শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

ফল উৎপাদনে অনন্য শিখরে বাংলাদেশ

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

ফল উৎপাদনে অনন্য শিখরে বাংলাদেশ

পুষ্টি চাহিদা পূরণে ফলের বিকল্প নেই বললেই চলে। অতিথি আপ্যায়ন, রোগীর খাদ্যসহ ফলের রয়েছে বিবিধ ব্যবহার। ২০ বছর আগে আম আর কাঁঠাল ছিল এ দেশের প্রধান ফল। এখন বাংলাদেশে ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। আগে হতো ৫৬ প্রজাতির ফল চাষ। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যতম পুষ্টিকর ড্রাগন ফল, এভোকাডো, রাম্বুটান, স্ট্রবেরি, ডুমুর, মাল্টা, বেল, নারকেল, জাম্বুরা, রঙন, সূর্যডিম ও খেজুরের বেশ কয়েকটি জাতের চাষও দেশে দ্রুত বাড়ছে। বিদেশি ফলের চাহিদা বাড়ায় দেশেই এখন মাল্টা, ড্রাগন, স্ট্রবেরিসহ অনেক বিদেশি ফলের আবাদ শুরু হয়েছে। আবার আপেলের বিকল্প বড় আকারের কুল, থাই পেঁপে ও পেয়ারা উৎপাদনও বাড়ছে। যার প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক উৎপাদনে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ফলের উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ২১৫ টন। ২০১৭-১৮তে ১ কোটি ২১১ টন, ২০১৬-১৭তে ১ কোটি ২০ টন এবং ২০১৫-১৬তে ১ কোটি ১০ টন ফল উৎপাদন হয়। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় নাম রয়েছে বাংলাদেশের। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ফল চাষে বাংলাদেশে রীতিমতো একটি বিপ্লব ঘটে গেছে। গত ১০ বছরে দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের পাশাপাশি বাড়ির আঙিনা ও সড়কের পাশে ফলের গাছ রোপণের প্রবণতা বেড়েছে।

বাংলাদেশ যে খাদ্য নিরাপত্তায় বিশ্বের অন্যতম সফল দেশ হয়েছে এবং বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে তিন বছরে ছয় ধাপ এগিয়েছে তার পেছনে ধান, সবজি ও মাছের পাশাপাশি ফলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বিচি ছাড়া পেয়ারার বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা করছেন। দেশের সাতটি কোম্পানি বর্তমানে পেয়ারার জুস তৈরির জন্য প্লান্ট স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ থেকে পেয়ারা ও পেয়ারার জুস রপ্তানিও হচ্ছে। ফল উৎপাদনের এ সাফল্য অটুট থাকুক; প্রান্তজনে পৌঁছাক ফলের সুমিষ্ট স্বাদ- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

খাদ্য উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ধান, শাকসবজি, মাছ উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যে সবজি রপ্তানি করে বছরে আয় হচ্ছে ৩০ কোটি টাকা। এসব ফসলের পাশাপাশি ফল উৎপাদনেও বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দেশি ফলের পাশাপাশি বিদেশি দুর্লভ ফলও দেশে উৎপাদন হচ্ছে। একটা সময় কল্পনাও করা যেত না আমাদের দেশে বিদেশি খেজুর, স্ট্রবেরি, মাল্টা, ড্রাগন, এভোকাডো কিংবা জাপানের দুর্লভ বিশেষ প্রজাতির আম উৎপাদন হবে। এখন বিশ্বের এমন কোনো ফল নেই যা দেশে স্বল্প ও বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন না হচ্ছে। এসব ফল পাহাড়ি অঞ্চল থেকে শুরু করে সমতল অঞ্চলে কিংবা বাসার ছাদ বা আঙিনায় ব্যক্তি উদ্যোগে উৎপাদন হচ্ছে। অনেকে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন প্রজাতির উন্নত মানের ফল উৎপাদন করছেন। এসব ফলের স্বাদ ও গুণ বিশ্বমানের। দেশি ফলের পাশাপাশি এসব বিদেশি ফল উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে পাহাড়ি অঞ্চলে বিশেষ করে পার্বত্য ও সিলেট অঞ্চলে অনাবাদি জমিতে দেশি ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফল উৎপাদনের ব্যাপক উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সমতল ভূমিতে ফলের আবাদ বেড়েছে। বলা যায়, ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশে নীরব বিপ্লব শুরু হয়েছে।

একটা সময় বিদেশি ফল হিসেবে আপেল, নাশপাতি, আঙুর, কমলা, খেজুর, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ইত্যাদি ফল সাধারণ মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। এখন সেই সময় নেই। এমন কোনো গ্রাম-গঞ্জ নেই যেখানে এসব ফল পাওয়া যায় না। যদিও এসব ফল বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এবং বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হয়। শুধু ফল আমদানি নয়, প্রচুর বিদেশি জুসও আমদানি হচ্ছে। এতে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যায়। তবে এক দশক ধরে উল্লিখিত ফল শুধু নয়, বিদেশের দুর্লভ ও সুস্বাদু নানা জাতের ফল দেশে উৎপাদন শুরু হয়েছে। অন্যদিকে দেশি ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সুস্বাদু করতে কৃষিবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে সফল হয়েছেন এবং হচ্ছেন।

জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) প্রতিবেদন অনুযায়ী ফল উৎপাদনের সম্ভাবনা ও দ্রুত বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশের তালিকায় রয়েছে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে কাঁঠাল উৎপাদনের দিক থেকে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ। দেখা যাচ্ছে ফল উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশে এক ধরনের বিপ্লব ঘটছে। সীমিত জমি ও সুযোগ-সুবিধার অভাব থাকা সত্ত্বেও প্রতি বছর ফল উৎপাদন শতকরা ১০ ভাগ হারে বাড়ছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী এক দশক আগে দেশে ৫৬ প্রজাতির ফল উৎপাদন হতো। এখন ৭২ প্রজাতির ফল উৎপাদন হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বাড়ির আঙিনা, সড়কের পাশে কিংবা অনাবাদি জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফলের চাষ করছে। শহরের অনেক মানুষ ছাদবাগান করে বিদেশি ফল উৎপাদন করে সাফল্য পাচ্ছেন। অনেকে একই জায়গায় মিশ্র পদ্ধতিতে বিভিন্ন জাতের ফলের চাষ করছেন। এসবের বেশির ভাগই হচ্ছে ব্যক্তি ও বেসরকারি উদ্যোগে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে শুরু করে সমতল অঞ্চলে মানুষ যে আগ্রহ-উৎসাহ নিয়ে ফলের চাষ করছে তাতে আগামী কয়েক বছরে এ খাতটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এতে বিদেশ থেকে ফল আমদানির পরিবর্তে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ফল উৎপাদন ও রপ্তানিতে বিশ্বে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে দেশ দুটি। আমাদের দেশেও ফল রপ্তানির ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। একে রপ্তানির অন্যতম খাতে পরিণত করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সরকারের সুনির্দিষ্ট ও ব্যাপক পরিকল্পনা।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ।

সর্বশেষ খবর