বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

শারদীয় দুর্গোৎসব

তপন কুমার ঘোষ

শারদীয় দুর্গোৎসব

প্রতি বছরের মতো এ বছরও পালিত হচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসব। আগামীকাল শুক্রবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনব্যাপী এ ধর্মীয় উৎসব। এবার দেবীর ঘোটকে আগমন। দোলায় গমন। এর ফলাফল কী হবে পঞ্জিকায় তার উল্লেখ আছে। পঞ্জিকামতে ফলাফল শুভ নয়। করোনা মহামারীর কারণে গত বছরের মতো এ বছরও সীমিত পরিসরে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। মাস্ক পরে মণ্ডপে প্রবেশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আরতি প্রতিযোগিতা বন্ধ রাখা হয়েছে। থাকছে না সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন। আলোকসজ্জাও সীমিত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তার পরও ঢাকের বোল, শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে মণ্ডপগুলোয়।

রংবেরঙের পোশাকে বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনাগোনায় মুখর পূজাপ্রাঙ্গণ। বড়দের হাত ধরে ছোট্ট শিশুরাও এসেছে পূজা দেখতে। রাজধানীর ইস্কাটন সর্বজনীন দুর্গাপূজা উদ্যাপন কমিটি আয়োজিত অস্থায়ী পূজামণ্ডপে দেখা হলো প্রবীণ ব্যাংকার নারায়ণচন্দ্র দত্তের সঙ্গে। এন সি দত্ত নামেই বেশি পরিচিত তিনি। বয়স ৮৫-এর গণ্ডি পেরিয়েছে। তিন প্রজন্ম একসঙ্গে বেরিয়েছেন প্রতিমা দর্শনে। আহা! কী আনন্দ! দলে কচিকাঁচা, ছেলেবুড়ো মিলিয়ে জনা সাতেক হবে। একান্নবর্তী পরিবার। এ যুগে যৌথ পরিবার খুব একটা দেখা যায় না। দেখে ভালো লাগল।

দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, এ কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। সত্তরোর্ধ্ব লিলি রানী রক্ষিত। থাকেন নড়াইলে। ছেলেবেলার স্মৃতিচারণা করে বললেন, ‘আমরা ছিলাম ১০ ভাইবোন। সবাই পিঠাপিঠি। পূজার আগে সব ভাইবোনকে দর্জির দোকানে নিয়ে যেতেন বাবা। মাপ নিয়ে পুজোর পোশাক বানিয়ে দিতেন আবুল দর্জি। পূজায় মাত্র এক সেট নতুন পোশাক পেয়েই আমাদের সে কী আনন্দ! আর এখনকার ছেলেমেয়েরা পূজায় পাঁচ-ছয় সেট পোশাক পায়। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার কত যে পরিবর্তন তা নিজ চোখে দেখলাম!’

আমাদের ছোটকালে দেখেছি পূজা শুরুর দিনকয়েক আগেই দর্জির দোকানে অর্ডার নেওয়া বন্ধ। সারা রাত দোকানে কাজ হতো। মহাব্যস্ত দর্জিরা। কথা বলার ফুরসত নেই। মাপ নেওয়ার সময় আবুল দর্জি খুব তাড়াহুড়া করতেন। ফলে যা হওয়ার তাই হতো। যথারীতি জামার হাতা খাটো। তৈরি পোশাকের চল তখনো হয়নি। এখন আর্থিক সংগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ এখন অনেক বেশি ফ্যাশন-সচেতন। এ ব্যাপারে পুরুষের তুলনায় এগিয়ে নারীরা। যাদের সংগতি আছে তারা পূজায় প্রতিদিন নতুন শাড়ি পরেন। আর সকালে এক শাড়ি তো বিকালে অন্য শাড়ি পরেন বিত্তবান পরিবারের নারীরা। একেক দিনের সাজ একেক রকম। পূজায় সাজ-পোশাক, রূপচর্চা, মেকআপ, খাবার-দাবার নিয়ে পত্রিকার পৃষ্ঠাজুড়ে থাকে ফিচার।

কিশোর বয়সে দেখেছি বিজয়া দশমীর পর বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে আত্মীয়স্বজনদের কাছে চিঠি লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন আমার বাবা। তখন পোস্টকার্ডেই ব্যক্তিগত চিঠি আদান-প্রদান হতো বেশি। রিপ্লাই পোস্টকার্ডও ছিল। আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকেও চিঠি আসত। বাড়িতে চিঠি এলে তা পড়ার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠত। চিঠি নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যেত। একজন পড়ত এবং অন্যরা তা আগ্রহভরে শুনত। হাতে লেখা চিঠির গুরুত্বই ছিল আলাদা। প্রাণের ছোঁয়া ছিল। চিঠিপত্র বিনিময়ের মধ্যে একটা আন্তরিকতা ছিল। এখন ফেসবুক-মেসেঞ্জার-হোয়াটসঅ্যাপে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। তবে সেই আন্তরিকতার ছোঁয়া আর পাই না। গৎবাঁধা কথা। ধার করা একই বার্তা ঘুরেফিরে আসে। প্রাণহীন শুভেচ্ছা বার্তায় কোনো আনন্দ নেই। এতে সাড়া দিতেও মন সায় দেয় না। জীবনটা বড্ড বেশি যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। মানুষ তো আর রোবট নয়। মানুষের আবেগ আছে, রোবটের নেই। মানুষ এবং যন্ত্রের মধ্যে এটাই বড় পার্থক্য। যন্ত্র মানুষেরই সৃষ্টি। এতসব সত্ত্বেও বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে তো মানতেই হবে। আজ আমরা চিঠি লেখা ভুলে গেছি। একদিন হয়তো কলমের ব্যবহারই উঠে যাবে।

ছোটকাল থেকে পড়ে আসছি মানুষ সামাজিক জীব। কিন্তু সেই সামাজিক বন্ধন এখন অনেকটাই শিথিল। একই ছাদের নিচে বাস করেও আমরা কেউ কাউকে চিনি না। দেখা হলেও কুশল বিনিময়ে সংকোচ। বছর ঘুরতে গেল আমরা একই ভবনে বাস করছি। অথচ এইমাত্র সেদিন বরুণচন্দ্র বণিকের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও পরিচয় হলো ইস্কাটনের পূজামণ্ডপে। সামাজিক জীবন কি এতটাই গুরুত্বহীন? এ কেমন সমাজ! মানুষ কি শুধু আহার, নিদ্রা আর যৌনতায় বাঁচে? প্রযুক্তি হয়েছে আমাদের ২৪ ঘণ্টার সঙ্গী। প্রযুক্তি আমাদের নিঃসঙ্গ করে দিচ্ছে। একাকিত্বের সমস্যা আজ বিশ্বব্যাপী। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বা আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানো আমরা এখন এড়িয়ে চলি। ব্যস্ততার অজুহাত দেখাই। কারও সময় নেই। না আমার, না তার। জনপ্রিয় একটি ঝুমুর গানের সেই লাইনটা কানে বাজে- ‘চিঠিতে কি ভুলে মন বিনা দরিশনে!’ সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিও কল কি ‘মুখোমুখি বসিবার’ সেই অভাব পূরণ করতে পারে?

লেখক : পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর