শুক্রবার, ৮ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

চলনবিলের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী

এম. আতিকুল ইসলাম বুলবুল

চলনবিলের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী

চলনবিলের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বর্তমানে নানা সম্যসায় জর্জরিত। শিক্ষায় কিছুটা অগ্রসর হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অনগ্রসরতায় পিছিয়ে পড়ছেন তারা। বিশেষ করে যান্ত্রিক যুগে এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শ্রমজীবী নারী-পুরুষের আয়-রোজগারের কর্মক্ষেত্র ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। ফলে শ্রমজীবী আদিবাসীরা মৌসুমি বেকারত্বে দিশাহারা হয়ে পড়ছেন। অনেকেই জীবন-জীবিকার তাগিদে কাজের সন্ধানে ছুটছেন শহরে। কেউ কেউ মহাজনী, এনজিও, ব্যক্তি ঋণে ঋণগ্রস্ত হয়ে ঋণের বোঝা বাড়িয়েই চলেছেন। ফলে চলনবিল অঞ্চলের সহজ-সরল কঠোর পরিশ্রমী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী তেমন ভালো নেই বললেই চলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃষিতে দ্রুত যান্ত্রিকীকরণ, পশুপালনের সুযোগ কমে আসা ও প্লাস্টিক, সিরামিক, চটকদার পণ্য বাজার দখলের কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাঁশ-বেতের তৈরি গৃহস্থালি জিনিসের চাহিদা কমে আসাসহ করোনাকালে আয়-রোজগারে টানাপোড়েন তাদের ভাবিয়ে তুলছে। বৃহত্তর চলনবিলে ৪৫-৪৮ হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী-পুরুষ বংশপরম্পরায় বাস করেন। এর মধ্যে ওঁরাও, মাহাতো, মুড়ারী, তেলী, তুড়ি, রবিদাস, কনকদাস, সাঁওতাল, বড়াইক, সিং, মাহালী, বেদিয়া মাহাতোসহ ১৫-১৮টি সম্প্রদায় রয়েছে। প্রায় অর্ধ লাখ আদিবাসী বসবাস করেন তাদের মধ্যে অন্য সম্প্রদায়ের চেয়ে মাহাতো সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার হার বেশি। এ ছাড়া মাহাতো সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ পরিবারেরই যৎসামান্য হলেও ফসলি জমি থাকা ও চাকরি, ব্যবসার প্রতি ঝোঁকের কারণে মাহাতোদের দরিদ্রতার হার অপেক্ষাকৃত অন্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের চেয়ে তুলনামূলক কম। কিন্তু চলনবিলে বসবাসকারী অন্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের পরিবারে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ ভূমিহীন হওয়ায় তারা বেশ আর্থিক দৈন্যে ভোগেন। এ কারণে এদের বেশির ভাগ নারী-পুরুষ শ্রমিক শ্রেণির। যারা জীবিকার প্রয়োজনে দিন হাজিরা, মাসিক বা বার্ষিক চুক্তিতে শ্রম বিক্রি করে পরিবার পরিচালনা করেন। আর চলনবিল অঞ্চলের নৃ-গোষ্ঠীর নারী-পুরুষ সমান্তরালভাবে বহু বছর ধরে জীবন-জীবিকার তাগিদে খেত-খামারে কৃষিকাজ, কৃষি ও ইট ভাটার শ্রমিক, পশুপালন, বাঁশ-বেতের গৃহস্থালি জিনিস তৈরি, মাছ শিকারসহ নানা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। চলনবিলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজনের আগে যাদের জমি ছিল না তারা অন্য সম্প্রদায়ের সামর্থ্যবান কৃষকের জমি বর্গা নিয়ে নানা ফসলের চাষ করতেন। অথচ এখন চলনবিলে বর্গা চাষের প্রথা প্রায় উঠেই গেছে। পরিবর্তে এখন বার্ষিক লিজ প্রথা এসেছে। কিন্তু বছরে ৮-১০ হাজার টাকায় প্রতি বিঘা জমি লিজ নিয়ে ফসলের আবাদ করার মতো সামর্থ্য বেশির ভাগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের নেই বললেই চলে। আরও নেই পশুপালনের মতো পরিবেশ ও ব্যয় করার মতো সামর্থ্য বেশির ভাগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কৃষকের। অথচ একসময় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আদিবাসী গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, শূকর লালনপালন করতেন। তারা গো-চারণভূমিতে তাদের ঘাস খাওয়াতেন, যে কোনো পুকুরে গোসল করাতেন। কিন্তু এখন গো-চারণভূমি না থাকায় আর গরু-ছাগল খাওয়ানোর জন্য বাজার থেকে উচ্চমূল্যে গো-খাদ্য কেনার সামর্থ্য নেই অনেকের। আরও নেই চলনবিলে গো-চারণভূমি। নেই গবাদি পশু গোসল করানোর মতো অবশিষ্ট কোনো পুকুর। কেননা এলাকার প্রায় সব পুকুরে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করায় সেখানে গরু-মহিষ নামানো নিষেধ। ফলে এখানেও রোজগারে চলনবিলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শ্রমজীবীরা ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। এ ছাড়া চলনবিলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একসময়ের সমৃদ্ধ কুটিরশিল্প-সামগ্রী এখন নিকট অতীত। ফলে এখানেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেক পরিবারের আয়-রোজগারে ভাটার টান তাদের রীতিমতো কোণঠাসা করে ফেলেছে। তাই নানা কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসায় চলনবিলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেক পরিবারে বর্তমানে বেকারত্ব পেয়ে বসেছে। যেহেতু দেশ আজ বিশ্বে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রবেশ করেছে সেহেতু দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতধারার সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে এক করার এখনই উপযুক্ত সময় বলে সচেতন নাগরিকরা মনে করেন। তবে অনেকেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উন্নয়নে বর্তমান সরকার আন্তরিক বলে মনে করেন। অবশ্য আমরা জানি সরকার সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আয়বর্ধকমূলক অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। এ ছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে তাদের ঘর করে দেওয়া হচ্ছে। দরিদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে জমিসহ ঘর দেওয়ার প্রকল্প চলমান রয়েছে। তাদের দারিদ্র্য বিমোচনে ও সার্বিক উন্নয়নে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। এ প্রয়াস আরও বাড়াতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা কাউকে পেছনে রেখে নয়, সমান্তরালভাবে সবাই এগিয়ে যাব সামনে। এগিয়ে নেব বিশ্বদরবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাকে।

লেখক : প্রভাষক।

সর্বশেষ খবর