শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

আমার সেই গ্রাম আর গ্রাম নেই

তপন কুমার ঘোষ

আমার সেই গ্রাম আর গ্রাম নেই

এখন শরৎকাল। দুয়ারে কড়া নাড়ছে শারদীয় দুর্গাপূজা। দুর্গোৎসব বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। পূজার ঢাকে কাঠির বাড়ি পড়লেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। ছয় দশক আগের কথা। পূজার তাৎপর্য বোঝার বয়স তখনো আমার হয়নি। তখন পূজা মানেই আনন্দের উপলক্ষ। নতুন পোশাক পরে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ। স্কুলে পূজার ছুটি। এ সময় পড়াশোনা লাটে ওঠে। আমার আনন্দ তখন দেখে কে! ছোটবেলার সেই টুকরো স্মৃতিগুলো কিছুতেই পিছু হটে না।

নড়াইলের কালিয়া উপজেলার এক অখ্যাত গ্রাম সুমেরুখোলা। অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে প্রায় অন্ধকারে ডুবে ছিল আমার গ্রাম। গ্রামের ষোল আনা পরিবার ছিল কৃষিনির্ভর। চৌদ্দ আনা পরিবার ছিল কৃষক। কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, নাপিত, সূত্রধর, ঘরামি, বারুজীবী- সব পেশার মানুষের বসবাস ছিল আমাদের গ্রামে। অধিকাংশ পরিবার ছিল অসচ্ছল। কিছু মানুষ সুদের কারবার করত। তবে তাদের ভালো চোখে দেখত না গ্রামের মানুষ।

কাজের সন্ধানে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াত বিচিত্র পেশার সব মানুষ। চিত্রা নদীতে ছয় ঘণ্টা পরপর জোয়ার-ভাটা হতো। জোয়ারের জলে হারিয়ে যাওয়া কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র বা স্বর্ণালঙ্কার খুঁজে আনা ছিল কিছু মানুষের পেশা। অধিকাংশ পরিবারে মাটির হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবহার ছিল। নৌকায় মাটির তৈজসপত্র সাজিয়ে ঘাটে ঘাটে নৌকা ভেড়াত পালেরা। ধানের সঙ্গে মাটির পাত্রের ‘পণ্য বিনিময়’ হতো। অবস্থাপন্ন গৃহস্থ পরিবারে কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্রের চল ছিল। থালা-বাটি-গ্লাসে নাম খোদাই করে পয়সা উপার্জন করত কিছু মানুষ। এটাই যে তাদের মূল পেশা ছিল তা নয়। ঘরে বসে না থেকে টুকটাক কাজ করে কিছু রোজগার করা আর কি!

ভাঙাচোরা একটি প্রাইমারি স্কুলে আমাদের শিক্ষাজীবন শুরু। স্কুলের ভিত ছিল কাঁচা। কাঠের বেড়া। গোলপাতার ছাউনি। স্কুলের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে নামতা মুখস্থ করতে হতো। স্থানীয় সিঙ্গাশোলপুর বাজারে বইয়ের কোনো দোকান ছিল না। মুদি দোকানে পাওয়া যেত পঞ্জিকা, লক্ষীর পাঁচালি আর বিদ্যাসাগর রচিত ‘বর্ণ পরিচয়’ বই। নতুন বই কিনতে যেতে হতো মহকুমা শহর নড়াইলে। ওপরের ক্লাসের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্ধেক দামে কেনা হতো ব্যবহৃত পাঠ্যবই।

রাতের বেলায় অন্ধকারেই চলাফেরা করত গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মন থেকে ভয় তাড়ানোর জন্য উচ্চৈঃস্বরে গান গেয়ে পথ চলত ভীত পথচারীরা। এলাকায় ছিঁচকে চোরের উপদ্রব ছিল। মধ্যরাতে ডাকাত আতঙ্কে দলবেঁধে পাহারা দিত গ্রামবাসী। সাপের ভয় ছিল। সাপে কাটলে ওঝা ডেকে আনা হতো।

চিকিৎসাসেবার তেমন একটা সুযোগ ছিল না গ্রামে। পানি পড়া, ঝাড়ফুঁক আর তাবিজ-কবজে গ্রামের মানুষের আস্থা ছিল। এলাকায় একজন হাতুড়ে ডাক্তার ছিলেন। সাধারণ অসুখ-বিসুখে তাঁকেই ডাকা হতো। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পাই গ্রামের একটা বাড়িতে প্রতিবেশীর ভিড়। ডাক্তারবাবু এসেছেন রোগী দেখতে। রোগীর গায়ে হাত দিয়ে আঁতকে উঠলেন তিনি! এ তো দেখছি কাঁচা ডিম গায়ে ধরলে ডিম সিদ্ধ হয়ে যাবে! রোগীর স্বজনদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া আর কি! নদীর ওপারে সিঙ্গাশোলপুরে ছিল দাতব্য চিকিৎসালয়। সেখানে একজন সরকারি ডাক্তার ছিলেন। এলএমএফ পাস। রোগীর অবস্থা সঙ্গিন হলেই কেবল তাঁকে ডাকা হতো। ফি মাত্র ২ টাকা। তা-ও দেওয়ার সাধ্য ছিল না অনেকের। আমাদের বাড়িতে কলে এসে কোনো ফি নিতে চাইতেন না ডাক্তার সাহেব। বাবা জোর করে তাঁর পকেটে টাকা গুঁজে দিতেন।

বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করে পেট চালাত হতদরিদ্র কিছু মানুষ। মাঝেমধ্যে এক বোষ্টমী আসত ভিক্ষা মাগতে। চিত্রা নদীর অন্য পারে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে একাকী থাকত। কিছুই ছিল না তার ঘরে। একেবারেই সাদামাটা জীবন। একসময় সে নিরুদ্দেশ! পড়ে থাকে শূন্য কুঁড়েঘর। কোথা থেকে সে এসেছিল আর কোথায় গিয়ে নতুন আস্তানা গেড়েছে তা কারও জানা ছিল না। কি বিচিত্র এদের জীবন! সেই অপরিণত বয়সে এ ঘটনা আমার মনে দাগ কেটেছিল।

আমার সেই গ্রাম আর গ্রাম নেই। পিচঢালা রাস্তা চলে গেছে শহরে। চিত্রা নদীর ওপর পাকা সেতু হয়েছে। গ্রামে পল্লীবিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে অনেক আগেই। ঘরে ঘরে ফ্রিজ, টেলিভিশন। আছে ডিশ সংযোগ। এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগের জন্য আছে ওয়াইফাই। সবার হাতে মোবাইল ফোন। সেই গোলপাতার প্রাইমারি স্কুল এখন দোতলা ভবন। সিঙ্গাশোলপুরের সেই দাতব্য চিকিৎসালয় এখন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। আছেন একজন এমবিবিএস ডাক্তার। ব্যাংক ঋণ এখন কৃষকের দোরগোড়ায়। অনেক এনজিও ঋণ দিচ্ছে। আছে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি। গ্রামে কোনো ভিক্ষুক নেই। এখন আর ডাকে চিঠি আসে না। ডাকপিয়নের জন্য এখন আর কেউ অপেক্ষা করে না। এখন ফেসবুক-মেসেঞ্জার-হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমেই যোগাযোগ বেশি হয়। ভিডিও চ্যাট হয়। গ্রাম আর শহরের ব্যবধান অনেকটাই ঘুচে গেছে।

আমাদের গ্রামীণ জীবন এখন অনেকটাই যন্ত্রনির্ভর। বিজ্ঞানের অগ্রগতি তো অস্বীকার করা যাবে না। বিজ্ঞানের আশীর্বাদকে স্বাগত জানাতেই হবে। আসলে যাযাবরই ঠিক। সেই কবে যাযাবর তার বিখ্যাত ‘দৃষ্টিপাত’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। ভালোবাসি আমার গ্রামকে!

গ্রামের সঙ্গে যে সখ্য সেই শৈশব-কৈশোর থেকে তা কি সহজে ভোলা যায়!

লেখক : পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন।

সর্বশেষ খবর