ এবং সার্বিকভাবে ৯০ শতাংশ বিশ্ববাসী চরম গাফিলতি প্রদর্শন করেছে- সেটা ঘটেছে ভোগবাদের চরম তান্ডব আর প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে আত্মসংযমের বোধশক্তির অভাবে।

বাংলাদেশেও আমরা দেখছি- শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে করোনার সংক্রমণে এত প্রাণহানি আর এমন দুর্ভোগের মধ্যেও নির্বিকার, আত্মসংযমের সামান্যতম চিহ্নও অনুপস্থিত, বোধশক্তির বিলোপ ঘটেছে প্রায় শতভাগ, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে অবজ্ঞা প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষের। আর ভ্যাকসিন সাফল্য- ভ্যাকসিন এখনো পুরোপুরি সফল হওয়ার বিষয়টি পুরো অনিশ্চিত, ভ্যাকসিন কার্যকারিতা ৭০ ভাগ নিশ্চিত হলেও হতে পারে আর তা-ও তো দুই ডোজে ছয়/নয় মাস বা বড়জোর এক বছর আংশিক নিরাপত্তা দেবে, সেটা যেমন অনিশ্চিত, তেমনি ভ্যাকসিন তৈরি ও তার সহজলভ্যতাও নিশ্চিত নয়। তাই বাকি থাকে আত্মসংযমের বোধশক্তি- যা নিশ্চিত করবে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানতে। আমাদের বাঁচতে হলে সেই আত্মসংযম আয়ত্ত করতে হবে, সেই বোধশক্তির উত্থান ঘটাতে হবে।

 

                লেখক : বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর