বুধবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

অপরাজনীতির কুৎসিত রূপ হিন্দুদের ওপর হামলা

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

অপরাজনীতির কুৎসিত রূপ হিন্দুদের ওপর হামলা

ইসলাম অবমাননার ধুয়া তুলে শারদীয় দুর্গাপূজার সময় দেশে ন্যক্কারজনক যে উগ্রতা চলল তা দেখে বেদনায় বুক গুমরে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। ঘৃণার ক্ষোভে মনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে অনির্বাণ। বলা হচ্ছে ইকবাল নামে এক ভবঘুরে মাদকসেবী এ কান্ড ঘটিয়েছে। আরও অনেক অদৃশ্য ইকবাল দেশটাকে অশান্ত করে দিল। কোনো ধর্মপ্রাণ হিন্দু বা কোনো মুমিন মুসলমান এ গর্হিত কাজ করবে কেউ বিশ্বাস করছে না। রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত যাদের মাথায় ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতায় থাকা গিজগিজ করে তারাই এমন অপকর্ম করতে পারে বলে আমজনতার বিশ্বাস।

মুসলিম ভাইদের বলি, বিবেক বিসর্জন দিয়ে আবেগে মাতবেন না। আপনার আবেগ আপনার সম্প্রদায়ের সুনামহানির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমরা অন্ধ হয়ে যাই হুজুগে লাফাই বর্ষার কই মাছের মতো। শুকনা মাটিতে সাঁতার কাটতে থাকি। শেষ পর্যন্ত মাছ শিকারির হাতে ধরা পড়ে উনুনে গরম তেলে দহন হয়ে রসনাবিলাসের উৎকৃষ্ট উপাদান হই। পদ্মা সেতু নিয়ে মুন্ডু কাটার গপ্পে অনেক নিষ্পাপ প্রাণ ঝরেছে। স্কুলে নিজের সন্তান ভর্তি করতে গিয়ে এক মা গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেলেন। পুলিশকে মাইকিং করতে হলো আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে। এসবই বর্বরতার আদিম যুগের আলামত। এক ভবঘুরে মাদকাসক্ত ইকবাল কত বড় লঙ্কাকান্ড ঘটিয়েছে। অশান্তি, অস্থিরতা, অবিশ্বাস বাধিয়েছে। কর্মফলের পরিণতি না ভেবে নামধারী ধার্মিক একদল মূর্খ সম্প্রীতির বন্ধন নড়বড়ে করেছে, সংখ্যাগুরুরা কী করলেন হিসাব করে দেখুন। ইকবালই যে এ অপকর্মের একমাত্র হোতা তা এখনো খোলাসা হয়নি। ঘাত-প্রতিঘাতের বিচিত্র জীবনের অভিজ্ঞ রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, ঘটনা ভিন্ন দিকে নেওয়ার জন্য একজন মাদকাসক্তকে পুলিশ সামনে এনেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর হামলাকারীরা সব দেশেই রাজনৈতিক ফায়দা লুটে খাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা মন্দিরে গোমাংস ফেলে রাখার জিগির তোলে। ফ্রিজে, মোটরসাইকেলে গোমাংস থাকার রটনা রুটিয়ে রক্ত ঝরায়। হিন্দুত্ববাদের ভন্ডামির উদ্দেশ্য হিন্দুরা যেন ভাবে মুসলিমরা আমাদের দেবীর অবমাননা করেছে। হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার করে- দেখ মুসলিমদের কত সাহস! চল পেটাই। সব সমাজে কিছু চাহিবামাত্র মারপিট দিতে বাধ্য থাকা আদম থাকে, অঘটন ঘটেও যায়। ভারতে আমরা এই নির্মমচিত্র অবলোকন করেছি। মুসলমানদের রক্ষায় প্রতিবেশী দেশের সরকার বড় কোনো সাড়া-শব্দ করেনি। যখন ভারতে মুসলমানদের ওপর নির্মম তান্ডব চলেছে তখন কেউ কেউ ক্যামেরাম্যান সঙ্গী করে হিমালয়ে ধ্যানে মগ্ন ছিলেন কখন একচ্ছত্র নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হবেন। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা ভারতে দাঙ্গা, হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগের হোলি খেলায় মেতে উঠলেও ভারতের সাধারণ হিন্দু সে পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। তারা বলেছে, ১০০ জন হিন্দুর ভিড়ে ২০ জন মুসলিম কোনো যুক্তিতেই হিন্দুর ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হানার সাহস পাবে না। বাংলাদেশের ঘটনায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে অভয় দিয়েছেন উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা হবে। আশঙ্কা থাকে আগের কোনো সহিংসতার রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি, বিচার হয়নি। এবার যেন তা না হয়।

দুঃখ লাগে কেন আলেম-ওলামারা ইসলামের নামে হামলা-লুট হওয়ার বিরুদ্ধে বজ্র আওয়াজ তুলে প্রতিবাদ করলেন না? কেন বুঝলেন না ৮ ভাগ অমুসলিমের দ্বারা পবিত্র কোরআন নিয়ে চক্রান্ত করার হিম্মত হওয়ার কথা নয়। তা যদি কোনো মূর্খও করে সেজন্য আইন আছে, পুলিশ আছে। আইন কেন নিজের হাতে নিতে হবে। স্বীয় অবস্থানে থেকে কেন হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন না ইসলামী চিন্তাবিদরা। ধর্মের নামে লুটপাট, হাঙ্গামা ইসলামেরই অবমাননা। তা চলতে দেওয়া যায় না।

অপরাধী মুসলিম হিন্দু যে-ই হোক তাকে সাজা দিতেই হবে। কোনো ধর্ম, কোনো উপাসনালয় ঘৃণার নিশানা হতে পারে না। ভারতের চেয়ে আমরা অনেক সম্প্রীতি নিয়েই ছিলাম ও আছি। আজ তারা কট্টর সমালোচনা করছে। বিশ্বে আমাদের অনেক মর্যাদা। কোন সে অনুর্বর মস্তিষ্ক নিজেকে জাহির করতে জাতির এমন ক্ষতি করল? স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাড়ি ছেড়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে ভাইবোন নিয়ে মামাবাড়ি পালালাম। সেখানে অগণিত হিন্দু পরিবার। যারা বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমেছে মামাবাড়ি ছিল সবার আশ্রয়। মামাবাড়ি মানিকনগর। রীতিমতো চলমান উদ্বাস্তু আশ্রয় শিবির। আমার বড় মামা আবুল বাশার ছিলেন স্বাধীনতার সংগঠক। ছোট মামা আবুল কালাম মোড়ল বীর মুক্তিযোদ্ধা। মেজ মামা আবুল হোসেন ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন। বাবা, চাচারা সবাই পলাতক। চোরাপথ খুঁজছে কীভাবে দ্রুত নিরাপদে ভারতে যাওয়া যায়। শুভবুদ্ধির গ্রামবাসী মুক্তিকামী মানুষ হিন্দু-মুসলমান যার যে অস্ত্র ছিল তা-ই নিয়ে রাতে রাস্তায় বাড়ি পাহারা দিতাম। রাতের অন্ধকারে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে অজানা অনিশ্চিত পথে ভবিষ্যৎ জীবনের ভাবনা জলাঞ্জলি দিয়ে নারী-পুরুষ নিরাপদ স্থান খুঁজতে দলে দলে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিশোর বয়সের সেসব দৃশ্য আজ মনে পড়লে কাতর হই কী দামে কেনা এই স্বাধীনতা- আজকের যুবসমাজকে আমরা বোঝাতে পারিনি। সম্প্রীতির এমন অটুট বন্ধন জাতির সমৃদ্ধির জন্য সমুজ্জ্বল রাখতে হবে।

প্রায় সব মানুষ শান্তির পক্ষে। তারা আলাদাভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে প্রতিবাদ জোরালো দেখায় না। প্রতিবাদীদের হয়তো কেউ বলবে ভারতের দালাল। কেউ ব্যঙ্গ করবে। তার পরও হিন্দু ভাইদের আমাদের আগলে রাখতে হবে বুকের রক্ত দিয়ে অনিষ্টের হাত থেকে হেফাজত করতে হবে।

আমার শিক্ষক সুরেন্দ্রনাথ এমএবিটি ১৯৭২ সালে ভারত থেকে দেশে আসার পরপরই আমরা স্কুলের সব ছাত্র মিলে স্যারের বাড়িঘর বাঁশ কেটে লোকজন নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে বেঁধে দিয়েছিলাম। হেড স্যার আজমল স্যার বলেছিলেন তোরা অনেক মহৎ কাজ করেছিস। অনেক বড় হবি ভালো কাজের পুরস্কার পাবি জীবনে।

গোমাংস রাখার অজুহাতে ভারতে মুসলিমকে যখন পিটিয়ে মারে তখন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠরা প্রতিবাদ করে। হিন্দুত্ববাদীরা তাদের ধর্মহীন বলে গালি দেয়; তাতে তারা পিছপা হয় না। ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে অনেক ভালো সম্প্রীতি। এখানে ভালোবাসার বন্ধনের অটুট সমাজব্যবস্থা। বাংলাদেশে জাতিগত কোনো সংঘাত-দ্ধন্ধ নেই। রয়েছে রাজনৈতিক বাসনা চরিতার্থ করার কুকাম। একজন মাদকাসক্ত ইকবালের কান্ডে কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠরা বেকুবি কম্ম ঘটাল।

আমাদের অহংকারের কৃষ্টি হিন্দু-মুসলমান আমরা ধর্মভীরু, কেউ ধর্মান্ধ নই। আমার হিন্দু ভাইবোনের আনন্দের আবেগের পূজায় হামলা, বাড়িতে হামলা, লুটপাট, মারধরের শুধু প্রতিবাদ নয় সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নিন্দনীয় হামলার শিকার হিন্দুদের হৃদয়ে চাপাকান্না ভেসে উঠছে। মুসলমানদের আত্মমর্যাদায়, শান্তির ধর্মের মহিমাকে আঘাত করে বাংলাদেশিদের ললাটে উগ্রবাদীর তকমা লেপনের কালিমা তামাম দুনিয়ায় প্রচার করা হলো আমরা অসভ্য উচ্ছৃঙ্খল। এ ক্ষতির দায় কে নেবে!

মানুষের চেয়ে যখন মানুষের ছায়া বড় হয় বুঝতে হবে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ক্ষমতার উত্তাপে দিশাহারা চ্যালা-চামুন্ডাদের কর্মে মানবিক চেতনা ধূলিসাৎ হচ্ছে। গবেষণার দরকার রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কীভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়ে। অপকর্ম জায়েজ করতে দোষারোপের রাজনীতি অতীতে বহু হয়েছে। নেতা-কর্মীদের বেশভূষার উন্নতি হয়েছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফসল নেতা-কর্মী সব বঙ্গবন্ধুর পোশাকি অনুসারী আদর্শের অনুসারী নয়। এ মামলায় আবার গ্রেফতার বাণিজ্য শুরু না হয়! গণমাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে জেলে আটক ছিল তাকেও আসামি করা হয়েছে! তাতে কি সুবিচার নিশ্চিত হবে! অবুঝ অল্পস্বল্প হুজুগে পাবলিক কিছু থাকে অজু ধরেছে নামাজ ধরেনি, তারাই ধর্মের নামে ফাল মারে বেশি, অধর্মের কাজ করে বেশি। রাষ্ট্র হুজুগিদের শিক্ষা দিয়ে সভ্য করতে না পারলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সাধু সাবধান!

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর