রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

টেকসই পাহাড়ি কৃষি ব্যবস্থাপনা

ড. মো. জামাল উদ্দিন

টেকসই পাহাড়ি কৃষি ব্যবস্থাপনা

টেকসই কৃষি খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম হাতিয়ার। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় পাহাড়ি কৃষির অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। বৈচিত্র্যময় ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পাহাড়ি কৃষি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পাহাড়ি কৃষির গুরুত্ব অনেক। পাহাড়ি এলাকায় ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার মধ্যে ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও পানি ব্যবস্থাপনা অন্যতম। এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত ফসল সংগ্রহপূর্ব ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই দমন ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদিত ফসলের বিপণন ব্যবস্থাপনাকে টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার মানদন্ড বলা যায়। কোনোটি বাদ দিয়ে বা কোনোটি কম গুরুত্ব দিয়ে টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার পরিপূর্ণতা আসে না। পাহাড়ি কৃষি এমনিইতে সমতল থেকে ভিন্নতর প্রকৃতির।

এখানকার ভৌগোলিক অবস্থান, ভূমির বন্ধুরতা, বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাস, কৃষ্টি-কালচার ভিন্ন রকম। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে টেকসইতা নিশ্চিতের জন্য সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত রোডম্যাপ প্রণয়ন দরকার।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল তথা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি উদ্যান তাত্ত্বিক ফসলের জন্য বেশি উপযোগী। তিন পার্বত্য জেলায় ৪৩ রকমের বেশি প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের আবাদ হয়। ২০১৯-২০ সালে মোট ১ লাখ ৯৬২ হেক্টর জমিতে ফলের আবাদ হয়েছে যার মোট উৎপাদন ১৭ লাখ ৫৩ হাজার ৪২১ মেট্রিক টন। অন্যদিকে ২০২০-২১ সালে শুধু আমের আবাদ হয়েছে মোট ১৪ হাজার ৪৪১ হেক্টর এলাকায় যার মোট উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ১৫৪ মেট্রিক টন। এটা সুখবর যে পাহাড়ি এলাকায় বছরের পর বছর ফলের মোট উৎপাদন বেড়েই চলেছে। পাহাড়ি এলাকায় ফসল উৎপাদনের প্রধান সমস্যা উৎপাদনশীলতা ও ফসলের নিবিড়তা কম। এর বহুবিধ কারণ রয়েছে। ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় এলাকাভিত্তিক চাহিদ অনুসারে সারা বছর ফসল ফলে এ রকম ফসলধারা অনুসরণ করা উচিত। অলাভজনক শস্য পর্যায় চিহ্নিত করে লাভজনক ফসলধারা প্রবর্তন করা যেতে পারে। একই জমিতে বারবার একই ফসল আবাদ না করে অন্য লাভজনক ফসল আবাদ করা যেতে পারে। যে এলাকায় যে ফল ভালো হয় সে এলাকায় সেসব ফলের আবাদ বাড়ানো গেলে একত্রে অনেক ফলের সমাহার ঘটবে। তাতে বিপণন সুবিধা বাড়বে। ক্ষুদ্র প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হবে। এর জন্য এলাকাভিত্তিক ফ্রুট জোনিং করা যেতে পারে। জুম চাষকে অধিক উৎপাদনক্ষম করতে উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত অন্তর্ভুক্ত করাসহ সার ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা জরুরি। জুম চাষের বিকল্প হিসেবে ফলদ বাগান বা কফি ও কাজুবাদামের বাগান সৃজন করা যেতে পারে। শস্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এক ফসলি জমিকে দুই ফসলি, দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা গেলে ফসলের নিবিড়তা বাড়বে। উপযুক্ত খামার পদ্ধতি অনুশীলনপূর্বক কৃষকের সারা বছর অর্থসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। পাহাড়ি কৃষিভূমির উর্বরতা শক্তি কম। এটি একটি সমস্যা। পাহাড়ের ঢালুভেদে উর্বরতা শক্তি কমবেশি হয়। পাহাড়ের ঢালু যতই খাড়া হয় উর্বরতা শক্তি ততই কম হয়। তাই অতি উঁচু ঢালুতে বনজ গাছ লাগানোর সুপারিশ করা হয়। পাহাড়ি ভূমির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য ফলদ বাগানে আন্তফসল হিসেবে লিগুমিনাস জাতীয় ফসলের আবাদ করা যেতে পারে। ভূমি ক্ষয়রোধের জন্য উপযুক্ত কভার ক্রপ চাষ করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে কম্পোস্ট সারের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত। পাহাড়ের ঢালু অনুযায়ী ফসলভিত্তিক সুপারিশকৃত সারের মাত্রা নির্ধারণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি কৃষকের জানা দরকার।

এফএও (২০১৯) মতে, পার্বত্যাঞ্চলে ১৩ লাখ ২৪ হাজার ৪২৮ হেক্টর ঢালু ভূমি রয়েছে। ঢালুভেদে ফসলের উপযোগিতাও ভিন্ন। ঢালু উপযোগী ফসল লাগালে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। বন্যাবিধৌত ও সমতল ভূমির পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৮১২ হেক্টর যা সমগ্র পার্বত্যাঞ্চলের শতকরা ৩.২ ভাগ। যার মাত্র শতকরা ১৯ ভাগ জমিতে সেচ সুবিধা বিদ্যমান। এসব সমতল ভূমি অপেক্ষাকৃত বেশ উর্বর থাকে। সেখানে বিভিন্ন রকম সবজি, ভুট্টা, আখ আবাদ হয়। তবে এসব জমিতে তামাক চাষের কারণে সবজি আবাদ এলাকা কমে গেছে। আন্তফসলসহ ভুটা ও আখ চাষ তামাকের বিকল্প হতে পারে। তবে এর জন্য বাজারজাতকরণ সুবিধা বাড়াতে হবে। টেকসই কৃষির জন্য পানি ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কৃষি উৎপাদনের প্রধানতম সমস্যা শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব। সেচ সুবিধার অভাবে ফসলের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। পতিত ভূমি আবাদের আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়ে। পাহাড়ের বেশির ভাগ ফসল বৃষ্টিনির্ভর। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের সহজ প্রযুক্তি উদ্ভাবন দরকার, জলাধার বা ঝিরিতে বাঁধ দিয়ে পানি ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে। পানির প্রাপ্যতা সহজ হলে মোট উৎপাদন বাড়বে বহুগুণে। শুধু উৎপাদন বাড়লেই হবে না সেসব ফসলের অপচয় রোধের জন্য শস্য সংগ্রহপূর্ব ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কৃষককে দক্ষ করে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়িয়ে পরিবেশ সুরক্ষা করে জীববৈচিত্র্য ঠিক রাখাও দরকার। টেকসই কৃষি তখনই পূর্ণতা পাবে যখন কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়ে অধিক উৎপাদনে আগ্রহী হবে আর ভোক্তা মানসম্মত কৃষিপণ্য পেয়ে খুশিতে বলে উঠবে- পাহাড়ি কৃষি পণ্য/কিনে হও ধন্য।

 

লেখক : সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বারি)।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর