মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রলেপ নয় : সাম্প্রদায়িক অশান্তির উৎস নির্মূল হোক

তুষার কণা খোন্দকার

প্রলেপ নয় : সাম্প্রদায়িক অশান্তির উৎস নির্মূল হোক

১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে ২০২১- পাক্কা ৫০ বছরের লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা এখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের স্মৃতি আমরা ভুলিনি। গণহত্যার শিকার অগণিত শহীদের কথা আমরা শ্রদ্ধাভরে মনে রেখেছি। মনে রেখেছি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের সম্মুখযোদ্ধাদের যারা মরণপণ লড়াই শেষে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে আমাদের এ দেশটি উপহার দিয়ে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন। অনেকে যুদ্ধ শেষে বীরের বেশে ফিরে এসে সহজ সাধারণ জীবনযাপন করার পথ বেছে নিয়েছিলেন। যুদ্ধ-পরবর্তী মুক্তিযোদ্ধার অনেকে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে কারও কাছে হাত পাততে যাননি। বলেছেন, বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি। মা বিপদে পড়েছে। মাকে উদ্ধার করার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি। বাংলাদেশের অস্তিত্বই আমাদের জীবনে মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সার্টিফিকেট। আবার অনেক মুক্তিযোদ্ধা সহজ আনন্দে তাদের যুদ্ধের স্বীকৃতি এবং স্মৃতি হিসেবে একটি সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছেন। শুরুতে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট কোনো আর্থিক সুবিধা পাওয়ার বিষয় ছিল না। দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আর্থিক সামর্থ্য ভালো হওয়ার পর একসময় সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানজনক জীবন-জীবিকা নিশ্চিতের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্মানি ভাতা দেওয়া শুরু করেছে। এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা কাছ থেকে দেখেছি তারা সরকারের এ মহৎ উদ্যোগকে অন্তর থেকে সাধুবাদ জানিয়েছি। আমরা এখনো মনে করি সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা যারা এখনো আমাদের মধ্যে জীবিত আছেন তারা যাতে সম্মানজনক স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন করতে পারেন তার দেখভাল করা সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। বাংলাদেশে সরকারি আর্থিক সহায়তা সব সময় নিষ্কলুষ থাকে না। মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পারলে আর্থিক সুবিধা পাওয়া যাবে এ খবর চাউর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ধান্ধাবাজ লোক একখানা সার্টিফিকেট জোগাড় করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাদের অনেকে ইতিমধ্যে সফল হয়েছে বলেই মনে হয়। সার্টিফিকেট সংগ্রহকারী তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা যারা সারা জীবনে অতি সাধারণ একটি যুদ্ধাস্ত্র একবারের জন্য চোখে দেখেনি, যুদ্ধ ক্ষেত্র ফুলেল বিছানা নাকি কণ্টকাকীর্ণ ভয়াবহ দিনরাত সে সম্পর্কে সামান্য ধারণা যাদের নেই তারাও নাকি অর্থ এবং প্রভাব খাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে। যারা কোথাও কোনো প্রশিক্ষণ নেয়নি, কোনো দিন যুদ্ধ ক্ষেত্রের ধারে কাছেও যায়নি তাদের মুক্তিযোদ্ধা সাজতে দেখলে আমরা মনে কষ্ট পাই। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনা কিংবা ওদের দোসররা হিন্দু-মুসলমান সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। শরণার্থী না হয়ে দেশের ভিতর যারা ভয়ানক শত্রুর পাল্লা ধরে দিন গুজরান করেছে তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা অনেক সময় শরণার্থী জীবনের চেয়েও ভয়াবহ ছিল। জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করেই তাদের বেঁচে থাকতে হয়েছে। হাইওয়ের পাশে, রেলস্টেশন কিংবা নদীবন্দরের কাছে যাদের বাড়িঘর ছিল তারা প্রতিনিয়ত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের নির্মমতায় এক গ্রাম ছেড়ে আরেক গ্রামে ক্রমাগত পালিয়ে ফিরেছে। যেসব পরিবারের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল সেই পরিবারগুলো পাকিস্তানি সেনাদের হাতে মারা পড়েছে নয়তো প্রাণভয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে আশ্রয় নিয়ে জান বাঁচিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো দূরদূরান্তের কোনো গ্রামে আশ্রয় নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী বাঙালি পরিবারগুলোর জন্য কোনো উৎস থেকে কোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তার সুযোগ ছিল না। দেশ ত্যাগ করে যারা ভারতে শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল তাদের কষ্ট নিদারুণ ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবু বলতে হয় মন্দের ভালো তারা অন্তত আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা পেয়ে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেয়েছিল। নয় মাসের কঠিন যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথ নিষ্কণ্টক করেছে এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যারা দেশের ভিতরে বসবাস করে পাকিস্তানিদের চরম নির্যাতন সহ্য করেছে তারাও ভারত থেকে ফিরে আসা শরণার্থীদের সাদরে বরণ করে নিয়েছে। কে যুদ্ধ করেছে কে যুদ্ধ করেনি দেশের মানুষ তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ ভেবেছে সবাই মিলেমিশে সুখে-দুঃখে নতুন একটি দেশ পেয়েছি এটি অনেক বড় পাওয়া। যুদ্ধকালীন নয় মাসের দুঃখ ভুলে দেশের সব ধর্মের মানুষ নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পূর্তির বছর ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দেখতে হচ্ছে বলে নিঃসন্দেহে আমরা দুঃখ পাচ্ছি।

অক্টোবরের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে যার জবাব আমাদের কাছে নেই। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনেকের কথা শুনে মনে হচ্ছে এমন সময় সাম্প্রদায়িক দুর্ঘটনা ঘটানো কোনো এক মহল কিংবা গোষ্ঠীর বিশেষ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য খুব জরুরি ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস এসব বাহিনীর সদস্যরা অপকর্মের হোতা ছিল। এদের আমরা চিনে রেখেছি এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে রাজনৈতিক শক্তির ওঠাপড়ার সঙ্গে মিল রেখে এরা কখনো গর্তে ঢুকে গেছে কখনো বা গর্ত থেকে বের হয়ে ফণা তুলে আমাদের ছোবল মারার চেষ্টা করেছে। আমরা এই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে চিনি এবং তাদের সঙ্গে লড়াই করার অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। ইদানীং দেশবাসীর মনে আর একটি প্রশ্ন বারবার জেগে উঠছে যা বাংলাদেশের সব মানুষের জন্য বিশেষভাবে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি শুধু রাজাকার, আলবদর, আলশামস বলে আমরা বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের সঙ্গে আমরা প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করেছি এবং নয় মাসের লড়াই শেষে আমরা আমাদের দেশ স্বাধীন করেছি বলে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে মোকাবিলা করার প্রশ্ন সামনে এলে আমরা এদের বিরুদ্ধে রুখে উঠতে দ্বিধা করি না। একাত্তর-পরবর্তী বছরগুলোয় আমরা বরাবর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছি এবং সরকার আমাদের দাবি পূরণ করে সেই বিচারকাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে অনেক যুদ্ধাপরাধীর বিচারকাজ শেষ হয়েছে। এদের বিষদাঁত ভেঙে দিয়েই আমাদের জাতিগত অস্তিত্ব সংহত করেছি। স্বাধীনতার চিহ্নিত শত্রুরা যতবার আমাদের অস্তিত্বকে ছোবল মারার চেষ্টা করেছে ততবার তাদের উদ্ধত ফণা থেঁতলে দিতে দ্বিধা করিনি। ইদানীং দেশবাসীর মনে হচ্ছে চিহ্নিত শত্রু রাজাকার বাহিনীর বাইরে আমাদের স্বাধীনতার আরও কোনো সুপ্ত ঘাতক রয়ে গেছে যাদের আমরা সুনির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করতে পারিনি? বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে একটি শক্তি সক্রিয় কিন্তু তাদের লেবাস আমাদের অচেনা রয়ে যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশের ভিতরে বাইরে একটি নীরব শক্তি ক্রিয়াশীল যারা বাংলাদেশের অভ্যুদয় অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেনি। ১৯৭১ সালে নয় মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পাকিস্তানি পরাজিত শক্তি এবং তাদের এ দেশি দোসররা সহজভাবে মেনে নেবে না এটাই সত্য কিন্তু আরও কোনো শক্তি কি আমাদের সমাজের সঙ্গে মিশে আছে যাদের মনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে ভিন্ন কোনো এজেন্ডা ছিল যা বাস্তবায়ন হয়নি? বাংলাদেশ নামের দেশটির স্বাধীন অস্তিত্ব কি তাদের মনঃপূত নয়? তারাই কি বাংলাদেশের অস্তিত্ব এবং উন্নতিকে নিঃশব্দে ঘুণের মতো ক্রমাগত কেটে চলেছে? কারা এই দেশবিরোধী শক্তি?

বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। আমরা জানি শেখ হাসিনা যখন বিরোধী দলে থাকেন তখনো তাঁকে হত্যা করার অপশক্তি ক্রিয়াশীল থাকে। তিনি বিরোধী দলে থাকাকালে তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বারবার ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছে এবং বারবার তাঁর ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত এসেছে। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে ষড়যন্ত্রকারীরা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে এমন কথা আমরা বিশ্বাস করি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু কথা থেকে আমরা বুঝেছি বাংলাদেশে ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটানোর ষড়যন্ত্র হতে পারে এমন আশঙ্কার আভাস তাঁর কাছে আছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করা হলে আমরা আতঙ্কে কুঁকড়ে যাই। সেই সঙ্গে আমরা ভাবী আমরা জনগণ এমন ষড়যন্ত্রের তথ্য জানব কীভাবে আর তেমন ষড়যন্ত্রের জাল কাটার সাধ্য কি আমাদের আছে? বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালনশক্তি যাদের ওপর ষড়যন্ত্রের তথ্য উন্মোচন ও নস্যাৎ করার দায়িত্ব অর্পিত সরকারের সেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কি ক্যান্সারমুক্ত? দেশের আইনশৃঙ্খলা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যাদের দায়িত্ব তারা সবাই কি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী? এসব প্রশ্নের জবাব আমাদের কাছে নেই। আমরা আমজনতা সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চাই। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সর্বোচ্চ সুরক্ষিত। যদি সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের কোনো পর্যায়ে কোথাও ভূত বাসা বেঁধে থাকে যা একটি ধর্মান্ধতামুক্ত আলোকিত দেশ গড়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক তাহলে তা উপড়ে ফেলার সামর্থ্য আওয়ামী লীগ সরকারের আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার খুব সাময়িক। সরকারের সঠিক পদক্ষেপ দেশের সব নাগরিকের জন্য অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ বসবাস নিশ্চিত করবে।

                লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর