সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সর্বস্তরে সংস্কার সময়ের দাবি

মেজর (অব.) আখতার

সর্বস্তরে সংস্কার সময়ের দাবি

দেশ একটি ক্রান্তিকালের ভিতর দিয়ে চলছে। আইনের শাসন নাই। সংবিধান যথেচ্ছভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাষ্ট্র এবং ক্ষমতার শীর্ষ ব্যক্তি সমার্থক হয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তির বিরোধিতা প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের বিরোধিতা হিসেবে গণ্য করে তাদের ক্ষমতার স্টিম রোলার চালাচ্ছে। কারও প্রতিবাদ তো দূরের কথা, রা টি পর্যন্ত করতে পারছে না। তাই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তথা সংবিধানে যথোপযুক্ত সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা এবং পুলিশের সার্বিক ক্ষমতা ও কর্মকান্ডের ওপরও সংস্কার আজ অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংস্কার যা নিম্নে দেওয়া হলো তা যত তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত করা যাবে ততই জনগণের মঙ্গল ও স্বার্থ উদ্ধার হবে।

প্রথমত রাষ্ট্রের সময়োপযোগী প্রশাসনিক বিন্যাস করতে হবে।

প্রখ্যাত আইনবিদ হলের মতে, ‘রাষ্ট্র হলো এমন এক জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত।’ কাজেই জনগণ ছাড়া কখনই কোনো রাষ্ট্র হতে পারে না। তাই বাংলাদেশের জনসমাজকে রাষ্ট্রের সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে আরও বেশি ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করার প্রয়াসে বর্তমান শাসন কাঠামো আরও বেশি অংশে বিভক্ত করা জনগণের সময়ের প্রত্যাশা। তাই চিন্তা, আলাপ-আলোচনা ও সার্বিক স্বার্থ বিবেচনা করে নিম্নে বর্ণিত একটি বিকশিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার কাজ শুরু করার সময় মনে হয় আমাদের দ্বারপ্রান্তে। আমি বলছি না এগুলো এখনই করতে হবে তবে শুরু করার জন্য বিনীত অনুরোধ রাখব :

১। বর্তমান প্রতি ৩ বা ৪টি বিভাগ নিয়ে একটি করে মোট ৩টি প্রদেশ করা যেতে পারে। যেমন চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেট বিভাগ নিয়ে একটি, বরিশাল, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগ নিয়ে একটি এবং খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ নিয়ে ১টি মোট ৩টি প্রদেশ করা হয় তাহলে ৩টি প্রদেশেরই বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযোগ থাকবে। এর ফলে সাগর পথে সব প্রদেশের সমুদ্র বন্দরের সুযোগ পাবে।

২। বর্তমান বিভাগ বিলুপ্ত করে বর্তমান প্রতি ৫-৬টি জেলা নিয়ে একটি বিভাগ করা যেতে পারে।

৩। বর্তমান জিলা বিলুপ্ত করে বা স্বস্ব অবস্থানে রেখে ৫-৭টি উপজেলা নিয়ে জেলা করা যেতে পারে।

৪। বর্তমান উপজেলা বিলুপ্ত করে বা স্বস্ব অবস্থানে রেখে বর্তমান ৫-৭টি ইউনিয়ন নিয়ে উপজেলা করা যেতে পারে।

৫। বর্তমান ইউনিয়ন বিলুপ্ত করে বা স্বস্ব অবস্থানে রেখে বর্তমান ৪-৫টি ওয়ার্ড নিয়ে ইউনিয়ন করা যেতে পারে।

৬। বর্তমান ওয়ার্ড বিলুপ্ত করে ৪-৭টি গ্রাম বা পাড়া নিয়ে প্রতি নতুন ইউনিয়নের অধীনে ৯টি ওয়ার্ড করা যেতে পারে।

৭। অনধিক ১৫০ বা তার কমবেশি ঘর বা বসতি নিয়ে গ্রাম করা যেতে পারে যেটি হবে তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসনের প্রথম ধাপ। ঢাকাতেই রাজধানী থাকবে কিন্তু ৩টি প্রদেশের জন্য কেন্দ্র ৩টি প্রাদেশিক রাজধানী সমমানে করে দিতে হবে। বৈদেশিক, প্রতিরক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা, সংসদ ও আইন প্রণয়ন এবং আন্তঃপ্রদেশবিষয়ক বিষয়াদি কেন্দ্রের হাতে রেখে সব প্রদেশকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিয়ে দিলে জাতিগত ভাবে আমাদের পারস্পরিক বন্ধন আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হবে এবং জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত ও সব অঞ্চল সমভাবে এগিয়ে যেতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে।

প্রতি প্রদেশে নির্দিষ্ট আসনের প্রাদেশিক পরিষদ গঠন করা যেতে পারে। তার মধ্যে ১০% শুধুমাত্র মহিলাদের সরসরি নির্বাচনের জন্য সংরক্ষিত রাখা হবে যা প্রতি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের সময় লটারির মাধ্যমে নির্ধারিত করা হবে। বর্তমান জাতীয় সংসদের ৩৩০ আসনের পরিবর্তে প্রতি প্রদেশে ৬০টি করে মোট ১৮০ আসনে নিয়ে আসতে হবে এবং সরাসরি ভোটে নির্বাচনের জন্য ১০%, ভাগ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। মহিলা আসনগুলোতে শুধুমাত্র মহিলারাই প্রতিযোগিতা করতে পারবে।

দ্বিতীয়ত পুলিশের সংস্কারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। পুলিশকে গণতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। পুলিশকে হতে হবে জনগণের বন্ধু। বর্তমান পুলিশ সম্পর্কে ভয় কখন কার ওপরে তারা চড়াও হয়ে যায়। দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে শুধু বিরোধী রাজনীতিবিদেরাই নয় একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, এমনকি অভিনয় শিল্পিরাও রেহাই পাচ্ছে না। যখন যাকে খুশি গ্রেফতার করছে, যতদিন খুশি রিমান্ডে রাখছে। কারও কিছু বলার সাধ্য নাই।

সারা দেশে সব নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বিপক্ষে পুলিশকে প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করানো হচ্ছে। স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ইচ্ছা ও অনুমতি ছাড়া সরকারি দলও কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে পারে না। যে কোনো থানায় সরকারি দলের কোনো অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও পুলিশ একটি পক্ষের হয়ে কাজ করে অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই অবস্থান নেয়। সভ্য সমাজের অতি আবশ্যকীয় তথা আইনের শাসনের মূল চালিকা শক্তি হলো পুলিশ। পুলিশ ছাড়া কোনো সভ্য সমাজ তথা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এক দিনও চলতে পারে না। একটি সভ্য, শান্তিপ্রিয়, সুশৃঙ্খল জাতি বা রাষ্ট্রের মুখচ্ছবি হলো পুলিশ। আইনদ্বারা পরিচালিত সুশৃঙ্খল দক্ষ পুলিশের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন আছে এবং থাকবে। কিন্তু বর্তমান পুলিশের মান ও ব্যবহার জনগণকে দারুণভাবে মর্মাহত ও অসন্তুষ্ট করে তুলছে এবং জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

১। পুলিশে আমূল সংস্কার এনে প্রাথমিকভাবে সংবিধান প্রদত্ত জনগণের মিছিল, সভা ও সমাবেশে পুলিশ যাতে বাধা না দেয় তা নিশ্চিত করতে হবে। ক. অলি, গলি, রাজপথে, সড়ক, মহাসড়কে কোনো মিছিলকে অবান্তর কারণ দেখিয়ে পুলিশ বাধা দিতে পারবে না। খ. যে কোনো ছোট বড় খোলা মাঠে, ময়দানে, উদ্যানে জনসভা ও জনসমাগম করতে কোনো অবান্তর কারণ দেখিয়ে পুলিশ বাধা দিতে পারবে না। গ. জনগণের বাকস্বাধীনতা হরণ করতে পারবে না।

২। আদালতের নির্দেশ বা ওয়ারেন্ট ছাড়া পুলিশ কাউকে বা কোনো রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করতে পারবে না।

৩। আদালতের সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া পুলিশ কারও বাড়ি বা ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না।

