শুক্রবার, ৮ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

আগামী নির্বাচন কীভাবে হবে

সুনীল শুভরায়

আগামী নির্বাচন কীভাবে হবে

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যাকে হামেশা কিংবা তার নাম উচ্চারণের সঙ্গে ‘খুনি’ বিশেষণে বিশেষিত করে সেই জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপির একজন নেতা খায়রুল কবীর খোকনের একটি লেখা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব’ শিরোনামে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৩ অক্টোবর প্রকাশিত হয়েছে। এ শিরোনামের সঙ্গে সংগতি রেখে যদি নিবন্ধের বক্তব্য থাকত তাহলে কোনো কথাই ছিল না। কিন্তু উল্লিখিত লেখায় এমন সব বাহুল্য, অবান্তর ও কুৎসাপূর্ণ ভাষা ও বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে যা তার নিহত নেতার জন্য খুনি উপাধিটা বয়ে আনতে বাধ্য করেছে। আপনি অন্য দলের নেতাকে অসম্মান করে কথা বলবেন আর তার বিনিময়ে আপনার দলের নেতার জন্য সম্মানের সম্বোধন আশা করবেন তা তো হয় না। সুতরাং কাজে ও কর্মে যা অর্জন করেছেন সে কথা তো শুনতেই হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতিবাজ, আগুনসন্ত্রাসী বলে খ্যাত এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা একটি দলের অনুসারীর মুখে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির প্রতি কোনো ধরনের কটাক্ষ মেনে নেওয়া যায় না। আলোচনার প্রয়োজনে খোকন সাহেব কী লিখেছেন তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করতে হচ্ছে। বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী জি এম কাদের স্বৈরাচার এরশাদের ছোট ভাই।’ এ কথার প্রত্যুত্তরে আমি যদি এই লেখকের বর্তমান নেতার পরিচয় তুলে ধরি এভাবে যে ‘আদালত কর্তৃক স্বীকৃত দুর্নীতিবাজ ও দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমান খুনি জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে’- এ কথা কি ভুল বলে প্রমাণ করা যাবে? জি এম কাদের ব্যক্তিগতভাবে এবং কাজে ও কর্মে সৎ ও স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। মি. খোকন তা প্রকারান্তরে স্বীকার করে আবার লিখেছেন, ‘ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! সেই সৎ ব্যক্তিটিকে এখন স্বৈরাচার এরশাদের মতো দুর্নীতিবাজ ও দানবতুল্য ব্যক্তির রাজনৈতিক দলের (তথাকথিত রাজনৈতিক দল/অনেকেই এটাকে যাত্রা পার্টি বলে বিদ্রƒপ করে) উত্তরাধিকারী নেতা হতে হয়েছে।’ এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের জন্য খোকন সাহেবকে কিছু কথা না বললেই নয়। প্রথম কথা, পল্লীবন্ধু এরশাদ স্বৈরাচার ছিলেন কি ছিলেন না সে বিতর্কে যেতে চাই না। তাতে লেখার কলেবর স্থূল হয়ে যাবে। তবে যে অর্থে তাকে স্বৈরাচার বলা হতো সেই অর্থে তাঁর পরবর্তী শাসকরা স্বৈরাচারী কর্মকান্ডে  বিশ্বরেকর্ড করে বসে আছেন। আর দুর্নীতিতে বিএনপি শাসকরা তো চারবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের অনন্য রেকর্ড গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। এখনো তাদের শীর্ষ নেতারা দুর্নীতির দায়ে সাজা ভোগ করছেন। আবার সরকারের অনুকম্পা গ্রহণ করে জেলের বাইরে থাকার সুযোগ নিচ্ছেন। এই যাদের এসিআর তাদের মুখে কি অন্যকে দুর্নীতিবাজ বলা মানায়? আবার একটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ‘দানবতুল্য’। আমি এই লেখকের অনুরূপ কোনো ভাষায় তাকে বা তার নেতা-নেত্রীকে গালিগালাজ করতে চাই না। কারণ এটা সভ্যতা ও ভদ্রতা বহিভর্‚ত। ‘দানব’ শব্দটি একটি গালিবিশেষ। ইসলামী কিতাব বা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এ শব্দের ব্যবহার নেই। হিন্দু-পৌরাণিক কাহিনি বা গল্পে-সাহিত্যে দানব চরিত্রের অস্তিত্ব আছে। যেমন কংস, হিরণ্যকশিপু, জরাসন্ধ, শিশুপাল, মহিষাসুর, রাবণ এদের দানব হিসেবে অভিহিত করা হয়। দানবের হাতে সৎ-সত্যনিষ্ঠ-ন্যায়পরায়ণ কিংবা ভালোমন্দ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বা হতে পারে; কিন্তু দানবের শেষ পরিণতি অবধারিত হত্যার শিকার হতেই হয়েছে। কোনো দানবের স্বাভাবিক মৃত্যুর রেকর্ড নেই। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু এরশাদ সব বিবেচনায় এ দেশের একজন জননন্দিত রাষ্ট্রনায়ক। বিশ্বে কোনো রাজনৈতিক নেতা কি এমন বিরল ইতিহাস গড়তে পেরেছেন যিনি জেলে বসে দুবার পাঁচটি করে আসনে বিপুলভাবে বিজয়ী হতে পারেন। গণতন্ত্রকে যদি মানেন কিংবা গণরায়ের প্রতি যদি শ্রদ্ধাশীল থাকেন তাহলে কি জনগণ কর্তৃক বারবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে ‘দানব’ বলার ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন? তাকিয়ে দেখুন পল্লীবন্ধু এরশাদের চিরবিদায়ের দৃশ্যের দিকে। তাকে তো অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করতে হয়নি। তিনি জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা হয়ে বিধাতার অমোঘ বিধানে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে নিজভূমি রংপুরের পল্লীনিবাসে চিরশান্তিতে শুয়ে আছেন। তার কবর নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এ দেশ, এ মাটি যত দিন থাকবে কোনো মানুষ কোনো দিন বলবে না এখানে এরশাদ ঘুমিয়ে নেই। কিন্তু খোকন সাহেবরা তাকিয়ে দেখুন তো নিজের নেতার ভাগ্যের দিকে। কবরটা নিয়েও কত কথা হচ্ছে। দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও কি প্রশ্ন তুলতে বাকি রেখেছেন। খোকন সাহেব জাতীয় পার্টির নামকে বিকৃত করে ‘যাত্রা পার্টি’ বলে বিদ্রƒপ করেছেন। তাকে ছোট্ট করে বলি, অন্যের নামকে যে ভ্যাঙাচ্ছেন- নিজের দলের নামকেও তো অনেকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে বিএনপি মানে বেসিক্যালি নো পার্টি এবং বাংলায় বাঁজা দল বলে অভিহিত করে। এ নামে ডাক শুনে ভালো লাগে তো!!!

ফিরে আশা যাক আলোচিত লেখার শিরোনামের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথায়। আগামীতে একটি অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের সংবিধানের আওতার মধ্যে থেকে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। তিনি একজন দায়িত্ববান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দায়িত্বশীল কথাই বলেছেন। এ প্রশ্নে কোনো কিছু বলার মুখ খোকন সাহেবদের তো থাকার কথা নয়। এখন তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রয়োজনের কথা মনে পড়েছে। কিন্তু স্মৃতিতে তাদের এতই বিস্মৃতি ঘটেছে যে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবির বিরুদ্ধে বিএনপি নেত্রী কী মন্তব্য করেছিলেন? পাগল আর শিশু ছাড়া আর কেউ নাকি নিরপেক্ষ নয়। তারপর আবার আন্দোলনের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে সেই শিশু বা পাগলের সরকার প্রবর্তন করতে হয়েছিল। আবার এ সরকারব্যবস্থা বিলোপ হওয়ার পেছনেও রয়েছে বিএনপির এক অনবদ্য (!) ভূমিকা। যে ভূমিকার কারণে দেশে ওয়ান-ইলেভেনের এক অসাংবিধানিক সরকার এসেছে।

নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল ভোগ করেছে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি নিরপেক্ষ সরকারের নিরপেক্ষতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি। বিএনপি সর্বাধিক দুবার (১৯৯১ এবং ২০০১) নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় গেলেও এ ব্যবস্থাকে তারাই ফুটো করে দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে পাঁচটি অপশন ছিল। ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম অপশনের বিরুদ্ধে আপত্তি ওঠায় সেটা বাতিল হলে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ অপশনকে বাদ দিয়ে একেবারে সর্বনিম্ন ৫ নম্বর অপশন গ্রহণ করতে গিয়েই এ ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করার পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ২০০৬ সালে যদি বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতির অধীনে নির্বাচন আয়োজন করে প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার অপচেষ্টাটা না করত তাহলে ওয়ান-ইলেভেন আসার প্রশ্নই আসত না। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার অপশনগুলো মেনে চলা হতো তাহলে আওয়ামী লীগের সাধ্য ছিল না এ ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের প্রথম দায়ভার বিএনপিকেই গ্রহণ করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এখন সুদূরপরাহতের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ অবস্থা থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটবে তার কোনো কূলকিনারা এখনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের সাংবিধানিক আওতায় একটি ফরমুলা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য নিরপেক্ষ ও যোগ্য লোক বাছাইয়ের একটি আইন করা হয়েছিল। তবে সেই সরকারের মেয়াদকাল তিন মাস। নির্বাচিত সরকার গঠিত হলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতো। পরবর্তী নির্বাচনসমূহ দলীয় সরকারের অধীনেই হতো। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সম্পূর্ণ নয় বরং খন্ডকালীন সমাধান। আবার দলীয় সরকার পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে সেগুলোর নিরপেক্ষ চরিত্রের বেঘাত ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে ব্যবস্থাটি চিরস্থায়ী হয়নি।

যেখানে সংবিধানের ১১৮(১)-এর অধীনে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি আইন করার বিধান আছে। নিরপেক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই করা, একটি গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগত নীতিমালাসংবলিত করে আইনটি গঠন করা আবশ্যক। একই সঙ্গে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের বিধান- ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে’ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলেই নির্বাচনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ও চিরস্থায়ীভাবে নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু করা সম্ভব হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা সম্পন্ন করা কঠিন সন্দেহ নেই। তবে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালও সহজসাধ্য মনে করার কোনো কারণ নেই।

লেখক :  জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য।

সর্বশেষ খবর