রবিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনায় বেহাল অর্থনীতি

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

করোনায় বেহাল অর্থনীতি

করোনা মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে খারাপ অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো অর্থনীতি সচল করতে হিমশিম খাচ্ছে। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। বৈশ্বিক এ মন্দাবস্থার মধ্যে বাংলাদেশও পড়েছে।

করোনায় দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সংস্থা জরিপের মাধ্যমে তুলে ধরেছে। এসব জরিপ থেকে জানা যায়, করোনাকালে নতুনভাবে দরিদ্র হয়েছে ২ থেকে ৩ কোটি মানুষ। দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশের ওপরে। নতুন ও পুরান মিলিয়ে দেশের প্রায় ৬ কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত লোকজন ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। বেসরকারি চাকরিজীবী অনেকে চাকির হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকের বেতন কমে গেছে। রাজধানীতে টিকতে না পেরে ৫০ লাখের বেশি মানুষ গ্রামে ফিরে গেছে। অনেকে গ্রামে পরিবার পাঠিয়ে দিয়েছে। গ্রামে গিয়েও যে তাদের কর্মসংস্থান হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। জীবন-জীবিকার তাগিদে অসংখ্য মানুষ পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। সম্মানজনক পেশা ছেড়ে কেউ কেউ সবজি বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা কিংবা রিকশা ও ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহে বাধ্য হয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্তরা দরিদ্র এবং অনেক মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হয়েছেন করোনাকালে।

করোনার এ পরিস্থিতিতে ধনী শ্রেণি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্য সব শ্রেণির মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয়। তারা অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হাতের নাগালের বাইরে থাকায় সাধারণ মানুষের পক্ষে দুই বেলা খাবার জোগানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। সন্তানের স্কুলের বেতন, যাতায়াতসহ অন্যান্য খরচও বাড়ছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ কীভাবে চলবে কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। বেকার হয়ে পড়া কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই বা কীভাবে হবে তারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই। দেশের সব অর্থনৈতিক সূচক নিম্নগামী। করোনার মধ্যে বৈদেশিক রিজার্ভ রেকর্ড করলেও এখন তা কমে আসছে। শ্রমশক্তি রপ্তানিতে ধস নেমেছে। রেমিট্যান্স কমছে। কবে তা ঘুরে দাঁড়াবে নিশ্চয়তা নেই।

উন্নত দেশগুলো করোনা পরিস্থিতি মেনে নিয়েই অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করেছে। করোনা থাকবে এবং একে সঙ্গে করেই চলতে হবে এমন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা আমাদের অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এ পিছিয়ে পড়াকে অতিক্রম করতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিক তৎপর হতে হবে। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সরকারের নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ বলছে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় মানুষ চাকরি হারিয়েছে অথবা তাদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশসহ ৫৭ দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ বলেছে মহামারীতে তাদের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ভারত, জিম্বাবুয়ে, ফিলিপাইন, কেনিয়া, এল সালভাদরের মতো দেশের মানুষও এ জরিপে অংশ নেয়। তবে উন্নত ও উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় কাজ বন্ধ করে দিতে হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক কম। মহামারীর আগে থেকেই বেসরকারি বিনিয়োগ, বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি ভালো ছিল না। কভিড-১৯-এর অভিঘাতে এসব সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। গত এক বছরে ৬২ শতাংশ মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছে। অনেকে পুনরায় কাজ শুরু করতে সক্ষম হলেও কমেছে অধিকাংশের আয়। ফলে বাধ্য হয়ে তারা ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। আয় কমেছে কৃষি খাতে। করোনার প্রভাবে ৭৮ শতাংশ মানুষ তাদের ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। ৫২ শতাংশ খরচ কমাতে গিয়ে খাদ্যাভ্যাস কিছুটা পরিবর্তন করেছে। প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে ৫ শতাংশ বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরে এসেছে। নির্মাণ, যোগাযোগ, হোটেল, রেস্তোরাঁ খাত এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি এসব খাতে সহজ শর্তে প্রণোদনা দিতে হবে। শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।

করোনাভাইরাসে দেশের অর্থনীতি গভীর সংকটে। লাখ লাখ মানুষ বেকার মহামারীর বিষ নিঃশ্বাসে। কর্মসংস্থানের খাতগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনতে সরকার ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়েছে। তার সুফল অনুভূত হয়েছে অর্থনীতিতে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে করের বোঝা ও জটিলতা কমালে অর্থনীতির ক্ষত উপশমে অবদান রাখবে বলে ব্যাপকভাবে আশা করা হয়। আমার বিশ্বাস, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রস্তাবগুলো সুবিবেচনা করা হবে। বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সমাজের একটি বড় অংশ চরম হতাশার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে।

আমরা জানি বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। সারা বিশ্বেই সরকারি বিনিয়োগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। আবার সরকারি বিনিয়োগের সঙ্গে কর্মসংস্থানের যোগ রয়েছে। কারখানা বাড়লে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়ে। কাজ পেলে আয় বাড়ে, সেই সঙ্গে বাড়ে জীবনযাত্রার মান। বিনিয়োগ, বাজার, কর্মসংস্থান এসব একসূত্রে গাঁথা।

করোনাকালে দেশের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া বাকি সবার আয় কমেছে। কিন্তু দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে লাগামহীনভাবে। গত বছর মহামারীর মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ বছর বাজারের যে গতিবিধি, ধারণা করা যায় জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। সে ক্ষেত্রে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষ আরও সংকটে পড়বে।

বহু দেশেই ন্যায্যমূল্যে বা কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশে সে রকম ব্যবস্থা নেই। সামর্থ্য না থাকায় সরকার কম মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দিতে না পারুক অন্তত বাজার তদারকি জোরদার করে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফাখোরি মানসিকতার লাগাম টানতে পারে। এতে অন্তত স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর পণ্যমূল্যের বোঝা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর