সোমবার, ১১ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা
পাঠক কলাম

কেউ যেন পার না পায়

মাজহারুল ইসলাম

কেউ যেন পার না পায়

বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল পলাশীর আম্রকাননে। ২৬৪ বছর আগের সেই কালো দিনটি ছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। মীরজাফরের চক্রান্তে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর লর্ড ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘বাঙালিরা তামাশা করা পছন্দ করে। প্রতিটি বাঙালি যদি একটি করে ঢিলও নিক্ষেপ করত তবে পলাশীর ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো’।

আসলে আমরা তামাশা করা জাতি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। পাকিস্তানের সামরিক জান্তাও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দুঃসাহস দেখায়নি। সেই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন স্বদেশে বাঙালিরা হত্যা করবে তা কি কল্পনা করা যায়? বঙ্গবন্ধু কি নিজেও ভেবেছিলেন তাঁকে প্রাণ দিতে হবে কাছের লোকজনের হাতে? বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ ধরে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তাদের স্বগোত্রীয়রা বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়ে লাখ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তাদের গাড়িতে উড়িয়ে মজা লুটেছে। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ মানুষ বুকের রক্ত ঢেলেছে সেই দেশের পবিত্র সংসদ কলঙ্কিত হলো স্বাধীনতা বিরোধীদের পদচারণায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন।

তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের সবাই নিজেদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হন। সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। অনেক জনকল্যাণকর কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছিল। তার পরেও ২০০১ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল আওয়ামী লীগের। ২০০১ সালের পর দেখেছি সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ। সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। সেই দুঃসময়ে যারা জীবনবাজি রেখে ছাত্রলীগ, যুবলীগ আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রেখেছিলেন তারা আজ কোথায় এ প্রশ্ন অনেকের।

রাজনীতিতে ভুলভ্রান্তি থাকতেই পারে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তমের রাজনীতি ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু ১৯৭১ এবং ১৯৭৫-এ তাঁর ভূমিকাকে শত চেষ্টা করেও মুছে ফেলা যাবে না। সেই বঙ্গবীর আজ আওয়ামী লীগে নেই কেন? কী অপরাধ ছিল সোহেল তাজের? যাঁর বাবা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে বঙ্গবন্ধুর জন্য কারও সঙ্গে আপস না করে জেলখানায় শহীদ হলেন। তাঁর পুত্র সোহেল তাজ আজ কোথায়? যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর স্টিম রোলার চালাল তাদের অনেকেই বর্তমানে ভালো অবস্থানে। একই প্রশ্ন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বেলায় করা যায়। পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। অথচ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের সুযোগ সৃষ্টি করতে সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করলেন। কানাডার আদালত পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি এমন এক যুগান্তকারী রায় দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্ক মুক্ত করল। সৈয়দ আবুল হোসেন কোনো দুর্নীতি না করেও রাজনীতির উঁচু সোপান থেকে ঝরে পড়লেন। মন্ত্রিত্ব ফিরে পেলেন না।

সংসদ সদস্য পদেও দলীয় মনোনয়ন পেলেন না। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, পদ্মা সেতুর সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের সবাই বহাল তবিয়তে, শুধু নেই বেচারা সৈয়দ আবুল হোসেন।

বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাঁর সুযোগ্য সন্তান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী। তাঁকে অজ্ঞাত কারণে সরিয়ে দেওয়া হলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে।

তিনি অভিমান করে চলে গেলেন লন্ডনে তাঁর স্ত্রী-কন্যার কাছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে দেশে ফিরে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। সৈয়দ আশরাফের সময়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অর্থ বরাদ্দ এবং লুটপাট নিয়ে মিডিয়ায় কোনো খবর প্রকাশ হয়নি। কারণ তিনি নিজে সৎ ছিলেন। তাঁর অধীন মন্ত্রণালয়কে সৎ রাখতে সফল হয়েছিলেন। প্রশাসনে যোগ্য লোকের মূল্যায়ন হয় না। তথাকথিত দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কাউকে সচিব বানানো, রাজনৈতিক পদ-পদবি দেওয়া খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বঞ্চিত মেধাবীরা ঘাপটি মেরে বসে আছেন। সুযোগ পেলেই পেরেক ঢুকিয়ে দেবেন। যেমনটি দিয়েছিলেন ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে। পরীক্ষিত কর্মীদের এবং প্রশাসনের সৎ যোগ্য লোকদের মূল্যায়ন না করলে পরিণাম ভালো হয় না।

আমরা কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুকে টেনে আনি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা নেই না। তার জীবনাদর্শ কর্মক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করি না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র একই। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুধু মানুষ নয়, ইটপাথরগুলোও এখন সরকারি দলের পরিচয় দেয়। তাদের অনেকে নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন। সরকার সুনামে বিড়ম্বনা ডেকে আনছে।

যাদের ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রলীগ করার ভূমিকা ছিল তারা আজ কোণঠাসা।

সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শেয়ার মার্কেট লুটপাট, হলমার্ক, ডেসটিনি এবং স্বাস্থ্য খাত তথা ক্যাসিনোকান্ডে কারা জড়িত তাদের অতীত ইতিহাস মূল্যায়নের সময় এসেছে।

লেখক : কলাম  লেখক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর