শনিবার, ২ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

ঢাকার মুজিব মুজিবের ঢাকা

মোয়াজ্জেম হোসেন

ঢাকার মুজিব মুজিবের ঢাকা

‘ঢাকার মুজিব মুজিবের ঢাকা’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিশেষ কিছু পর্ব আছে। যা ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ। প্রকৃতপক্ষে ভারত ভাগের পরবর্তী অধ্যায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি ঢাকাকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছে তার কোনো তুলনা হয় না। ঢাকা এবং বঙ্গবন্ধু এক অভিন্ন আত্মায় রূপান্তরিত হয়েছিল। যার পরিণাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা! অনেক সময় মনে হবে, ঢাকা যেন শেখ মুজিবকে দিনে দিনে আলিঙ্গন করছে বাংলাদেশের মানুষের চিরদিনের স্বপ্নের সফলতার জন্য। বঙ্গবন্ধু ঢাকাকে কেন্দ্র করেই সমস্ত বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য।

শেখ মুজিব জন্মেন গোপালগঞ্জে। ছাত্রাবস্থায়ই গোপালগঞ্জে পিতার আন্তরিক সমর্থনে দেশপ্রেম এবং মানুষের সেবায় অনুপ্রাণিত হন। পরে কলকাতায় ছাত্ররাজনীতির একজন শীর্ষস্থানীয় তরুণ হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর পূর্ণরূপ অভিব্যক্ত হলো ঢাকায়। প্রায় ৩০ বছরের (১৯৪১-১৯৭১) রাজনৈতিক আন্দোলনের ২৩ বছরই তাঁর ঢাকায় কেটেছে। বিশেষ করে পুরান ঢাকায়। এ পর্বটি এখনো বঙ্গবন্ধুর জীবনীকারদের রচনায় যথার্থ রূপ নিয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে ফুটে ওঠেনি। গুরুত্বপূর্ণ এ পর্বটি উপেক্ষা করার তো নয়ই, বরং শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের পটভূমি হিসেবে এ আখ্যান বিশ্ববরেণ্য এই নেতার জীবনেতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ মুজিব পুরান ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে এসে ওঠেন। এটা ছিল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস। পুরান ঢাকার শওকত আলী ও টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাহেব এ অফিস পরিচালনা করতেন। শেখ মুজিবকে পেয়ে তাদের উদ্দীপনা তীব্র হয়ে ওঠে। আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন সাহেবরা মিলে ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ তৈরি করছেন। শেখ মুজিব আইন বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। গণতান্ত্রিক যুবলীগের কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন পদ্ধতি তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন। তরুণ বয়স থেকেই শেখ মুজিব এ অঞ্চলের মানুষের মনোভাব বিশেষ করে দেশভাগের প্রাক্কালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। তাই শেখ মুজিব ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ বর্জন করলেন। এমনকি শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ও বর্জন করে নতুন পথের সন্ধানে নামেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ ও অন্যান্য স্থানের ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়ে নতুনভাবে আলোচনা শুরু হলো। আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, দাবিরুল ইসলাম, নইমউদ্দিন, মোল্লা জালাল উদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আরও অনেক ছাত্রনেতা আলোচনায় অংশ নেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক মুসলিম হলের অ্যাসেম্বলি হলে আহুত এক সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হলো। ছাত্রলীগ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সাড়া পড়ে গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের মধ্যে প্রায় সব জেলায় শেখ মুজিব ছাত্রলীগের কমিটি করে দিলেন। শেখ মুজিবের সৌভাগ্য তিনি প্রচুর নিঃস্বার্থ কর্মী পেয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য ঢাকার স্থানীয় প্রভাবশালীদের সমর্থন পাওয়ায় শেখ মুজিবের সামনে প্রতিক্রিয়াশীলরা আর দাঁড়াতে পারেনি। ‘ঢাকার মুজিব মুজিবের ঢাকা’ পড়লে এ বিষয়টি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে- ঢাকার স্থানীয় লোকজন যাদের ‘ঢাকাইয়া’ বলে সম্বোধন করা হয়; এরাই আওয়ামী লীগের বিকাশ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কী অসাধারণ মূল্যবান অবদান রেখেছেন।

১৯৪৮ সালেই গঠিত হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ মার্চকে ঘোষণা করা হলো ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’। হরতাল হওয়ায় শামসুল হক, অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেককে সন্ধ্যার দিকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সেটাই ছিল ঢাকায় শেখ মুজিবের প্রথম কারাবাস। ওই সময় কারাগারে তিনি পাঁচ দিন ছিলেন। এরপর বহুবার তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কোনো কোনো বছর আটবার পর্যন্ত গ্রেফতার হন। একবার একনাগাড়ে আড়াই বছর কারাগারে কাটান। নাজিমউদ্দিন রোডের ওই কারাগারই হয়ে ওঠে তাঁর বাড়ি। তাঁর আত্মজীবনীতে কারাগার-জীবনের বহু কষ্টের বেদনাবিধুর বর্ণনা আছে। মৃত্যুর আগে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘জীবনভর আমি জেল খেটেছি। কয়েদিদের সাথে জীবন কাটিয়েছি। আমি জানি তাদের কী দুঃখ, কী কষ্ট!’

নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগার, ১৫০ মোগলটুলী আর আরমানিটোলার বক্তৃতার মাঠ- সারা বাংলাদেশ ঘুরে ফিরে শেখ মুজিব ছিলেন এ তিন জায়গার প্রতিভূ। রাজনীতির সবচেয়ে মূল্যবান প্রহর এখানেই ব্যয় করেছেন। এই সময়ে ঢাকার মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর সহযোগিতার বিষয়টি তাঁর আত্মজীবনীতেও উল্লেখ করেছেন। সাংগঠনিক কর্মকান্ডের কঠিন সময়ে শেখ মুজিবকে তখন যারা সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেন তার মধ্যে ছিলেন শওকত আলী, ইয়ার মোহাম্মদ খান, মীর্জা কাদের সর্দার, বাবুবাজারের বড় বাদশাহ, নাজির মিয়া, আবদুল হালিম, হাফিজ উদ্দিন, ছোট কাটরার ব্যবসায়ী ফজলুর রহিম, ক্যাপ্টেন শাহজাহান, বেগম নূরজাহানসহ অনেকে। শেখ মুজিবের ওই সময়ের উত্থানের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন চকবাজারের বণিক সমিতির সভাপতি হাজী ফজলুর রহমান, হোটেল আল হেলালের মালিক হেলাল উদ্দিন, হাফেজ মনির হোসেন, জিন্দাবাজারের গোলাম কাদের চৌধুরী, রহমতগঞ্জের ফালু সরদার ও বংশালের ফজলুল করিম সাহেব। তাঁদের সম্মিলিত সহযোগিতার কারণেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পুরান ঢাকার ব্রিটিশের অনুগত আহসান মঞ্জিলের নবাববাড়ির খাজা খায়ের উদ্দিনকে বিরাট ব্যবধানে পরাজিত করা সম্ভব হয়। একসময় মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীলরা  পুরান ঢাকার বাবুবাজারের প্রতাপশালী বড় বাদশাহকে শেখ মুজিব এবং তাঁর অনুসারীদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিল। যাতে নবগঠিত আওয়ামী লীগের সভা আরমানিটোলার মাঠে হতে না পারে। সভায় প্রথম দিকে যথেষ্ট আক্রমণ হলেও পরে শেখ মুজিবের বক্তৃতা শুনে বড় বাদশাহ মুসলিম লীগের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তখন থেকেই আরমানিটোলার মাঠই হলো শেখ মুজিবের জনগণের মাঠ। ঢাকাবাসীর অন্তরতম সমর্থন নিয়ে শেখ মুজিব ঢাকার চরিত্রই পাল্টে দিলেন। ঢাকা হয়ে উঠল বাংলার নতুন স্বপ্ন, নতুন জীবনের বিস্ময়কর উদ্দীপনা। এ চিত্র, এ ইতিহাস ধীরে ধীরে রেসকোর্স ময়দানে এসে ৭ মার্চের ভাষণের সম্পূর্ণতা নিয়ে এলো। এ পর্যালোচনায় বলা যায়, ঢাকার বাসিন্দারাই স্বাধীনতার জন্য শেখ মুজিবের বিশাল পটভূমি বিস্তৃত করেন। বঙ্গবন্ধু ১৫০ নম্বর মোগলটুলীকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মুজিবের ঢাকা এক অনন্য পৃথক ঢাকা। যার কাহিনি সযত্নে লিখলে এক অনবদ্য উপাখ্যান হবে।

সর্বশেষ খবর