৪। পুলিশ রাতের বেলায় কারও ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। ৫। সড়ক বা মহাসড়কে ম্যাজিস্ট্রেটের সার্বক্ষণিক উপস্থিত ছাড়া কোনো চেক পোস্ট বা তল্লাশি কেন্দ্র পুলিশ বসাতে পারবে না।

৬। রাস্তায় চলাচল নিয়ন্ত্রণ তথা ট্রাফিক পুলিশ কর্মকান্ড এবং যানবাহনের সব ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জনবলসহ “ট্রাফিক কন্ট্রোল অথরিটি” বলে একটি আলাদা পুলিশ প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। ৭। পুলিশকে থানাভিত্তিক অপরাধ তদন্ত, প্রতিবেদন, চার্জশিট, অপরাধীকে আদালতের কাছে সোপর্দ তথা দন্ডবিধি আইনে প্রদত্ত সব কার্যক্রম করার মধ্যে নিয়োজিত রাখতে হবে।

৭। জেলা ও মহানগর পুলিশকে এসপিসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশকে যথাক্রমে সিজিএম এবং সিএমএমের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে।

৮। প্রতিটি উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অধীনে একটি করে আর্মড পুলিশ প্লাটুন সার্বক্ষণিক আবাসিকভাবে নিয়োজিত থাকবে।

৯। থানা পুলিশ তদন্ত বা জিজ্ঞাসাবাদ পর্যায়ে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে না।

১০। ম্যাজিস্ট্রেটের লিখিত আদেশ ছাড়া থানা, ট্রাফিক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো পুলিশ সম্মিলিত বা এককভাবে কারও গায়ে আঘাত, লাঠিচার্জ বা গুলি করতে পারবে না।

১১। থানার সব ব্যয়ভার বহন করার জন্য যথোপযুক্ত সরকারি বাজেট দিতে হবে যাতে পুলিশকে কারও মুখাপেক্ষী হতে না হয়। থানা বা কর্মস্থলের ৩ কিলোমিটার দূরে দায়িত্ব পালনে সরকারি মোটরসাইকেল অথবা যানবাহন অথবা ভাড়া যাতায়াত ভাতা হিসাবে সরকার প্রদান করবে। কর্মস্থলের বাইরে ৫ ঘণ্টার বেশি দায়িত্ব পালনে অবস্থান করলে প্রতি ৫-৬ ঘণ্টার জন্য খাদ্যভাতা সরকার থেকে দিতে হবে।

১২। থানার পুলিশের সব সদস্যদের সরকারি বাজেটে মোটরসাইকেল দিতে হবে যাতে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে তদন্ত করতে পারে। সেক্ষেত্রে যাতায়াত ভাতা দেওয়া হবে না কিন্তু তেল খরচ দিতে হবে।

১৩। যে তদন্ত কর্মকর্তার প্রদত্ত চার্জশিটে মামলার সাজা হবে সেই তদন্ত কর্মকর্তাকে ন্যূনতম মামলা প্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

১৪। থানার ওসির অবশ্যই আইন বিষয়ে যথোপযুক্ত সনদ থাকতে হবে।

১৫। থানা পর্যায়ে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বা সাধারণ পুলিশকে ৩ বছরের আগে কোনো কর্তৃপক্ষই কোনো কারণেই বদলি করতে পারবে না। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে যথাযথ নিয়মে তদন্ত করে আইন মোতাবেক যে কোনো শাস্তি দেওয়া যাবে। কিন্তু বদলি কখনই শাস্তি হিসেবে গণ্য হতে পারবে না। তবে উচ্চতর পদে বা পদোন্নতিতে এ শর্ত প্রযোজ্য হবে না।

১৬। পুলিশের সব ধরনের নিয়োগে সর্বোচ্চ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে গোপন রোল নম্বরের মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করতে হবে। ভাইবা বা মৌখিক সাক্ষাৎকার নেওয়া যাবে না। ১৭। পুলিশ কখনই সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। পুলিশ যতক্ষণ পোশাকে থাকবে তকক্ষণই সে দায়িত্বে আছে বলে গণ্য হবে। গোয়েন্দা বা বিশেষ দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা কর্তৃপক্ষের লিখিত আদেশ ছাড়া সাদা পোশাকে কোনো প্রকার অস্ত্র বহন করতে পারবে না।

                লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর