বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সশব্দ নীরবতার প্রতীক

আবেদ খান

সশব্দ নীরবতার প্রতীক

একটি বৃক্ষের জীবন এমনই যে সে কেবল চিরকালই প্রাণ-প্রকৃতিকে অকৃপণভাবে দিয়েই যাবে; কোনো রকমের পাওয়ার আশা ছাড়াই। মানুষের মধ্যেও কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা নিজের স্বার্থের জন্য কখনই কিছু করেন না। তাঁরা করেন কেবল বৃহৎ স্বার্থের জন্য। তাই তাঁদের জীবন সর্বদা সহজ ও সাধারণ হয়ে থাকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা তেমনই একজন। পরিবারের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েও অত্যন্ত সহজ-সরল, সাদামাটা, সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিনি। ’৭৫-এর আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পরে তাঁদের দুঃসময় ও ভাসমান জীবনের একটি বড় সময় তাঁরা লন্ডনে কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর লন্ডনের সেই জীবনযাপন দেখেছি। অত্যন্ত সাদামাটা অনাড়ম্বর সেই জীবন। পরবর্তীতে এক দীর্ঘ অমানিশার ঘোর অন্ধকার বিদীর্ণ করে আওয়ামী লীগ যখন দেশের দায়িত্ব পেল, তখনো আমি তাঁদের ঢাকার জীবন দেখেছি। এখানেও শেখ রেহানাকে দেখেছি সেই একইভাবে নিরেট সাধারণ জীবনযাপন। কোনো দম্ভ নেই, বিলাসী আকাক্সক্ষার চিহ্ন নেই তাঁর ব্যক্তিত্বে। মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা কিংবা আচার-আচরণে দারুণভাবে পরিশীলিত। ঠিক যেন তাঁর মায়েরই আরেক রূপ।

বাংলাদেশের উন্নতি তথা আপামর মানুষের সার্বিক উন্নয়নের যে মহাযজ্ঞ চলছে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেখানেই শেখ রেহানা নিভৃতে বঙ্গমাতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং অনিবার্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। পর্দার অন্তরালে থেকে সব কর্মযজ্ঞের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, সাহস এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে নেত্রীকে তাঁর লক্ষ্যস্থির ও তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন, যুদ্ধ করে যাচ্ছেন সমরযোদ্ধার মতোই।

মাত্র ২০ বছর বয়সে যখন তিনি বাবা, মা, ভাই, ভাবি, আত্মীয় সবাইকে হারালেন তখন কখনই কি তিনি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন যে একদিন এ দেশটাকে আবার গড়ে তুলতে হবে এবং সেখানে তাঁর সেই ছোট্ট রেহানাটি থাকা আর চলবে না। দায়িত্ব নিতে হবে একটি দুঃখিনী জাতির মুক্তির? তা অনুমান করা মুশকিল। তবে এ কথা নিশ্চয়ই বলা যায়, জাতবৃক্ষের ছায়ায় যিনি পুষ্ট হয়েছেন, সময়ের প্রয়োজনে অবশ্যই সময়ই তার দাবি মেটানোর সমস্ত শক্তিই মানুষটির মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় রেখে যায়। পরবর্তীতে সেটাই আমরা লক্ষ্য করে চলেছি এই নারীর মধ্যে। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা যেমন বিভিন্ন সময় তাঁর গঠনমূলক চিন্তাভাবনা, সময়োপযোগী পরামর্শ এবং ত্যাগের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন; একইভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও তাঁদের পিতার সোনার বাংলা বাস্তবায়নে নীরবে সহযোদ্ধা হিসেবে সারাক্ষণ সেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে সহযোগিতা করে চলেছেন। বঙ্গমাতা যেমন ব্যক্তি চাহিদাবিহীন নির্লোভ, উদারতার এক উৎকৃষ্ট চরিত্র ছিলেন; রেহানাও ঠিক সেই চরিত্রের ভূমিকা নিয়েই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের ব্যাপারে তো বটেই, একই সঙ্গে নিঃস্বার্থ হয়ে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন দেশের মানুষের প্রতি। সন্তানদের লেখাপড়া এবং মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার দিকে তিনি যেমন যত্নবান; একই সময়ে দেশের সব সন্তানের প্রতিও সমান যত্নবান। আপাত অন্তর্মুখী মনে হলেও তিনি দারুণভাবে সরব প্রধানমন্ত্রীর ছায়া হিসেবে স্বপ্নের কর্মযজ্ঞকে বাস্তবে রূপদানের ক্ষেত্রে। এ মানুষটি তাঁর মায়ের মতোই নিজস্বার্থের কথা না ভেবে সর্বদাই দেশকে প্রাধান্য দিয়ে জননেত্রীর মনোবলকে ইস্পাতকঠিন ও দৃঢ় করে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন। সততা, মানবিকতা এবং সৌজন্য প্রকাশে ন্যূনতম বিচ্যুতি তাঁর মধ্যে নেই। অবিকল বঙ্গমাতারই যেন আরেক সত্তা যিনি তাঁর মায়ের মতোই রাজনীতি এবং মানবকল্যাণে নিবেদিত থাকা এক নিঃশব্দ নারী।

বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এ দুজন মানুষের জীবনের যুদ্ধ, সংগ্রাম এতই কঠিন ছিল, প্রকৃতপক্ষে যাঁকে কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনা করা যায় না। অসংখ্য অকৃতজ্ঞ, বিশ্বাসঘাতককে তাঁরা দেখেছেন। সহ্য করেছেন তাদের নানা রকমের অবজ্ঞা, কুৎসা আর যুদ্ধ করেছেন তাদের ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত্রের বিরুদ্ধে। সেসমস্ত বাধা চুরমার করে আজ সেই দুই নারীই বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে দেশের পতাকা বহন করে চলেছেন বাঙালি জাতির কান্ডারি হয়ে। তাঁদের হাতেই আজ আমার দেশমাতৃকার অগ্রযাত্রা শোভা পাচ্ছে। আজকের বাংলাদেশ উন্নতির যে জায়াগায় এসে পৌঁছেছে, বিশ্বের বড় বড় ক্ষমতাধর কর্তাদের সমীহ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে এবং যার ধারাবাহিকতায়ই দেশ আরও এগিয়ে যাচ্ছে তা আমরা সবাই অনুভব করছি কিন্তু অনেকেই সেভাবে সেটাকে নিতে পারছেন না! কারণ তারা কখনই বাংলাদেশকে স্বীকার করেননি, করবেন বলেও মনে হয় না। স্বপ্নের বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ- যার জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর পুরো জীবনই উৎসর্গ করেছেন, যার জন্য তাঁর পরিবারের প্রায় সব সদস্যকেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে। এই সোনার বাংলাদেশ গড়ার যে দুর্নিবার, দৃপ্ত ও দৃঢ় গতি সঞ্চারিত হয়েছে সেটাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। আর সেই আদর্শ সামনে রেখে, সেই অগ্রযাত্রা বুকে ধারণ করেই তাঁর পথচলা।

আমরা জানি দীর্ঘ প্রবাসী দুঃসহ অনিশ্চয়তার জীবন পেরিয়ে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার দেশে ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন ঘটে। সুদীর্ঘ ২১ বছর পরে নেত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেবার তার শেষটা সম্ভব হয়নি। ষড়যন্ত্রকারীরা ক্ষমতার বদল ঘটায় নানা রকমের জালিয়াতির মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্য পুনরায় শুরু করা হয়। সমাপ্তি ঘটে পুরো জাতির দীর্ঘ অপেক্ষার, কিছুটা মোচন হয় এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের। অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে দুই বোনেরও। দীর্ঘ ৪০ বছর আওয়ামী লীগের কান্ডারি হয়ে আছেন শেখ হাসিনা। একটানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশকে বদলে দিয়েছেন। মানুষের স্বপ্নকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। মানুষকে আবার স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুরই পরিবার। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হলো অদ্ভুতভাবে শেখ রেহানা কিছুতেই না থেকেও তিনি আছেন সমস্ত কার্যে। এক নির্মোহ সাধনার জীবন তাঁর। কিছুই চাই না তাঁর কেবল বড় বোনকে সামলে রাখা ছাড়া। যেন দুজন দুজনার মা, বোন, বাবা, ভাই এবং পরস্পরের অভিভাবকও। আমরা ১/১১-এর সময়ে আওয়ামী লীগের সংকট প্রত্যক্ষ করেছি, শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র দেখেছি এবং সেই সময়েই সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের ত্রাতাকেও আমরা দেখেছি। তিনিই শেখ রেহানা যিনি পর্দার ওপাশ থেকে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা এবং রেখে চলেছেন অদ্যাবধি। ২০০৪ সালেও ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার তিলমাত্র মুহূর্তের ব্যবধানে বেঁচে যাওয়া তাঁর প্রাণপ্রিয় বোনকে আগলে রেখেছিলেন। অনুপ্রেরণা এবং অভয় দিয়েছেন আবার নতুন করে দাঁড়ানোর।

ব্যক্তিগত খ্যাতি, যশ, নামের জন্য অকাতর এই নির্মোহ নারীর ১৩ সেপ্টেম্বর ছিল ৬৬তম জন্মজয়ন্তী। আমি সর্বান্তঃকরণে তাঁকে শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই এবং শুভ কামনা রাখি যেন তাঁরা দুজনই দীর্ঘ জীবনের অধিকারিণী হন। কারণ, তাঁরা যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন এ দেশের স্বপ্নযাত্রার পথ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে আর বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের সঠিক অভিভাবকত্বের উষ্ণতা পাবে। বাংলাদেশকে রক্ষা করতে, বঙ্গবন্ধু পরিবারকে রক্ষা করতে আমরাও তাঁদের পাশে ছিলাম, আছি, থাকব।

                লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর