শুক্রবার, ১ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

পিরামিড থেকে চন্দ্রিমা উদ্যান

তুষার কণা খোন্দকার

পিরামিড থেকে চন্দ্রিমা উদ্যান

বাংলাদেশের রাজনীতিকরা হঠাৎ কবরমুখী হয়ে গেছেন। হয়তো মরমি কবি হাছন রাজার মতো উনাদের মন বলছে, কোথায় নিয়া রাখবা আল্লাহ তার লাগিয়া কান্দি। যারা কবর নিয়ে অনেক কথা বলছেন তাদের মনের কথা সম্পর্কে আমি তেমন স্বচ্ছ ধারণা পাচ্ছি না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্তণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী করোনার গণটিকা থেকে শুরু করে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবর নিয়ে যে ভাষায় যেসব কথা বলেন তা শুনে আমরা বুঝেছি উনার কথাবার্তায় অসংলগ্নতা ভর করছে। অনেকদিন থেকে গণমাধ্যমে মন্ত্রী মহোদয়ের কথা শুনে মাননীয় মন্ত্রীর নিজ জেলার একটি প্রবাদ মনে পড়ছে। প্রবাদটি বলার আগে ভাওয়ালবাসীর কাছে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তাঁদের জেলার প্রচলিত প্রবাদটি উল্লেখ করছি। প্রবাদটি হচ্ছে- ‘ভাওয়ালে ভদ্রতা নাস্তি - পানি নাস্তি ট্যাংগরে’। ট্যাংগর মানে উঁচু ভিটা যেখানে পানি পাওয়া যায় না। প্রবাদটি নিজেই নিজেকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। কাজেই এ প্রসঙ্গে অধিক কিছু বলা উচিত হবে না। আমি বরং কবরের প্রসঙ্গে ফিরে যাই।

যেহেতু দেশের রাজনীতিকরা শুধু কবর নিয়েই ভাবছেন সেজন্য আমিও উনাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান সময়ে চালু জীবন্ত প্রসঙ্গ ‘কবর’ নিয়ে অনেক ইতিহাস গ্রন্থ পাঠ করব, কবরকেন্দ্রিক দার্শনিক ভাবনা ভাবব এবং মানুষের মধ্যে কবর নিয়ে টাটকা-তাজা জ্ঞান বিলাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাণিজ্যিক সফল কবর নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমে মনে পড়ে লালসালু উপন্যাসের কথা। বাংলাদেশের সেরা লেখকদের একজন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ১৯৪০-এর দশকে লালসালু নামে একটি অনবদ্য উপন্যাস লিখেছিলেন যার প্রাসঙ্গিকতা আজও আমাদের সামাজিক অবস্থায় এতটুকু ম্লান হয়নি। লালসালু দিয়ে ঢাকা একটি কবর ঘিরে অনেক মানুষের আনাগোনা শুরু হলে কবরটি আর কবর থাকে না। সেটি তখন মাজার হয়ে যায়। মাজারের আশপাশে শুধু যে মানুষের আনাগোনা তা তো নয়। ভক্ত-আশেকানের বিশ্বাস, কবরে শায়িত বুজুর্গ ব্যক্তি নড়ে না, কথা বলে না তবু সেই ব্যক্তির অস্তিত্ব দুনিয়ার ওপরে চড়েবড়ে খাওয়া মানুষগুলোর সব সাধ পূরণ করার সক্ষমতা রাখে। কাজেই ভক্ত-আশেকানের ইচ্ছাপূরণের জন্য সেখানে মানতের চর্চা চলতে থাকে। ভক্ত-আশেকানরা টাকার পোঁটলা নিয়ে মাজারে আনাগোনা শুরু করলে মাজারটি বাণিজ্যিক সফলতার মুখ দেখে। কবরে শায়িত মৃত ব্যক্তির ঐশী আশীর্বাদ নগদ টাকায় বেচাকেনা করে কিছু মানুষের জীবন ভালোই ভোগবিলাসে কেটে যায়। লালসালু উপন্যাসের কাহিনি সে চিত্র দারুণ ফুটিয়ে তুলেছিল বলে উপন্যাসটি এখনো মানুষ পড়ে আনন্দ পায়। লালসালু উপন্যাসের নায়ক মজিদ নিষ্ফলা এলাকার অভাবী মানুষ। রুজি-রোজগারের তাগিদে নিজ জেলা ছেড়ে অন্য জেলায় গিয়ে মজিদ একটি ইট দিয়ে বাঁধানো পুরনো ভাঙা কবরকে কেন্দ্র করে কীভাবে তার ভাগ্য ফেরাল সে কাহিনি নিয়ে লেখা উপন্যাস এখনো তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। ভাগ্যান্বেষী মজিদ পথ চলতে চলতে উর্বর বর্ধিষ্ণু এলাকায় ঢুকে গ্রামের বাইরে নির্জন জঙ্গলে লতাপাতায় ঢেকে থাকা পুরনো ভাঙা কবরকে মোদাচ্ছের পীরের মাজার বলে চালিয়ে দেওয়ার চালিয়াতিতে সফল হয়ে গিয়েছিল। মজিদ যে গ্রামে গিয়েছিল সে গ্রামের মানুষ আমাদের মতো এত কবরমনস্ক ছিল না। কাজেই তারা গ্রামের কোনায় পড়ে থাকা ভাঙা কবরে শায়িত ব্যক্তির পরিচয় জানার চেষ্টা করেনি। মজিদ গ্রামের লোকগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে জোর গলায় দাবি করল, ওই ভাঙা কবরটি আর কারও নয় স্বয়ং মোদাচ্ছের পীরের মাজার। গ্রামের মানুষ মোদাচ্ছের পীর বলে কোনো পীরের নাম শোনেনি। আবার কেউ বলতে পারল না ওই কবরটি আসলে কার। কাজেই গ্রামবাসীর অজ্ঞতা পুঁজি করে মজিদ সহজেই ওটিকে মোদাচ্ছের পীরের মাজার বলে চালিয়ে দিল আর তাতেই মজিদের কপাল ফিরে গেল। আসলে মৃত ব্যক্তি নিজে কথা বলতে পারে না। কাজেই জীবিতরা কবরটিকে যার বলে দাবি করবে সেটি তার। লালসালু উপন্যাস ১৯৬০-এর দশকে ‘ট্রি উইদাউট রুট’ অর্থাৎ শিকড়বিহীন গাছ নামে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপের পাঠকসমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। আমাদের দেশে মৃত ব্যক্তির কবর ঘিরে জীবিতদের ব্যবসা এখনো বেশ লাভজনক। মাজার ঘিরে কিছু মানুষ হরেক ফন্দিফিকির করে টাকাপয়সা কামাই করবে এটা আমরা মেনে নিয়েছি। কিছু মানুষ মাজারকে ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ করে নিয়েছে।

হাই কোর্টের মাজার সম্পর্কে ইতিহাসে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে মনে হয় ওটিও আসলে ট্রি উইদাউট রুট। বাংলার মোগল গভর্নর ইসলাম খাঁ ঘোড়ার গলফ খেলার সময় ভাওয়ালে ঘোড়ার পিঠে বসেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ঢাকায় বাগে শাহিতে অর্থাৎ বর্তমানে হাই কোর্ট এলাকায় ইসলাম খাঁকে প্রথম কবর দেওয়া হয়েছিল। ইসলাম খাঁ জীবিত অবস্থায় ফতেপুর সিক্রিতে তাঁর নানা আধ্যাত্মিক নেতা সলিম শাহ চিশতির কবরের পাশে তাঁর নিজের জন্য কবর নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। কয়েক বছর পর ফতেপুর সিক্রিতে তাঁর কবর তৈরি হয়ে যাওয়ার পর ইসলাম খাঁর দেহাবশেষ ঢাকার কবর থেকে তুলে নিয়ে দিল্লি ফতেপুর সিক্রিতে তাঁর নিজের নির্মাণ করা কবরে সমাহিত করা হয়।

ধারণা করা হয়, ১৯৬০-এর দশকে হাই কোর্ট এলাকায় ইসলাম খাঁর পরিত্যক্ত কবর লালসালুর নায়ক মজিদের মতো কারও নজরে পড়েছিল। তিনি সাফল্যের সঙ্গে এটিকে মাজার বানিয়ে ব্যবসা জমিয়ে তুলেছিলেন।

মাজার ব্যবসা একবার জমে গেলে সেটি মানুষের ধর্মবিশ্বাসের অংশ হয়ে যায়। ভক্ত-আশেকান ভিড় করে নেচে-গেয়ে হোক কিংবা ইবাদত-বন্দেগি করে ওটিকে জীবন্ত করে তোলে। এটি যখন ক্রমাগত চলতে থাকে তখন সেটিকে বাণিজ্যিক সফল অর্থাৎ লালসালু উপন্যাসের ‘মোদাচ্ছের পীরের’ মাজার বলা চলে। বাণিজ্যিক সফল একটি কবরকে কেন্দ্র করে বিপুল অঙ্কের নগদ টাকা, গয়না ইত্যাদি সংগ্রহ করার মওকা মিলে যায় বলে সুবিধাভোগী শ্রেণি এটার রক্ষক হয়ে ওঠে। ইহলৌকিক ইচ্ছাপূরণ ও পারলৌকিক সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার বিশ্বাস নিয়ে যারা কোনো কবরের কাছে হাত পাতে তারা এটিকে তাদের ধর্মবিশ্বাস বলে লালন করতে থাকে।

কবরকে কেন্দ্র করে ধর্মবিশ্বাস নতুন কিছু নয়। প্রাচীন মিসরের পিরামিড পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের একটি। এমন আশ্চর্য নিখুঁত নকশায় সারি সারি সাজানো ভারী পাথরের শৈল্পিক স্থাপনা নিয়ে মানুষের মনে কৌতূহলের শেষ নেই। মিসরের পিরামিড মানুষকে যতখানি বিস্মিত করে তার চেয়ে বেশি বিস্মিত করে পিরামিডের ভিতরে রাখা ফারাও রাজরাজড়ার শরীরের মমি। ৪-সাড়ে ৪ হাজার বছর আগে মানুষ কোন বৈজ্ঞানিক কৌশলে মৃত ব্যক্তির পচনশীল শরীরকে এমন নিখুঁতভাবে সংরক্ষণ করতে পারত এটি আলাদাভাবে অষ্টম আশ্চর্য বলে স্বীকৃতি পেলে আমি খুশি হতাম। এই যে বিশাল স্থাপনা পিরামিড আর তার ভিতরে রাখা পরমাশ্চর্য মরদেহ সংরক্ষণ করার পদ্ধতি এ সবকিছুর মূলে ছিল প্রাচীন মিসরীয় ধর্মবিশ্বাস। মিসরীয়রা বিশ্বাস করত মানুষের ইহজীবন নশ্বর। পরকালের অনন্তলোকে পরম সুখে বসবাস করার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য মানুষ দুনিয়ার ওপর অল্প কিছুদিন বাস করে। মৃত্যুর পরে মানুষের জন্য অনন্ত জীবন অপেক্ষা করছে অর্থাৎ পরকালের ধারণা মিসরীয় ধর্মবিশ্বাসে প্রবল ছিল।

পিরামিড আর মমি নিয়ে কথা বলতে গেলে কথা ফুরাবে না। কবরবিলাস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পিরামিড কিংবা মমির গল্পের অবতারণা করেছি। আমি জানি আমার লেখার পাঠক অনেকে মিসর সভ্যতা সম্পর্কে আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। বলবেন, সব জানার পরও কেন আমি এ কেচ্ছা নতুন করে আপনাদের শোনাচ্ছি। আসলে মিসরের পিরামিড ও মমি নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণা এবং তার ফলাফল নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। আমি শুধু একটি মজার তথ্য আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য এত কথা বলছি। আমরা শুনে আসছি, ১৯২৫ সালে ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টার প্রথম পিরামিডের ভিতর সাড়ে ৩ হাজার বছরের পুরনো ফারাও রাজা তুতেনখামেনের মমির অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। আসলে কিন্তু মমির অস্তিত্ব নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদরা কিছু জানার বহু আগে চোরেরা তার সন্ধান জানত। ফেরাউন রাজারা মারা যাওয়ার পর তাদের লাশ মমি করা থেকে শুরু করে পিরামিডের গোপন কুঠুরিতে রেখে আসা পর্যন্ত বিশাল কায়কারবার চলতে থাকত। পিরামিডের ভিতর সমাধিতে ফেরাউন রাজাদের পরকালের ভোগবিলাসের জন্য বিপুল সম্পদ দিয়ে দেওয়া হতো। ফেরাউন রাজারা ভালো করেই জানতেন উনাদের লাশ পিরামিডের ভিতর রেখে আসার পরে ওখানে চোর ঢুকবে। সেজন্য পিরামিডে ঢোকার পথ জটিল গোলকধাঁধা করে তৈরি করাতেন যাতে চোরেরা সেখানে সহজে ঢুকতে না পারে। কিন্তু সবই বৃথা। রাজাকে কবর দিয়ে রাজন্যবর্গ একটু তফাতে সরে যেতেই সেখানে চোরের দল হাজির হয়ে যেত। তারা পিরামিডের তলা থেকে দামি পাথর সোনাদানা সব লুটে নিতে গিয়ে অনেক সময় যতেœ গড়া মমিগুলো ছিঁড়ে খুঁড়ে সোনাদানার সন্ধান করত। চোরের দল পিরামিডের গোলকধাঁধা অনায়াসে ভেদ করতে পারত কারণ ধারণা করা হয়, পিরামিড তৈরির সঙ্গে যারা যুক্ত থাকত তারাই চুরির কাজ দ্রুত সেরে ফেলত। কাজেই ১৯২৫ সালে হাওয়ার্ড কার্টার মমি আবিষ্কার করেছেন এটা মোটেও সত্য নয়। পিরামিডে ঢুকে সয়সম্পদ চুরি করা বাহিনীর বয়স ফেরাউনদের মতোই পুরনো।

জিয়ার কবরে জিয়ার লাশ আছে কি নেই সেটি আমাদের জমানার হাওয়ার্ড কার্টার মাননীয় মুক্তযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ডিএনএ টেস্ট করে কী দেখবেন তা আমাদের বিচার্য বিষয় নয়। আমরা ভাবছি, উনি আজ যে কৃতিত্ব নিতে চাচ্ছেন সে কৃতিত্ব অনেক আগেই জেনারেল এরশাদ নিয়ে বসে আছেন।

জেনারেল জিয়ার কফিন জেনারেল এরশাদ নিজ কাঁধে বহন করেছেন। তিনি যেটি বলেছেন সেটিই সত্য, কারণ জিয়া হত্যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর সম্পৃক্ততা নিয়ে কেউ আজও কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এরশাদ বলেছেন, জিয়ার কবরে জিয়া নয় একজন সাধারণ সেনা সদস্যের লাশ গোর দেওয়া হয়েছে যার গায়ে কমব্যাট পোশাক ছিল। আমরা আমজনতা পিরামিডের চোর নই কিংবা মমির আবিষ্কারক হাওয়ার্ড কার্টারও হতে চাই না। কাজেই আমরা নীরব শ্রোতা, নীরব দর্শক।

                লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর