রবিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব

খায়রুল কবীর খোকন

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী জি এম কাদের স্বৈরাচার এরশাদের ছোট ভাই। শুনেছি তাঁর বুয়েট ব্যাচমেট স্থপতি (এবং চলচ্চিত্র-পরিচালক) মসিহউদ্দীন শাকের সাহেবের এক সূত্রে- তিনি চট্টগ্রামে প্রকৌশলী হিসেবে চাকরির দায়িত্ব পালনের সময় এক বদমায়েশ-ঠিকাদারের রোষানলে পড়ে ‘নিজের ন্যায়নিষ্ঠার কারণে’ জানমাল হারানোর সংকটে পড়েছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! সেই ‘সৎ ব্যক্তিটিকে’ (!) এখন স্বৈরাচার এরশাদের মতো দুর্নীতিবাজ এবং দানবতুল্য ব্যক্তির রাজনৈতিক দলের (তথাকথিত রাজনৈতিক দল/অনেকেই এটাকে ‘যাত্রা পার্টি’ বলে বিদ্রƒপ করতেন) ‘উত্তরাধিকারী নেতা’ হতে হয়েছে।

জি এম কাদের মানে গোলাম মোহাম্মদ কাদের ক্ষমতার লোভে (অর্থ বা অন্য কোনো কিছুর লোভ কতটা জানা যায়নি) এ দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান হয়েছেন রীতিমতো দলের কিছু নেতার সঙ্গে যুদ্ধ করে। তিনিই বলেছেন, সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে- এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নির্বাচন কমিশন আইন শক্তিশালী করার মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন।

গোলাম মোহাম্মদ কাদের হয়তো ভুলে গেছেন তার পূর্বসূরি তারই সহোদর জ্যেষ্ঠ-ভ্রাতা (স্বৈরাচার নামেই যিনি বিখ্যাত!) সেই লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলেই প্রমাণিত হয়ে গেছে- কর্তৃত্ববাদী শাসকদের সরকারের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব হয় না। কারণ স্বৈরতন্ত্রী বা কর্তৃত্ববাদী শাসক তিনি যিনিই হোন না কেন- তিনি ক্ষমতাশীর্ষে আরোহণের সময়ই ‘বাঘের-পিঠে চড়ে বসেন’। এই ব্যক্তিদের গণতন্ত্রসম্মত পন্থায় ক্ষমতা ত্যাগ করে জনগণের কাতারে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, এমনকি সংসদে প্রধান বিরোধী দলের নেতা হওয়ার সাহসও তারা হারিয়ে ফেলেন। কারণ তারা ক্ষমতার দর্পে-দাপটে অপরিসীম দুর্নীতি আর অনাচার করে বসেন, তাই তাদের সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পন্থায় জনগণের আসল ভোটের নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে আসা সম্ভব হয় না; আবার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া মানে দাঁড়াচ্ছে- অবধারিতভাবে চৌদ্দ শিকের বেড়ার ভিতরে প্রবেশ, প্রবেশ মানে তো কিছুকালের মধ্যে আর বেরোনোর জন্য নয়, দশককাল কিংবা দশক দশক ধরে জেলে কাটানোর জন্যই তার প্রবেশ সেখানে। একেই বলে ‘স্বৈরতন্ত্রীর ক্ষমতায় আরোহণ হচ্ছে বাঘের পিঠে চড়ে বসা’। মানে নামতে গেলে বাঘটাকেই হত্যা করতে হবে, না হলে বাঘই তাকে খেয়ে ফেলবে।

জি এম কাদের সাহেব যে নির্বাচনী আইন শক্তপোক্ত করে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চেয়েছেন তা চলে সত্যিকার গণতন্ত্রের চর্চা হয় যেসব দেশে। বাংলাদেশের মতো দেশে এ ধরনের আসল গণতন্ত্রের চর্চা আশা করাই ভুল

জি এম কাদের সাহেব যে নির্বাচনী আইন শক্তপোক্ত করে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চেয়েছেন তা চলে সত্যিকার গণতন্ত্রের চর্চা হয় যেসব দেশে সেসব জায়গায়। বাংলাদেশের মতো দেশে এ ধরনের আসল গণতন্ত্রের চর্চা আশা করাই ভুল। নব্বই সালের ডিসেম্বরে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনগুলো জনগণের অংশগ্রহণে মোটামুটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। ২০০৭-২০০৮ (দুই বছরের) সময়ের ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের আরেক কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চরিত্র হারিয়ে ষড়যন্ত্রে মেতেছিল। তারপর তো স্বৈরতন্ত্রের ইতিহাস রচিত হলো- নতুন কর্তৃত্ববাদের ইতিহাস, আওয়ামী লীগের মাথায় ভূত চাপল- যে কোনোভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখতে হবে; তখন তারা জনসমর্থন হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ল। একের পর এক সংসদ নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখল তারা। গত ১৩ বছর ধরে তারা নির্বাচন কমিশনকে অর্থহীন একটা ‘পাপেট’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ছেড়েছে। জনগণ তাদের ভোটের অধিকার হারাল চিরতরে। এখন জাতীয় সংসদ থেকে ধরে নিচের পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ, সব সিটি করপোরেশন-পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলর এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বর নির্বাচন অবধি ভোটারদের কেন্দ্রে এসে ভোট দিতে হয় না, সব ভোট আগের রাতেই হয়ে যায়- সরকারি কর্মকর্তা আর পুলিশ মিলে ‘সিল মারো ভাই সিল মারো, নৌকা মার্কায় সিল মারো’ উৎসব চলে। ভোটের দিন সরকারি দলের মস্তানসদৃশ কিছু কর্মী অল্প ভোটার জড়ো করে (সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ) লাইন বানিয়ে প্রদর্শনী করে কিছু নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবং ইলেকট্রনিক আর প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের সামনে। তারপর সন্ধ্যায় বা রাতে ঘোষণা করতে থাকে ফলাফল। ৯০-৯৫ ভাগ ভোট সরকারি দলের প্রার্থীর সমর্থনে হিসাব দেখায়। দু-চারটি ব্যতিক্রম দেখায় সেটাও সাজানো নাটকের অংশ। ভোটার উপস্থিতি অবিশ্বাস্য রকমের- যা কল্পনা করাও কঠিন, কোথাও ৮০ ভাগ, কোথাও ৯০/৯৫ ভাগ, কোথাও কোথাও শতভাগ দেখিয়েও ছাড়ে তারা। আসলে সবটাই চমৎকার নাট্য প্রহসন। জি এম কাদের সাহেবরা কি এসব ঘটনা জানেন না! তাদের অবশ্য জানার প্রয়োজনও নেই, কারণ আপসে কয়েকবার সংসদে কিছু আসন লাভ করে বিরোধী দলের অবস্থান পেয়ে গেছেন, তাদের তো ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোজন চলছেই। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত পরপর যে তিনটি সংসদ নির্বাচন হয়েছে তাতে জাল-জালিয়াতি না ঘটলে জাতীয় পার্টির ক্ষমতার-উচ্ছিষ্ট ভোজন নিশ্চিত হতো না। তাই তো জি এম কাদের সাহেবরা কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগের অনাচারের সমর্থনে এ রকম বক্তব্য দিয়ে ক্ষমতাসীন নেতাদের হাতকে শক্তিশালী করবেন সেটাই স্বাভাবিক। এটা জলের মতো সহজবোধ্য ঘটনা, বুঝতে হলে সাধারণ-জ্ঞান থাকলেই চলে, কোনো বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না।

এ নিবন্ধের মূল বক্তব্যে ফিরে আসি। জাতীয় পার্টি বা তার চেয়ারম্যান কী বললেন না বললেন তাতে জাতির কিছু যায়-আসে না। দেশবাসী আমরা প্রমাণ পেয়েছি দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায়- এ দেশে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সব অনাচারে অভ্যস্ত একটি রাজনৈতিক দল সব মূল্যবোধ, ন্যায়নীতি বিসর্জনে মরিয়া। সেটা তারা বারবার প্রমাণ করেছে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনেই তারা তার চমৎকার নজির সৃষ্টি করেছিল! গায়ের জোরে সংসদের সব আসনে দলের লোকদের বসানোর লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসন ‘নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমেই’ দখলে নিয়েছিল। মাত্র সাতটি আসন তারা বিরোধী দলের কয়েকজন নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ছেড়ে দিয়েছিল। স্রেফ দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও মিডিয়া- সাংবাদিকদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যই সেই সাতটি আসনে আওয়ামী লীগের বাইরের লোকদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। তখনকার ওয়াকিবহাল দেশবাসীর, এমনকি বিদেশিদেরও সবারই জানা ছিল- সুুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিরোধী দলগুলোর নেতারা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ আসন পেয়ে যেতেন। আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে সরকার গঠন করতে পারত এবং মোটামুটিভাবে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের অর্জিত হতো। সবারই জানার মধ্যে ছিল তা। বিরোধী দলের ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে এলাকাভিত্তিক সমর্থন প্রকাশ্য ছিল যা- তাতে ১০০-এর মতো আসন তাদের নিশ্চিত ছিল, তবে তার বেশিও নয়। তখনকার সাংবাদিকদের মধ্যে যারা কাছে থেকে আওয়ামী লীগের ‘ভোট-মস্তানি’ দেখেছিলেন তাদের কয়েকজনের কাছ থেকে জেনেছি সেসব কাহিনি। ১৯৭৩ সালের সেই নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগ সরকারকে তাদের নিজেদের লোকদের অনাচারের ফলে বিশেষভাবে ‘চাটার দল’-এর পাল্লায় পড়ে শেষাবধি একদলীয় বাকশাল সিস্টেমে যেতে হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ও সরকারি-মালিকানায় চারটি সংবাদপত্র রেখে অন্য সব পত্র-পত্রিকা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। পরিণামে আওয়ামী লীগ নিজেকে নিজেই উচ্ছেদ করে ফেলে, ভাগ্যের এ-ও এক নির্মম পরিহাস! সে যাই হোক! আমাদের দেশে গণতন্ত্র অনুসরণের সংস্কৃতি ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন কেউ অন্যের কথা শুনতেই চান না, নিজের কথা অন্যকে ঘাড় ধরে হলেও শোনাতে ব্যস্ত। আমাদের সমাজে পরমতসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ‘শূন্য’ পর্যায়ে। এ অবস্থায় প্রমাণিত হয়ে গেছে আরও অন্তত পাঁচ-সাতটি সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। নির্বাচনী আইন শক্তিশালী করে প্রকৃত শক্তিমান ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন অবশ্যই করতে হবে। তবে তাদের পেছনে কোনো দলীয় সরকার থাকলে নির্বাচন কমিশন ‘ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার’ হয়ে যাবে। হতে হবে প্রকৃত নির্দলীয় সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন এবং সার্বিকভাবে নিরপেক্ষ- যথার্থ ‘তত্ত্বাবধায়ক’।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য এবং ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর