বুধবার, ৬ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

অনুসরণীয় জাস্টিস কায়ানি

বিমল সরকার

অনুসরণীয় জাস্টিস কায়ানি

হৃদয়হীন কর্ম প্রকৃত অর্থে কোনো কর্ম নয়। বলা হয়, জ্ঞান ও যোগ্যতা দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। আর সততা -সদিচ্ছা ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে আরও বেশি কিছু, ভালো কিছু করা যায়। গতানুগতিক কিংবা কেবল কাজের জন্যই কাজ নয়, কোনো কিছু করার আগে হৃদয়ের মাঝ থেকেও একটি তাড়না থাকা চাই।  প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ খ্যাতিমান মানবতাবাদী সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘হৃদয়ে এবং মস্তিষ্কের মধ্যে যখন দ্ধন্ধ জাগে তখন তুমি হৃদয়কেই গ্রহণ কর। কারণ বুদ্ধিমান মানুষের চেয়ে হৃদয়বান মানুষ অনেক শ্রেয়। বুদ্ধিমান বুদ্ধি দিয়ে ভালোও করতে পারে, খারাপও করতে পারে। কিন্তু হৃদয়বান কেবল ভালোই করবে।’ জনপ্রতিনিধি, সাংবিধানিক পদ-পদবিধারী ব্যক্তিবর্গ, মন্ত্রী, গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন সরকারি কর্মকর্তা প্রত্যেকের কাছেই দেশবাসীর প্রত্যাশা থাকে বেশি। তাদের প্রত্যাশা, প্রয়োজন ও গুরুত্ব অনুযায়ী এমনসব ব্যক্তি যার যার সাধ্য ও বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করে থাকেন। এর ব্যত্যয় দেখা দিলে সাধারণ মানুষের জন্য বিড়ম্বনা-দুর্গতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে দায়সারা বলে কোনো কথা নেই। অথচ বাস্তবে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বেমালুম ভুলে যান যে নিজের দফতর থেকে চিঠি ইস্যু করে বা আবেদনের মার্জিনে ‘দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক’ লিখে দিলেই কারও দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আদেশ-নির্দেশ-সুপারিশ এসবের পরবর্তী পরিস্থিতিটিও সবার মাথায় থাকা ও রাখা উচিত। এম আর কায়ানি (১৯০২-১৯৬২)। পুরো নাম মুহাম্মদ রোস্তম কায়ানি। জাস্টিস কায়ানি নামে সমধিক পরিচিত। বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষ ও ষাটের দশকের শুরুর দিকে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের জমানায় তিনি পশ্চিম পাকিস্তান হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির গুরুদায়িত্ব পালন করেন। দক্ষ ও বিচক্ষণ বিচারক যেমন ছিলেন, তেমনি তিনি ছিলেন অত্যন্ত হৃদয়বান এবং মানবিক গুণসম্পন্ন একজন দরদি ব্যক্তি। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি, আইয়ুব খান প্রবর্তিত ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ এবং তাঁর বিভিন্ন কর্মকান্ডের কায়ানি ছিলেন ঘোর বিরোধী। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সাংবিধানিক উচ্চ পদে আসীন থেকেও দেশ ও জনগণের স্বার্থে তিনি যখন যা ভালো মনে করেছেন, স্থান-কাল-পাত্র ও গুরুত্ব বিবেচনা করে নির্দ্বিধায় তা ব্যক্ত করে গেছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানালে তিনি খুশিচিত্তে তা গ্রহণ করতেন। এসব সমাবেশে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতা সমসাময়িককালে মানুষের মনে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা, সচেতনতা ও জাগরণের সৃষ্টি করে।

কায়ানির জন্ম ব্রিটিশ ভারতের সিন্ধু প্রদেশে। তাঁর বাবা খান বাহাদুর আবদুস সামাদ। ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স সম্পন্ন করে আইসিএস পাস করে কর্মজীবন শুরু করেন। আট বছর নির্বাহী বিভাগে কাজ করার পর ১৯৩৮ সালে বিচার বিভাগে আত্তীকরণ হন তিনি। ১৯৪৯ সালে পাঞ্জাব হাই কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। ১৯৫৮ সালে হন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি। অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন জাস্টিস কায়ানি। ছিলেন একজন ভালো লেখকও। সমসাময়িককালে নানা বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। পরে সেসব বই আকারে প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যায়-অবিচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমার লেখায় তিনি ছিলেন খুবই পারদর্শী। বিচারপতি কায়ানি জীবনের শেষ চার বছরে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বক্তায় পরিণত হন। তাঁর বক্তৃতাগুলো পরে বই আকারে কয়েক খন্ডে প্রকাশিত হয়। এগুলো হলো- দ্য হোল ট্রুথ, নট দ্য হোল ট্রুথ, হাফ ট্রুথ, আফকার-ই-পেরেশান প্রভৃতি। বিচারক ও প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতাসমূহ প্রচারমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেত। তাঁর মধ্যে দুর্লভ মেধা, রসবোধ, সাহস এবং সততার সমাবেশ ঘটেছিল। সরস তির্যক মন্তব্য করা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল যা থেকে খোদ প্রেসিডেন্টও রেহাই পেতেন না। অক্টোবর, ১৯৬২ সালে বিচারপতি কায়ানি অবসর গ্রহণ করেন। নির্ভীকচিত্ত কায়ানি সামরিক সরকারের প্রকাশ্য সমালোচনা করতেন বিধায় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস বিবেচিত হননি। লাহোরের জনগণ তাঁর সম্মানে আয়োজিত বিদায় সংবর্ধনায় তাঁকে ‘পাকিস্তানের কণ্ঠস্বর’ উপাধিতে ভূষিত করে। এর উত্তরে বিচারপতি কায়ানি বলেন, এ উপাধি তাঁর কাছে ‘নিশান-এ-পাকিস্তান’-এর চেয়েও প্রিয় ও মূল্যবান।  নভেম্বর ১৯৬২, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বার অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে কায়ানি পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ১৫ নভেম্বর ১৯৬২ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। পরদিন লাশ করাচি নিয়ে নিজ গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। বিচারপতি কায়ানি একবার পশ্চিম পাকিস্তান পল্লী উন্নয়ন একাডেমির বার্ষিক সম্মেলনে বক্তব্য উপস্থাপন করেন (১ জানুয়ারি, ১৯৬২)। ওই বক্তৃতায় তিনি শাসকদের হৃদয় ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার আহ্‌বান জানান। তিনি তাদের সাধারণ মানবিক আচরণে সহানুভূতি ও মানবতাবোধ প্রয়োগেরও তাগিদ দেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে তাঁর ভাষণে কায়ানি বলেন, ‘একজন কৃষিবিশেষজ্ঞ কমলালেবুর চারা সরবরাহ ও পরামর্শদানের পরের বছর যদি কমলালেবুর চারার বৃদ্ধি দেখতে বাগানে না যান অথবা তার সরবরাহকৃত চারা ভালো কি মন্দ তা না জানেন তবে বলতে হবে যে চারা সরবরাহ অথবা কাজে তার দরদ নেই।’

ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘উই লিভ ইন ডিডস, নট ইন ইয়ারস’। আমরা বেঁচে থাকি আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে, কত দিন বাঁচলাম এ পৃথিবীতে বয়সের সে পরিসংখ্যান দিয়ে নয়। মানুষের জীবনের অনিত্যতা-নিত্যতা নিয়ে সংস্কৃতে সুন্দর একটি শ্লোক আছে যার মর্মার্থ হচ্ছে- চিত্ত চঞ্চল; বিত্তও তা-ই। আজ যে আমির, কাল সে ফকির। জীবন-যৌবন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সবই ক্ষণস্থায়ী। যিনি কীর্তিমান শুধু তাঁরই মরণ নেই। তিনি থাকেন মানুষের মনের মন্দিরে চিরজীবী হয়ে। সে হিসেবে জাস্টিস মুহাম্মদ রোস্তম কায়ানি এক অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন যুগ-যুগান্তর।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক।

সর্বশেষ খবর