সোমবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

গিটার যখন কাঁদে

হোসেন আবদুল মান্নান

গিটার যখন কাঁদে

তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে এক শোকাবহ আবহ সৃষ্টি হয়েছিল দেশব্যাপী। সেদিন দেশের একটি ইংরেজি দৈনিক শিরোনাম করেছিল ‘A South Asian Rockstar passes away’। তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে জনপ্রিয়তায় আকাশ ছুঁয়েছিলেন তিনি। দেশীয় সংগীতাঙ্গনের ভিতর থেকেই দীর্ঘ সাধনায় ধীরে ধীরে উঠে আসেন সুরের ঐন্দ্রজালিক ভুবনে।  প্রতিষ্ঠা পান মস্তবড় এক গিটারবাদক (guitarist) ও আধুনিক ব্যান্ড সংগীতের রকস্টার (rockstar) শিল্পী হিসেবে। ছাত্রাবস্থাতেই আধুনিক ব্যান্ড সংগীতের দিকে ঝোঁক ছিল তাঁর। গিটার বাজানোটা প্রথমে শখ ও পরে নেশায় পরিণত হয়েছিল তাঁর। যা দেশে এবং দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁকে এক সময়ে এসে কিংবদন্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। পাহাড়-পর্বত-সমুদ্রে-বন্দরে ঘেরা জনপদ চট্টগ্রামের মাটিতে জন্ম নেওয়া আরও অনেক সংগীত শিল্পীর মতো প্রয়াত ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুও পারিবারিক পরিমন্ডলেই হাতেখড়ি পান। চট্টগ্রামই তাঁর বেড়ে ওঠার মূল আঁতুড়ঘর এবং পূর্বপুরুষের ঠিকানা। তাঁর শৈশব-কৈশোর, সতীর্থ সহকর্মী প্রিয়জন স্কুল-কলেজ সবকিছুই সেখানকার।

২) দুটো কারণে তাঁর প্রতি আমি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করতে চাই। তাঁর জন্ম ১৯৬২ সালে আমারও ১৯৬২ সাল। তাঁর নাম বাচ্চু আমারও nick name বাচ্চু। জীবনে একবার মাত্র তাঁর সঙ্গে আমার কয়েক মিনিটের কথোপকথন হয়। সেদিন তাঁর সাহসী সিদ্ধান্ত বা ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ ও প্রাণিত করেছিল।

২০১১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘বিজয় কনসার্ট’ নামে এক সংগীত সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসনও যথারীতি এতে অনুমোদন দেয়। স্থানীয় নিয়াজ মুহাম্মাদ স্টেডিয়ামে এ অনুষ্ঠান হবে। আমন্ত্রিত হন ব্যান্ডতারকা আইয়ুব বাচ্চু ও জনপ্রিয় শিল্পী মিলা। কদিন থেকেই প্রচার-প্রচারণা, মাইকিং, পোস্টারিং চলছে। ১৮ ডিসেম্বর বিকাল থেকে কনসার্ট শুরু হবে। এদিকে অনুষ্ঠানের দিন সকাল থেকে শহরের সর্বত্র মাদরাসা ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিলের ঢল নামে। গান-বাজনা নাজায়েজ কাজ এখানে এসব চলবে না। মেয়ে শিল্পী আসবে সে তো আরও গর্হিত কাজ। সুতরাং ডিসির চামড়া তুলে নিব আমরা, ডিসির বাড়িতে আগুন জ্বালো একসঙ্গে ইত্যাদি, ইত্যাদি। বয়সে শিশু ও কিশোরের সংখ্যা বেশি। পাজামা, পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি হাজার হাজার নিষ্পাপ এতিম সন্তানদের রাস্তায় নামিয়ে দেয় স্থানীয় মৌলবাদের দোসর ও পৃষ্ঠপোষকরা। শহরের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তব্যাপী সশব্দ মিছিলে প্রকম্পিত। সহসাই জনমনে নেমে আসে আতঙ্ক ও ভীতি। পথচারীরা পর্যন্ত দ্রুত ঘরমুখো হচ্ছে। সেøাগানে সেøাগানে মুখরিত হয়ে উঠে শহরের কাউতলী থেকে রেলক্রসিং পার হয়ে টিএ রোড পর্যন্ত। ঘোষণা একটা বিজয় দিবস হোক আর স্বাধীনতা দিবস ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসব চলবে না। হুজুরদের কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি। জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে শত শত মিছিলকারীর অবস্থান। ভিতরে ঢিল ছুড়ছে, এদের জুতা, সেন্ডেলের স্তূপ জমে যায় আমার বাংলোর গেটে। অন্যদিকে এসব লাইভ প্রদর্শিত হচ্ছে বেসরকারি টেলিভিশনের স্ক্রলে।

৩) সেদিন উদ্যোক্তাদের কথায় এ.বি. ভরসা পাচ্ছিল না। দুপুরে একপর্যায়ে আমাকে ফোন করলেন তিনি। ভাই এসব কী দেখছি? আসা কি ঠিক হবে? গান করা সম্ভব কি ইত্যাদি। আমি তাঁকে গ্যারান্টি দিয়ে বলি, আপনি আসবেন এবং স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠান হবে। আমি এবং পুলিশ সুপার পুরো সময়টা আপনার মঞ্চের কাছাকাছি থাকব। আপনার কোনো ভয় নেই, আঁচড় লাগতে দিব না। সব দায়িত্ব প্রশাসন নিয়েছে। মনে রাখবেন ভাই, এসব স্বাধীনতাবিরোধীদের চেয়ে আমাদের সরকার অনেক শক্তিশালী। আমার কথায় তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন এবং স্থির হলো হেলিকপ্টারযোগে দুজনই আসবেন। আমি যেন হঠাৎ করে অকুতোভয়, দুঃসাহসী ও দৃঢ় মনোবল ফিরে পাই। কথা বলি স্থানীয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সঙ্গে। বিলম্ব না করে আমি তাঁর গ্রামের বাড়িতে চলে যাই এবং তাঁর মাধ্যমে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের সঙ্গে আলাপ করি। একই সঙ্গে আলাপ করা হলো স্বরাষ্ট্র সচিব মঞ্জুর হোসেন এবং মন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে। বিদ্যমান পরিস্থিতির সবিস্তর বর্ণনা দিতে গিয়ে পুলিশ সুপারের আকস্মিক কর্মস্থল ত্যাগের দুঃসংবাদটিও দেওয়া হলো। শুনে অবাক হলেন তিনি। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলেন আইজিপি। পুলিশ সুপারকে ঢাকার কাছাকাছি থেকে ফিরিয়ে আনলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কঠোর অনুশাসনের ফলে কুমিল্লা থেকে কয়েক ব্যাটালিয়ন আর্ম পুলিশ মোতায়েন করা হলো শহরজুড়ে। মাদরাসাগুলোর সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি করা হলো। দেখা গেল, আস্তে আস্তে মিছিল-মিটিং প্রশমিত হতে থাকে। শহরের পরিবেশ দ্রুত অনুকূলে চলে আসে। দেখা গেল আলো ঝলমলে পড়ন্ত বিকালে ঢাকা থেকে একটি প্রাইভেট হেলিকপ্টার নিয়াজ মুহাম্মাদ স্টেডিয়ামের মাটি স্পর্শ করে। বেরিয়ে আসেন ব্যান্ড সংগীতের যুবরাজ সেই চিরচেনা ক্যাপ পরিহিত আইয়ুব বাচ্চু হাতে গিটার। সফরসঙ্গী মিলা। অল্পক্ষণের মধ্যে মাঠে উপচে পড়া তারুণ্যের জয়জয়কার। স্কুল, কলেজের ছাত্রছাত্রীসহ সাধারণ মানুষের সমাবেশে পরিণত হয়। কানায় কানায় পূর্ণতা পায় নিয়াজ স্টেডিয়াম। জেলা প্রশাসক হিসেবে অনুষ্ঠানের সূচনালগ্নে রেওয়াজ মতো সামান্য দুকথা বলি। মজার ব্যাপার হলো, সন্ধ্যার আগেই জেলা পুলিশ সুপারের পল্লীগীতি দিয়ে সেই কাক্সিক্ষত সংগীতানুষ্ঠান শুরু হলো। পরে জানা যায়, মিছিলে অংশ নেওয়া অসংখ্য মাদরাসা ছাত্রও আইয়ুব বাচ্চুর গগনবিদারী কণ্ঠস্বরে তাদেরও কণ্ঠ মেলায়।

৪) আইয়ুব বাচ্চুর সংগীত জীবন ও তাঁর জনপ্রিয় গান সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই সীমিত। কারণ গানের শ্রোতা হিসেবে আমি এখনো সেকেলে বলা যায়। বাংলা গান মানে ষাট-সত্তর দশকের বাণী, সুর এবং কণ্ঠের হিরন্ময়তা নিয়ে আজও মেতে থাকা মানুষের একজন আমি। দেশে আনোয়ার উদ্দিন খান থেকে মুহাম্মাদ আবদুল জব্বার, সুবীরনন্দী পর্যন্ত এবং গীত রচনায় আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মাসুদ করিম ও মনিরুজ্জামান থেকে পরবর্তীদের বাণীসর্বস্ব গানও শুনি। ওপার বাংলায় হেমন্ত, তালাত, মানবেন্দ্র, মান্নাদে, কিশোরে আজও মুগ্ধ আমি। একই সঙ্গে গীতিকবি হিসেবে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর সলিল চৌধুরীতে বিভোর হয়ে থাকা অনেকের মধ্যে আমিও একজন। কাজেই ব্যান্ড, রক গান আমাকে আকৃষ্ট করার কোনো অবকাশ নেই। তবে আইয়ুব বাচ্চুর জীবনাবসানের পর আমি বিস্মিত হই তাঁর ভক্ত-অনুরাগীর সংখ্যা দেখে। ১৯ অক্টোবর ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের বিখ্যাত জামিয়াতুল ফালাহ্ মসজিদ মাঠে তাঁর জানাজায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি এবং তাঁকে এক পলক দেখার জন্য ভক্তদের অভূতপূর্ব আকুতি আমাকে ভাবনায় ফেলে দেয়। আমি তাঁর সংগীত চর্চা ও গভীরতা খোঁজ নিতে থাকি। বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে সেদিন জানাজায় আমিও অংশ নিই এবং এ শিল্পীকে নিয়ে দু-চার কথা বলতে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই ঘটনা উল্লেখ করি। জানাজায় উপস্থিত হাজারো তরুণের মাঝে আমি বেদনাভরা হাহাকার লক্ষ্য করেছিলাম।

৫) ছাপ্পান্ন বছর বয়সে এই মহাতারকার অকাল প্রয়াণ আমাদের ক্রম-রূপান্তরিত সংগীত জগৎকে প্রচন্ড জোরে নাড়া দিয়ে যায়। যেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে তারুণ্য-হৃদয় অপ্রত্যাশিত হোঁচট খায়। আমি আমার সন্তানদের কাছ থেকেও তাঁকে নিয়ে প্রচলিত হয়ে উঠা জনশ্রুতিগুলো উপভোগ করে থাকি। দেশে-বিদেশে গিটার বাজানোর গল্প, কাহিনি, মাতৃভূমির প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভালোবাসার কথা, তাঁর মায়ের কথা, মায়ের গান, জীবনের কথা সবকিছু উঠে এসেছে তাঁর নিজের তৈরি করা সুর ও লিরিকের ভিতর। অসংখ্য একক অ্যালবাম প্রকাশের মাধ্যমে জীবদ্দশায় তুমুল জনপ্রিয়তা দেখে গেছেন এই নক্ষত্র। প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবেও তিনি বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন সোলস এবং এলআরবি (love runs blind) তে। এলআরবির সঙ্গে তাঁর সুদীর্ঘ সাতাশ বছরের বন্ধন ছিল। মূলত লিড গিটারিস্ট হয়ে কাজ করেছেন। মাঝে মধ্যে ভাবী, তাঁর কোন প্রতিভার গল্প প্রজন্মান্তরে বেশি দিন বেঁচে থাকবে, একজন লিড গিটারিস্ট হিসেবে, ভোকালিস্ট হিসেবে নাকি কম্পোজার হিসেবে? তবে সময়ের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে তাঁর বেলায় এর কোনটা প্রাধান্য পাবে।

৬) সুরের ইন্দ্রধনু-লগ্ন বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে ২০১৬ সালের মে মাসে R TV--তে প্রচারিত এক যুগলবন্দী স্মরণ করার মতো। প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী গেয়েছেন ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’ ...অসাধারণ রাগাশ্রয়ী এক পুরনো গান এটি। সঙ্গে গিটারে জাদুকরী ছন্দমাধুর্যে ভরে দিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। যেন দুই সাধক কীর্তিমানের অব্যক্ত ও নীরব প্রতিযোগিতা। ইউটিউব অন্বেষণ করে যে কেউ এই পান্ডিত্যপূর্ণ সুরের ঝঙ্কার উপভোগ করতে পারেন। এ.বি’র অনুশীলন, শ্রম এবং সাধনা ছিল প্রশ্নাতীত। সত্যি বললে, এ জায়গায় সমকালীনরা তাঁর সমকক্ষ হতে পারেননি। এটা কোনো অত্যুক্তি বা পক্ষপাতিত্বের কথা নয় বরং রূঢ় বাস্তবতা। তাঁর এমন প্রস্থান সহজে মেনে নেওয়া যায় না, কেননা আরেকজন এ.বি’র জন্য আমাদের তারুণ্য কতকাল অপেক্ষমাণ থাকবে তা কেবল অনাগত ভবিষ্যৎই জানে। জয়তু এ.বি।

 

লেখক : গবেষক ও গল্পকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর