মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের পাসিং আউটের সুবর্ণজয়ন্তী

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অব.)

প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের পাসিং আউটের সুবর্ণজয়ন্তী

৯ অক্টোবর ১৯৭১। শরতের এই সকালে ডুয়ার্সের মেঘমুক্ত সুনীল আকাশে রোদের ঝলকানি। ভারত-ভুটান সীমান্তের কাছে স্থাপিত মূর্তি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ক্যাডেট খোন্দকার মো. নূরুন্নবী দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘার ধবধবে সাদা বরফের উঁচু চূড়া দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মুগ্ধ বিস্ময়ে। ততক্ষণে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সতীর্থ ক্যাডেট এম মাসুদুর রহমান, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, শাহরিয়ার হুদা ও ওয়াকার হাসান। পাঁচ টগবগে তরুণ ও দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা অভিভূত হলেন হিমালয়ের এই অসাধারণ দৃশ্য দেখে। ১৪ সপ্তাহের কঠোর প্রশিক্ষণের পর আজই কয়েক ঘণ্টা পরে হবে প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের প্রার্থিত পাসিং আউট প্যারেড বা সমাপনী কুচকাওয়াজ। এ ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রকৃতির এ অপরূপ দৃশ্যাবলি ক্যাডেটদের মনে পাসিং আউটের রোমাঞ্চকর উত্তেজনা আরও যেন বাড়িয়ে দিল।

এটি ছিল আশ্চর্য রকম এক পাসিং আউট প্যারেড অনুষ্ঠান। সেদিন ছিল না বিউগলের ধ্বনি, বাদক দলের সংগীতের মূর্ছনা। ছিল না নজরকাড়া কুচকাওয়াজ, অশ্বারোহী অ্যাডজুট্যান্টের প্যারেড পরিচালনা ও ঐতিহ্যবাহী সাজসজ্জা। তবু খুব অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক মাইলফলক ঘটনা।

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে সামরিক অফিসারদের সংখ্যাবৃদ্ধি ও তরুণ প্রশিক্ষিত নেতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৭১-এর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীর প্রথম অফিসার ব্যাচের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন, যা ছিল কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। বাঙালি সামরিক অফিসারদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী মূর্তি নামক স্থান নির্বাচন করে। মূর্তির অবস্থান হলো পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে, ভারত-ভুটান সীমান্তের বেশ কাছে। সিকিম সীমান্তও খুব কাছে। চারদিকে বেশ উঁচু পাহাড়ের সারি, তার মধ্যে মালভূমির মতো স্থান। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অনেক চা বাগান। সমতলভূমি থেকে প্রায় ১ হাজার ফুট উঁচুতে, একটা এবড়ো-থেবড়ো সমতলভূমিতে প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলা হয়। জুনে ভারতের আলফা সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার বিসি যোশীর পরিচালনায় এখানে গড়ে ওঠে অফিসার প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তথা অস্থায়ী সামরিক একাডেমি। ২৯ জুন ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। রণাঙ্গন থেকে নির্বাচিত এই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার বেশির ভাগই ছিলেন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কয়েকজন ছাড়া তাদের বয়স ছিল ১৯ থেকে ২১-এর মধ্যে। গোটা দলই ছিল এক অপূর্ব মিশ্রণ। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। ১৪ সপ্তাহব্যাপী এ প্রশিক্ষণে ক্ষুদ্রাস্ত্র, রণকৌশল, নেতৃত্ব এবং বিশেষত গেরিলা প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার, জেসিও এবং এনসিওদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দক্ষ ও চৌকস প্রশিক্ষক দল প্রশিক্ষণ প্রদানে নিয়োজিত ছিল। ক্যাডেটদের বাসস্থান, খাবার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল খুবই সাধারণ মানের। টিনশেড ব্যারাকে তারা থাকতেন। ক্যাডেটদের মশারি ছিল না। সন্ধ্যার পর হারিকেনের আলোয় চলতে হতো। দেশের জন্য এই তরুণরা জীবন দিতে এসেছেন তাই এসব নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ ছিল না। জোঁক, বৃষ্টি আর শারীরিক ক্লান্তি নিয়েই চ্যালেঞ্জিং প্রশিক্ষণ।

ক্যাডেটদের তাত্ত্বিক ক্লাসগুলো নেওয়া হতো গাছতলায়। এসব তরুণকে যেহেতু সরাসরি যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতে হবে তাই প্রশিক্ষণে ব্যবহারিক দিক ও বাস্তব মহড়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ক্যাডেটদের কোনো প্রেসি বা প্যামপ্লেট ছিল না। মূর্তির প্রশিক্ষণটি সংক্ষিপ্ত হলেও যুদ্ধের জন্য তরুণ অফিসারদের প্রস্তুতির বিবেচনায় এটি ছিল এক অসাধারণ প্রশিক্ষণ।

অবশেষে এলো ক্যাডেটদের প্রত্যাশিত সেই পাসিং আউটের দিন। ৯ অক্টোবর। শরতের রৌদ্রময় সকাল ৯টায় ক্যাডেটরা খাকি শার্ট, ফুলপ্যান্ট, আর জঙ্গল বুট পরে ফুটবল মাঠে (এয়ার ফিল্ড) পাসিং আউট প্যারেডের জন্য উপস্থিত হলেন। ক্যাডেটদের বেল্ট বা টুপি ছিল না। সকাল ৯টার কিছু পর এলেন অভ্যাগত অতিথিরা। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী, ৬ নম্বর সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার এম কে বাশার এবং কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির প্যারেড পরিদর্শনের পর ক্যাডেটরা একে একে মার্চ করে প্রেসিডেন্টের হাত থেকে ‘কমিশনের সনদ’ গ্রহণ করলেন। ক্যাডেট সায়ীদ আহমদ ‘শ্রেষ্ঠ ক্যাডেট’ নির্বাচিত হয়ে গ্রহণ করলেন কমান্ডার ইন চিফের কেইন। এরপর রাষ্ট্রপতির ভাষণ ও জাতীয় ধ্বনির মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত পাসিং আউট প্যারেডের সমাপ্তি ঘোষণা হলো। দুপুরে স্থানীয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার মেসে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। এই নবীন ও দুর্ধর্ষ সেকেন্ড লেফটেন্যান্টদের (সে. কে.) পোস্টিং হয়েছিল জেড ফোর্স, কে ফোর্স, এস ফোর্সের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ১১টি সেক্টরে। সে. লে. শেখ কামালের (পরবর্তীতে ক্যাপটেন) পোস্টিং হয়েছিল কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে বাংলাদেশ ফোর্সেস সদর দফতরে। ৮ অক্টোবর ক্যাডেট ওয়ালী উল ইসলাম (পরে মেজর, প্রয়াত) একটা নোটবুকে মূর্তি ছেড়ে যাওয়ার আগে সবার সংক্ষিপ্ত মন্তব্য বা অভিব্যক্তি সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন। ‘অমলিন মূর্তির বন্ধন’ নিয়ে ৫০ বছর পর মেজর জেনারেল জামিল ডি আহসান, বীরপ্রতীক (অবসরপ্রাপ্ত) বিস্তারিত লিখবেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন অনবদ্য স্মৃতিকথায়... (ফিরে দেখা একাত্তর : ’৭১-এর ছেঁড়া পাতা- ফেসবুক থেকে প্রাপ্ত)।

১৯৭১-এর নভেম্বর থেকে মূর্তিতে দ্বিতীয় বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের ৭০ জন ক্যাডেটের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এ ক্যাডেটরাও ছিলেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। তবে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলে তাঁরা ফেব্রুয়ারিতে (১৯৭২) প্রশিক্ষণ শেষ করে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। পরে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ব্যাটেল স্কুলে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ৫ আগস্ট ১৯৭২ সালে এ কোর্সের ৪৭ জন্য ক্যাডেট সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করে।

প্রথম ওয়ার কোর্সের অফিসাররা যুদ্ধে যোগদানের পর রণাঙ্গনে যুদ্ধের নতুন মাত্রা ও গতি সংযোজিত হয়। মূর্তি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুঃসাহসিক সেনা কর্মকর্তারা যুদ্ধের মাঠে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে পরিণত হন মূর্তিমান আতঙ্কে। যুদ্ধরত পূর্বসূরি বাঙালি সামরিক অফিসারদের মতো রণাঙ্গনে তাঁরাও একেকজন যুদ্ধদেবতায় পরিণত হন। অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শনপূর্বক এ কোর্সের একজন অফিসার বীরউত্তম, দুজন বীরবিক্রম ও ১৭ জন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত হন। স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হন সে. লে. এ এম এম আশফাকুস সামাদ ও সে. লে. খন্দকার আজিজুল ইসলাম। সে. লে. সেলিম কামরুল হাসান ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে মিরপুর মুক্তকরণ অভিযানে স্বাধীনতাবিরোধী অবাঙালিদের গুলিতে শহীদ হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম ওয়ার কোর্সের ভূমিকা ইতিহাসে উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত থাকবে। স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনী গঠনেও এ কোর্সের তরুণ অফিসাররা অসাধারণ অবদান রাখেন। তাঁরা একটি নতুন দেশে নতুন সেনাবাহিনী গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। এ কৃতিত্ব অসামান্য।

২০১০ সালের মার্চে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৌজন্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়ার কোর্সের বেশ কিছু অফিসার সস্ত্রীক মূর্তি সফর করেন। সেটি ছিল এক সেন্টিমেন্টাল জার্নি। প্রায় ৪০ বছর পর প্রায় ৬০ বসন্ত উত্তীর্ণ মুক্তিযোদ্ধারা মূর্তির পাহাড়ে এসে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। ডুয়ার্সের পাহাড়, অরণ্য, চা বাগান ও নদীতে ডুবুরির মতো হাতড়ে খোঁজেন ফেলে আসা স্মৃতির মণিরত্ন। তাদের মনে পড়ে প্রচন্ড কষ্টকর প্রশিক্ষণের কথা, জলঢাকা অরণ্যে অ্যামবুশ অনুশীলন, রাত্রিকালীন অনুশীলনে চা বাগানে ভয়ংকর হস্তীবাহিনীর মুখোমুখি হওয়া, মূর্তি নদীতে হারানো রাইফেল খোঁজার দুঃসহ অভিযান, খাবারের কষ্টে নদী পেরিয়ে নিষিদ্ধ বাজারে গমন, কমনরুমে সন্ধ্যার পর হারিকেনের আলোয় স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শোনা...। মূর্তির সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এখন কোনো সামরিক স্থাপনা নেই। একেবারেই খোলা মাঠ। আশপাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সবুজ চা বাগান। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্মৃতিভরা মোহময় মূর্তি নদী। আজ মূর্তিতে বেড়াতে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপারে চলে যাওয়া সাথীদের কথা খুব মনে পড়ছে। মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ, বীরপ্রতীক, হঠাৎ বিস্ময়কর এক দৃশ্য দেখলেন : চা বাগানের ভিতর থেকে গায়ে খাকি ডাংরি, ট্রেনিং রাইফেল কাঁধে কয়েকজন তরুণ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের প্রথমেই রয়েছে দীর্ঘদেহী প্রাণোচ্ছল চশমার নিচে মায়াবী চোখের শেখ কামাল, এরপর টগবগে সপ্রতিভ তরুণ আশফাকুস সামাদ, এরপর সাহসী যোদ্ধা খোন্দকার আজিজুল ইসলাম এবং সব শেষে বন্ধু-অন্তঃপ্রাণ সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসান...। এ চার তরুণ, পুরনো বন্ধুদের মূর্তিতে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে দৌড়ে আসতে থাকে। সায়ীদ লক্ষ্য করলেন, তার দিকে এগিয়ে আসা বন্ধুদের বয়স এখনো সেই ২০-২১-এ থেমে আছে। সায়ীদ তাকিয়ে থাকেন চা বাগানের পথের দিকে....। এ সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন তরুণ ক্যাপ্টেন জেনারেল সায়ীদকে স্যালুট করে বিনীতভাবে বললেন, ‘স্যার, ইটস টাইম ফর লাঞ্চ’। জেনারেলের চোখে তখন বইছে বিষণœ বৃষ্টিপাতের ধারা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কমিশনপ্রাপ্ত এ অফিসাররাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের পাইওনিয়ার বা অগ্রদূত। মুক্তিযুদ্ধে ও পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীতে তাঁদের অবদান ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন ও সংরক্ষণ করা বিশেষ প্রয়োজন। ঐতিহাসিক সেই পাসিং আউটের সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের সব অফিসারকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। শুভেচ্ছা। অভিবাদন। স্যালুট টু ইউ স্যার।

লেখক : গবেষক, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।

[email protected]

সর্বশেষ খবর