মঙ্গলবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

অতুলপ্রসাদ সেন : প্রসঙ্গ কথা

সৌরেন চক্রবর্ত্তী

অতুলপ্রসাদ সেন : প্রসঙ্গ কথা

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংগীতের এক অতি পরিচিত নাম অতুলপ্রসাদ সেন। অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) উনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত একজন বিশিষ্ট বাঙালি গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। ফরিদপুরে আদিনিবাস হলেও বাল্যে পিতৃহীন হওয়ায় মাতামহ ঢাকার নিকটবর্তী ভাটপাড়ার জমিদার কালীনারায়ণ গুপ্তের কাছে প্রতিপালিত হন। মাতামহের অনেক গুণ তার মধ্যে সঞ্চালিত হয়। মাতামহের কাছে সংগীতে তাঁর হাতেখড়ি। ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পাসের পর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৮৯২ সালে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে লন্ডন গমন করেন।

বড় মামা ব্যারিস্টার কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্তের (স্যার কে জি গুপ্ত পূর্ববঙ্গের প্রথম আইসিএস। তাঁর সম্মানে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে একটি সড়কের নামকরণ হয়েছে কে জি গুপ্ত লেন) মেয়ে হেমকুসুমের সঙ্গে অতুলপ্রসাদের প্রেম হয় এবং তাঁরা উভয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। নিজ দেশে তখনকার বিধিবিধান অনুযায়ী এ রকম বিয়ে হওয়া সম্ভব ছিল না। আবার বিলেতি বিধিবিধান অনুযায়ীও মামাতো বোনকে বিয়ে করতে পারেন না। এ বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা শুনে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রবল আপত্তি ওঠে। কিন্তু তাঁরা মামাতো-পিসতুতো ভাই-বোন বিয়ের সিদ্ধান্তে অটল। অতুলপ্রসাদ সেন তাঁর কর্মগুরু লর্ড সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহের (তিনিই বাঙালিদের মধ্যে প্রথম লর্ড খেতাব লাভ করেন) পরামর্শে স্কটল্যান্ডের একটি গ্রামে গিয়ে সেই গ্রামের স্থানীয় নিয়ম-কানুন মেনে হেমকুসুমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সেখানে এরূপ বিয়ে আইনসিদ্ধ ছিল। বেশির ভাগ আত্মীয়-স্বজনের এ বিয়ের বিরোধিতার কারণে তিনি বৌ নিয়ে দেশে সহসাই ফিরতে পারেননি। ব্যারিস্টারি পাস করে বিলেতেই আইন ব্যবসা করতে থাকেন। কিন্তু সেখানে তেমন পসার জমাতে পারেননি। ফলে চরম অর্থকষ্টের সম্মুখীন হন। দুটি পুত্রসন্তানের জন্ম হলেও একজনের অকালমৃত্যু হয়। বাধ্য হয়ে তিনি স্ত্রী ও এক পুত্রকে নিয়ে দেশে ফেরেন। এ সময় আত্মীয়স্বজন কেউ তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে আসেননি। তিনি কলকাতা ও রংপুরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। পরে নানাবিধ কারণে লখনৌতে গিয়ে আইন ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন এবং সেখানে তিনি শ্রেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

লখনৌ নগরীর সংস্কৃতি ও জীবনধারার সঙ্গেও তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। সে সময় তাঁর বাসায় প্রতি সন্ধ্যায় গানের আসর বসত। সে আসরে গান শোনাতে আসতেন আহমদ খলিফ খাঁ, বরকত আলী খাঁ, আবদুল করিমের মতো বিখ্যাত ওস্তাদ। ভালো সংগীতের আসর পেলে তিনি আদালত ও মক্কেলদের কথাও ভুলে যেতেন। উল্লেখ্য, বাংলা সাহিত্যে অতুলপ্রসাদই প্রথম ঠুংরির চাল সংযোজন করেন। তাঁর গানগুলো মূলত স্বদেশি সংগীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান- এ তিন ধারায় বিভক্ত। সমকালীন গীতিকারদের তুলনায় তাঁর সংগীত সংখ্যা সীমিত হলেও অতুলপ্রসাদের অনেক গানে সাংগীতিক মৌলিকত্ব পরিলক্ষিত হয়, আর সে কারণেই তিনি বাংলা সংগীতজগতে এক স্বতন্ত্র আসন লাভ করেছেন। তাঁর গানগুলো অতুলপ্রসাদের গান নামে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত। অতুলপ্রসাদ সেন বাংলা-ভাষীদের কাছে একজন সংগীতজ্ঞ ও সুরকার হিসেবেই পরিচিত। তিনি আজও অমর হয়ে আছেন বাংলা গানের নতুন ধারায় নতুন একটি শাখা সংযোজন করার জন্য, ব্যারিস্টার হিসেবে নন। ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট লখনৌতে এ মহান ব্যক্তি পরলোকগমন করেন। সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদের সমাধিস্থলে তাঁর চিতাভস্ম সমাহিত করা হয়। তাঁর বিখ্যাত গান বাঙালির হৃদয়ে সর্বদাই অনুরণিত হয়-

‘মোদের গরব, মোদের আশা

আ-মরি বাংলা ভাষা।

তোমার কোলে, তোমার বোলে,

কতই শান্তি ভালোবাসা।’

                লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর