শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মুজিবনগর প্রশাসন ও জননেতা এম আবদুর রহিম

মোজাম্মেল বিশ্বাস

মুজিবনগর প্রশাসন ও জননেতা এম আবদুর রহিম

জননেতা এম আবদুর রহিম (১৯২৭-২০১৬) ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক বিশ্বস্ত সহকর্মী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সংবিধানপ্রণেতাদের অন্যতম, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার (২৬ মার্চ) পর বাংলার সর্বত্র প্রতিরোধযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭১-এ মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর স্বপ্ন বাস্তব রূপ দিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মুজিবনগর সরকারের সংগঠকরা। এ মুজিবনগর সরকারের সাংগঠনিক দায়িত্ব পরিচালনায় পশ্চিম জোন-১-এর চেয়ারম্যান ছিলেন দিনাজপুরের এমপিএ এম আবদুর রহিম। এজন্য যুদ্ধকালীন তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন প্রস্তুতির ব্যবস্থাপনায়, শরণার্থীদের আবাসন, খাদ্যসহ নানা সমস্যা সমাধানে সীমান্তবর্তী ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে বিরামহীন ছুটে বেড়িয়েছেন। সচেষ্ট ছিলেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও শহীদদের সৎকারের ব্যবস্থাপনায়। এ সময় যুদ্ধশিবির গড়ে তোলা এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন ছিল তাঁর অন্যতম দায়িত্ব। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর দেখাশোনা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থায় সমন্বয়ের জন্য সীমান্তের দাউদপুরের ফকিরগঞ্জ হাটে তিনি ‘জয় বাংলা অফিস’ স্থাপন করেন।

যুদ্ধের সময় এম আবদুর রহিম পশ্চিম দিনাজপুর অবস্থান করে শরণার্থী শিবিরগুলোর অসহায় মানুষের পাশে থেকে তাদের সহযোগিতায় ভারতের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সাহায্যের আহ্‌বান জানান। ভারতের সীমান্তবর্তী বালুরঘাট, গঙ্গারামপুর, পতিরাম, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ প্রভৃতি জায়গায় তখন দিনাজপুরের শরণার্থী। বৃহত্তর দিনাজপুরের ২৮ লাখ লোকের মধ্যে পর্যায়ক্রমে প্রায় ১৮ লাখই ভারতে আশ্রিত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠা ১০ এপ্রিল এবং মুজিবনগর সরকারের শপথ হয় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে। মুজিনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। আঞ্চলিক প্রশাসন স্থাপন ও পরিচালনা ছিল এ সরকারের নতুন চিন্তাধারার ফসল। পূর্ণাঙ্গ সরকার প্রতিষ্ঠা করে তার অধীন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা প্রদান ছিল আঞ্চলিক প্রশাসনের অন্যতম লক্ষ্য। তাই রাজনৈতিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য জোনাল কাউন্সিল গড়ে তোলা হয়। মুজিবনগর সরকারের স্থানীয় দফতরের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আঞ্চলিক প্রশাসন জোনসমূহ; যার অধীনে বিভিন্ন এলাকার প্রশাসন পরিচালিত। এসব জোন চেয়ারম্যানের অধীনে শরণার্থী শিবির এবং যুব ক্যাম্প গড়ে ওঠে। যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি জোনে ভাগ করে এসব জোনাল কাউন্সিলের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। যুদ্ধ পরিচালনায় বিভিন্ন সেক্টরের মতোই জোনাল কাউন্সিল গঠিত হয় এবং পরিচালনার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে একজন চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মন্ত্রিসভা ১১টি সেক্টরের সঙ্গে ১১টি আঞ্চলিক পরিষদ (Zonal Councils) প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় রাজনৈতিক সংসদ সদস্যরা এ জোনাল কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। অঞ্চলভিত্তিক সংসদ সদস্য কর্তৃক প্রত্যক্ষ ভোটে ১১টি জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।

১১টি প্রশাসনিক জোনের মধ্যে দিনাজপুর ও বগুড়া অঞ্চলের পশ্চিম জোন-১ ছিল অন্যতম। এমএনএ আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে ৩৮ জন সংসদ সদস্য ৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় জোনাল চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন সাব-কমিটির নির্বাচন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ২৬ সেপ্টেম্বর বালুরঘাট অফিসের সভায় এ অঞ্চলের সংসদ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে পশ্চিম জোন-১-এর চেয়ারম্যান হিসেবে এম আবদুর রহিমকে নির্বাচিত করা হয়। সে সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার মোহনলাল, একজন মেজর ও সেক্টর প্রধান লে. কর্নেল কাজী নূরউজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।

বৃহত্তর দিনাজপুর ও বগুড়ার জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এম আবদুর রহিমকে প্রশাসনিক সহযোগিতার জন্য কর্মকর্তা (Zonal Administrator) ও দফতর কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। জোনের কার্যক্রম পরিচালনায় সাব-কমিটি ছিল- অর্থ, ত্রাণ, স্বাস্থ্য, প্রচার, ও শিক্ষা উপকমিটি। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন দিনাজপুরের এডিসি এম এ আবুল কাশেম। অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রউফ ও জেলা আনসার অ্যাডজুট্যান্ট শরিফুল হক এবং দফতর সচিব ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির। যুদ্ধকালীন বিপুলসংখ্যক ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক ও রাজনৈতিক দলের কর্মী ভারতে গিয়েছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল ট্রেনিং নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই। এজন্য চার শ্রেণির শিবির স্থাপন করা হয়। যেমন- অভ্যর্থনা, উদ্বুদ্ধকরণ, মৌলিক প্রশিক্ষণ ও মিলিটারি প্রশিক্ষণ। দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রেরণ করা হয়। এম আবদুর রহিম মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য এসব রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর অধীনে ১১২টি রিলিফ ক্যাম্প, ১২টি ইয়ুথ রিসিপশন ক্যাম্প, ৬টি ফ্রিডম ফাইটার ক্যাম্প ও একটি মুক্তিযোদ্ধা বাছাই ক্যাম্প ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক ট্রেনিং দেওয়ার পর বিভিন্ন রণক্ষেত্রে পাঠাবার আগে কালিয়াগঞ্জ থানার তরঙ্গপুরে একত্র করা হয়; যার অধিনায়ক ছিলেন মেজর নাজমুল হক। পরে তিনি জিপ দুর্ঘটনায় মারা গেলে দায়িত্ব পান লে. কর্নেল কাজী নূরউজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ৬ ও ৭ নম্বর সেক্টরের দিনাজপুর এবং বগুড়া জেলার বৃহৎ অঞ্চল ছিল পশ্চিম জোন-১-এর ভৌগোলিক পরিসীমা।

এম আবদুর রহিমের পরিচালনায় সীমান্তের কাছাকাছি ১২টি যুব-অভ্যর্থনা শিবির ছিল। যুবক শরণার্থীদের সংগঠিত করার জন্যই যুব-অভ্যর্থনা শিবির। এসব কাম্পে অংশগ্রহণকারী যুবকদের বাছাই করে প্রাথমিক ট্রেনিংয়ের পর তাদের উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। এম আবদুর রহিমের নেতৃত্বে কালিয়াগঞ্জ ও রায়গঞ্জে উচ্চতর ট্রেনিং সেন্টার গড়ে ওঠে। পরে ক্যাম্প দুটো সরিয়ে শিলিগুড়ির পানিঘাটায় স্থানান্তর করা হয়। এখানে ছয় সপ্তাহ প্রশিক্ষণে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলে কালিয়াগঞ্জের তরঙ্গপুর হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হয়। তরঙ্গপুর হেডকোয়ার্টার ৭ নম্বর সেক্টরের আর তেঁতুলিয়া ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের সদর দফতর। এম আবদুর রহিমের সাংগঠনিক পরিচালনায় পশ্চিমাঞ্চলে বিভিন্ন অভ্যর্থনা শিবির ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে।

জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে এম আবদুর রহিমের দায়িত্ব ছিল যৌথ বাহিনীর থেকে ক্রমে মুক্তাঞ্চলের প্রশাসনিক ক্ষমতা গ্রহণ। এ পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চগড় শত্রুমুক্ত হলে প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণের জন্য এম আবদুর রহিম ১২ ডিসেম্বর পঞ্চগড় গমন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দিনাজপুরের ডিসি ফয়েজউদ্দিন আহমদ ও পুলিশ সুপার। পরদিন ১৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও গিয়ে তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর দিনাজপুর হানাদারমুক্ত হলেও তিনি প্রবেশ করতে পারেননি। কারণ যৌথবাহিনীর সেনারা ১৪ ডিসেম্বর গঙ্গারামপুর থেকে দিনাজপুরে প্রবেশ করলে ঘুঘুডাঙ্গায় মাইন বিস্ফোরণে তাদের দুটি ট্রাক উড়ে গিয়ে শতাধিক সেনা হতাহত হয়। যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন রাস্তায় ব্যাপক মাইন পুঁতে রেখেছিল। এদিকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় উৎসব উদ্যাপন করলেও দিনাজপুরে আনুষ্ঠানিক উৎসব হয় কয়েকদিন পর। তবে ১৭ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের আগেই বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে বিজয়ী মুক্তিসেনারা বীরদর্পে শহরে প্রবেশ করে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করায় দিনাজপুরে যুদ্ধরত হানাদাররা সৈয়দপুর পালিয়ে যায়। একই সময় পালিয়ে যায় শহরের বিহারি, দালাল, রাজাকার, মুহাজির, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ বিশ্বাসঘাতক বাঙালিরাও। তাই ১৭ ডিসেম্বর সকালেই মুক্তিসেনাদের আগমনে জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে দিনাজপুর শহর। সেদিন এম আবদুর রহিম ১৬ ডিসেম্বর দিনাজপুর প্রবেশ করতে পারেননি। কারণ তখনো ভারত থেকে প্রবেশের প্রধান রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইন অপসারণের কাজ চলছিল। তবে পাকিস্তানি সেনারা আগেই দিনাজপুর ছেড়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট চলে যায়। পরে সৈয়দপুরে তারা আত্মসমর্পণ করে। এম আবদুর রহিম বগুড়া জেলার প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৭ ডিসেম্বর সীমান্তবর্তী হিলি দিয়ে ঘোড়াঘাটের রানীগঞ্জ হয়ে বগুড়ায় গিয়ে ১৮ ডিসেম্বর সকালে মিত্রবাহিনীর থেকে প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এম আবদুর রহিম মিত্রবাহিনীর সফরসঙ্গীদের সঙ্গে বগুড়া থেকে দিনাজপুর পৌঁছে ১৮ ডিসেম্বর দুপুরের পর গোর-এ শহীদ মাঠে আনুষ্ঠানিক স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ফরিদ ভাট্টি ও কর্নেল শমসের সিংয়ের চৌকস দল তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।  দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান এমএনএর সভাপতিত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন শেষে জোনাল চেয়ারম্যান এম আবদুর রহিম আবেগাপ্লুত ও অভিনন্দন বক্তব্য প্রদান করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ জনপ্রশাসন, মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর শহীদ ও আহতদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থায় স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে যারা অকুতোভয়ে প্রাণ দিয়েছেন, গণহত্যা-নির্যাতনে শহীদ হয়েছেন, তাদের আনুষ্ঠানিক কৃতজ্ঞতা জানান মুজিবনগর সরকারের পশ্চিম জোনের চেয়ারম্যান এম আবদুর রহিম।

দিনাজপুরের প্রিয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, নৈতিক রাজনীতির সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব এম আবদুর রহিমের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে (৪ সেপ্টেম্বর ২০২১) তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : অধ্যক্ষ, দিনাজপুর সরকারি সিটি কলেজ, দিনাজপুর।

সর্বশেষ খবর