মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা
ইতিহাস

ইতিহাসের একটি মিথ্যাচার

মোহাম্মদ সোহেল

বাংলা বিহার ওড়িশার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৬ সালের ১৬ জুন ৩০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের হাত থেকে কলকাতা জয়ের লক্ষ্যে ফোর্ট উইলিয়ামের প্রবেশদ্বারে উপনীত হন। দুই দিন যুদ্ধের পর ইংরেজ গভর্নর রজার ড্রেক নিশ্চিত হন যে নবাব বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই তিনি ১৯ জুন দুর্গের ইংরেজ বাসিন্দাদের বড় অংশ নিয়ে ফুলতা পালিয়ে যান। হলওয়েল ইউরোপীয় ও আর্মেনীয় সেনা ছাড়াও প্রায় ১৭০ শ্বেতাঙ্গ সৈন্যের একটি দল নিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে থেকে যান। উদ্দেশ্য, যুদ্ধের পরিস্থিতি বহাল রেখে ড্রেকের নেতৃত্বে ফুলতাগামী ইংরেজ বাহিনীকে ফুলতায় প্রত্যাবর্তনে সহায়তা করা এবং পরদিন ফুলতা থেকে তাদের জন্য যে নির্দেশ আসবে তা কার্যকর করা। কিন্তু ইংরেজদের বাহিনীতে বিভক্তি দেখা দেয়। শ্বেতাঙ্গ বাহিনীর ৫৩ ওলন্দাজ সৈন্য রাতের আঁধারে পালিয়ে সিরাজ বাহিনীতে যোগ দেয়। ২০ জুনের সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধে ২৫ জন ইংরেজ সৈন্য নিহত এবং ৭০ জন আহত হয়। ২০ জুনের সন্ধ্যায় নবাবের সৈন্যরা সব দিক থেকে দুর্গের দেয়ালসমূহে সরাসরি আঘাত হানতে থাকলে একজন ওলন্দাজ সার্জেন্ট নদীর মুখের দিকের দুর্গ তোরণটি নবাব বাহিনীর জন্য খুলে দেয়। নবাব বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে গিয়ে তখন কিছু ইংরেজ সৈন্য নিহত হয়। এ অবস্থায় ইংরেজ বাহিনীর নেতা হলওয়েল আত্মসমর্পণ করেন। সিরাজের সৈন্যরা তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। হলওয়েল নবাবের সঙ্গে তিনবার সাক্ষাৎ করেন এবং নবাবের কাছ থেকে তাঁর নিরাপত্তার আশ্বাস লাভ করেন। নবাবের বিজয়ী সৈন্যরা ইউরোপীয়দের মূল্যবান সম্পদ লুণ্ঠন করে বটে, কিন্তু তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেনি। তবে রাতের দিকে কিছু বন্দী ইউরোপীয় সৈন্য নবাব বাহিনীর প্রহরীদের আক্রমণ করে বসলে তাদের ঔদ্ধত্যমূলক আচরণ সম্পর্কে নবাবের কাছে অভিযোগ দায়ের করা হয়। নবাব হলওয়েলের পক্ষের যেসব ইউরোপীয় সৈন্য স্থানীয় প্রহরীদের আক্রমণ করেছিল তাদের আটকে রাখতে নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে হলওয়েল অভিযোগ করেন, নবাব ইউরোপীয় বন্দীদের একটি মাত্র ক্ষুদ্র জানালাবিশিষ্ট ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থবিশিষ্ট একটি কক্ষে আটকে রাখেন। ইউরোপীয় ও ইংরেজদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে জুনের প্রচন্ড গরমের সে রাতে ইউরোপীয় ও ইংরেজ বন্দীদের ওই অন্ধকূপে ঠাসাঠাসি করে থাকতে বাধ্য করা হয়। ফলে সকাল পর্যন্ত শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এবং যুদ্ধাহত অবস্থায় অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ১৪৬ জনের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ১২৩ বলে ইউরোপে প্রচার করা হয় এবং স্বীকৃত হয়। চন্দননগরে পলাতক কিছু ইংরেজের গল্পকাহিনিতে মৃতের সংখ্যা ১২৩ থেকে বাড়িয়ে ২০০ পর্যন্ত বলা হয়।

এ ঘটনায় নবাবের আচরণ কতটা যথার্থ ছিল তা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। বন্দীরা তাদের প্রহরীদের ওপর সহিংস আচরণ করলে আন্তর্জাতিক আইনে তাদের গুলি করার বিধান আছে। তার পরও নবাব ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর সহিংসতায় জড়িত সদস্যদের আটকের ব্যবস্থা করেন। দুর্গের তখনকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নবাবের পক্ষে নিরপরাধদের আইন ভঙ্গকারী অপরাধী সৈন্যদল থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া সম্ভব হয়নি। যুদ্ধ-পরবর্তী সে রাতে বন্দীশালার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল নবাব বাহিনীর সাধারণ সৈনিকরা। পরদিন হলওয়েল ও ইংরেজ কোম্পানির অন্য তিন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ছাড়া সব আটক ইংরেজ সৈন্যকে মুক্তি দেওয়া হয়। নবাব হলওয়েলও এ তিন শীর্ষস্থানীয় ইংরেজ কর্মকর্তাকে মুর্শিদাবাদের কারাগারে বন্দী রাখার নির্দেশ দেন। কিন্তু কয়েক দিন পর নবাব তাদের মুক্তি দেন এবং তারা ফুলতায় ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। অন্ধকূপে তখন শুধু মিসেস কেরি নামে এক শ্বেতাঙ্গিনী কারাবন্দী ছিলেন। তাকেও অনতিবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তিনিও ফুলতায় ইংরেজ বাহিনীতে যোগ দেন। ১৭৫৬ সালের ২৬ জুনের মধ্যে সব জীবিত ইংরেজ ফুলতায় পাড়ি দেয়। যুদ্ধ শেষে রাজধানীতে ফিরে এসে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ফোর্ট সেন্ট জর্জের গভর্নর জর্জ পিগটকে লেখা পত্রে (৩০ জুন ১৭৫৬) ইংরেজদের বাংলায় অবস্থান এবং যুক্তিসংগত শর্তে তাদের বাণিজ্য করার অধিকার দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। ইউরোপীয় বা ইংরেজ মহল থেকে মৃতের যে সংখ্যা দাবি করা হয়েছে তা স্পষ্টতই অতিরঞ্জিত। ইংরেজ বাহিনীর আত্মসমর্পণের তিন ঘণ্টা পরও ১৪৬ জনের মতো ইউরোপীয় যুদ্ধবন্দী যে নবাবের হাতে ছিল সে বিষয়ে মুর্শিদাবাদের ইংলিশ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক লিটল সন্দেহ পোষণ করেন। ১৪৬ ইউরোপীয় সৈন্য নওয়াব বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের কোনো দলিল বা বন্দীদের মাথা গুণে নির্ণয়কৃত মোট সংখ্যার কোনো প্রমাণও পাওয়া যায় না।

অন্ধকূপে বন্দী ইংরেজ সৈন্যদের সংখ্যার যে অতিরঞ্জন পরিলক্ষিত হয় তা পন্ডিত ভোলানাথ চন্দ্রের বৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিনির্ভর পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়। ভোলানাথ প্রমাণ করেছিলেন অন্ধকূপের ২৬৭ বর্গফুট আয়তনবিশিষ্ট ঘরে ১৪৬ জন পূর্ণবয়স্ক ইউরোপীয় সৈন্যের ধারণক্ষমতার বাইরে ছিল। তিনি একটি পরীক্ষার মাধ্যমে ইংরেজদের অভিযোগের অসারতা প্রমাণ করেন। ১৮ ফুট ী ১৫ ফুট আয়তন -বিশিষ্ট একটি স্থানকে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে ইউরোপীয়দের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির ১৪৬ জন বাঙালিকে ঠাসাঠাসি করেও ঢোকাতে তিনি ব্যর্থ হন। ইউরোপীয় বা ইংরেজদের তুলনায় শারীরিক দিক থেকে খর্বকায় সমসংখ্যক বাঙালিকেও তথাকথিত অন্ধকূপের নির্দিষ্ট আয়তনে প্রবেশ করানো সম্ভব ছিল না। অতএব একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তথাকথিত অন্ধকূপে ইউরোপীয়দের মৃতের প্রকৃত সংখ্যা ১৪৬-এর চেয়ে বেশ কম ছিল।

 

 

সর্বশেষ খবর