বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রত্নতত্ত্বের অপূর্ব নিদর্শন কুসুম্বা মসজিদ

নাফিসা বানু

প্রত্নতত্ত্বের অপূর্ব নিদর্শন কুসুম্বা মসজিদ

করোনাকালে ঘরে বসে বসে থিতিয়ে যাচ্ছিল মনটা। সপ্তাহে দু-এক দিন অফিস আর না হয় বাসা- এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে, আর কিছু করারও নেই। অনেক দিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে না। তাই চিন্তা করে আমার স্বামী বললেন চল আমরা তিন-চার দিনের জন্য একটা শর্ট ট্রিপে কোথাও যাই। কোথায় যাব, ঠিক করলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাচারিবাড়ি পতিসর দেখা হয়নি, সেখানেই যাই। এর আগে শিলাইদহ ও শাহজাদপুর গিয়েছি কবিগুরুর কুঠিবাড়ি ও কাচারিবাড়ি দেখতে। রওনা হওয়ার আগে ঠিক করলাম আমরা রাজশাহী হয়ে নওগাঁয় পতিসর দেখে বগুড়া হয়ে ঢাকায় ফিরব। ২৫ মে বেলা ২টা ৫০ মিনিটে যথারীতি রওনা হলাম রাজশাহীর উদ্দেশে। সার্কিট হাউসে পৌঁছাই রাত পৌনে ৯টার দিকে। জেলা জজ, জেলা প্রশাসক ও রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আমার স্বামীর সঙ্গে রাতে সার্কিট হাউসে সাক্ষাৎ করতে আসেন। রাজশাহীতে তখন করোনার প্রকোপ ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে।

পরদিন সকাল ১০টায় নওগাঁর উদ্দেশে আমরা রওনা হই। আমাদের সঙ্গে নওগাঁয় যুক্ত হওয়ার কথা ছিল আমার বড় ভাই প্রফেসর ডা. আবদুল মতিন এবং তার বন্ধু প্রফেসর ডা. মাকসুদুল হক সাহেবের। তারা এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন বিকাল ৩টার দিকে। রাজশাহী থেকে নওগাঁ ৭৮ কিলোমিটার। নওগাঁর জেলা প্রশাসক আমার স্বামীকে বলেছিলেন রাজশাহী থেকে নওগাঁ আসার পথে আমরা যেন কুসুম্বা মসজিদটি দেখে আসি।

কুসুম্বা মসজিদটি রাজশাহী ও নওগাঁর মাঝামাঝি অবস্থানে। রাজশাহী থেকে নওগাঁর দিকে ৪৬ কিলোমিটার এবং নওগাঁ থেকে রাজশাহীর দিকে ৩২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাই যাত্রাপথে কুসুম্বা মসজিদটি দেখে যাব ঠিক করলাম। পিচঢালা পথ বেয়ে চলেছে গাড়ি। আকাশে আলো-আঁধারির খেলা। এই বৃষ্টি এই রোদ। প্রধান সড়ক থেকে অল্প কিছু ভিতরে মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটি কুসুম্বা নামক গ্রামে অবস্থিত বলেই এর নাম কুসুম্বা মসজিদ। গ্রামটি নওগাঁর মান্দা উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের অন্তর্গত। গ্রামটির পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে আত্রাই নদী। কুসুম্বা গ্রাম অঞ্চলটি নিম্নাঞ্চল, আত্রাই নদীর অববাহিকা। শুধু নওগাঁ জেলাই নয়, বৃহত্তর রাজশাহী জেলার এক বিরল স্থাপত্য ও প্রত্ননিদর্শন এ কুসুম্বা শাহি মসজিদ।

রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত কুসুম্বা গ্রামটির প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্য নৈসর্গমন্ডিত। গ্রামটির নামকরণ নিয়ে নানা রকম জনশ্র“তি আছে। এর একটি- গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহর বেগম কুসুম বিবি বিশেষ কারণে এ অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন, তাঁর নামানুসারে গ্রামটির নামকরণ হয় কুসুম্বা। পরে কুসুম বিবির নামানুসারে মসজিদটি এবং তারও পরে এলাকার নাম রাখা হয় কুসুম্বা, তবে এর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই বলে জানা যায়। কথিত আছে ১৫০০ সালে এখানে মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদটির ভিতরের কারুকার্য অপরূপ সুন্দর। তিনটি প্রবেশদ্বার আছে। চোখে পড়ল এক অদ্ভুত জিনিস। তিনটি প্রবেশ দ্বারেই রয়েছে মৌচাক। প্রতি বছরই নাকি মৌমাছি এভাবে বাসা বাঁধে। প্রথম দুটি দ্বার দিয়ে পুরুষ মানুষ মসজিদে প্রবশে করে এবং তৃতীয় দ্বারটি দিয়ে মহিলারা মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য প্রবেশ করেন। তিনটি গম্বুজ আছে মসজিদটিতে। ভিতরে একটি সিঁড়ি দেখা গেল যা দ্বারা কিছুটা ওপরে ওঠা যায়। ওখানে একটা চৌকোনা আকৃতি ছাদের মতো জায়গা আছে সেখানেও নামাজ পড়া যায়। এর ভিতরের নকশাও খুব সুন্দর। এ কুসুম্বা মসজিদের ছবিই আমাদের ৫ টাকার নোটে ছাপা হয়েছে। মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভালো মনে হলো। সেখানকার অর্থাৎ মান্দা উপজেলা প্রশাসন মসজিদটির দেখভাল করে। জানা যায়, এ মসজিদে দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন এলাকার মানুষ মানত করতে আসেন। তারা কয়েকদিন মসজিদের আশপাশে অবস্থান করেন। যারা মানত করতে দূরদূরান্ত থেকে আসেন তারা এখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন বলে এখানে তাদের সুবিধার্থে কিছু দোকানপাট গড়ে উঠেছে।

মসজিটির পাশে কিছুটা দূরত্বে একটা তেঁতুল গাছ দেখতে পেলাম। স্থানীয়রা বললেন তেঁতুল গাছটির বয়স ১০০ বছরের বেশি। এ গাছটি নিয়েও অনেক অলৌকিক কাহিনি প্রচলিত আছে। মসজিদের সামনে বেশ বড় একটা দিঘি আছে। সর্বোপরি মসজিদের পরিবেশ খুব সুন্দর।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মসজিদ এলাকায় একটি ডাকবাংলো নির্মাণ করা হয়েছে। আমরা কুসুম্বা মসজিদে পৌঁছালে সেখানে ইউএনও এবং সেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের অভ্যর্থনা জানান এবং আমাদের মসজিদ ও এর আশপাশ এলাকা ঘুরে দেখান। ডাকবাংলোয় তারা আমাদের চা পানে আপ্যায়িত করেন। চেয়ারম্যান সাহেব ও তার সঙ্গীরা খুব আন্তরিকভাবে আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গ দেন।

কুসুম্বা মসজিদটির প্রত্নতাত্ত্বিক নকশা দেখে আমরা সত্যিই অভিভূত হয়েছি। ৫২১ বছর আগের একটি স্থাপত্য এখনো অত্যন্ত ভালোভাবে অবস্থান করছে, নিঃসন্দেহে এটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কৃতিত্ব। মসজিদটি যেন আরও যুগ যুগ ধরে এর প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারে সে আশা করি। সরকার সে ব্যাপারে সচেষ্ট হবে বলেই বিশ্বাস করি। মসজিদটির প্রত্নতাত্ত্বিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারলে দেশ-বিদেশ থেকে এখানে আরও অনেক পর্যটক আসবেন বলে আমার ধারণা।

 

লেখক : সদস্য (অর্থ) নির্বাহী বোর্ড

বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ খবর