বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও রাজনীতিবিমুখতা

সাইফুর রহমান

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও রাজনীতিবিমুখতা

ইতিহাসবিদদের বর্ণনা অনুযায়ী যেদিন পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল অর্থাৎ ২৩ জুন ১৭৫৭ সাল সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত যুদ্ধ ময়দানের আশপাশে যত লোক দর্শনার্থীর মতো এ যুদ্ধের দৃশ্যে নয়নসুখ করছিলেন তারা যদি শুধু লাঠি হাতে ইংরেজ বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন তা হলেও ইংরেজরা পালানোর পথ খুঁজে পেতেন না। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সে রকম কিছু ঘটলে ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো। কিন্তু কেন তারা এগিয়ে এলেন না নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সাহায্য করতে? কেন এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা গেল না এ দেশ থেকে ইংরেজদের উৎখাত করার এ পরিক্রমায়। এর উত্তর হাজারো হতে পারে। দু-চারটি উত্তর সহজেই অনুমেয়। প্রথমত. সে সময় বাংলার মানুষের মধ্যে ন্যাশনালিজম অর্থাৎ জাতীয়তাবোধের ঘাটতি ছিল। তাদের মানসপটে এ চিন্তা কখনই প্রবেশ করেনি যে আদতে তারা কী হারাতে যাচ্ছে। কিংবা কোনো বিদেশি শক্তির কাছে পদানত হচ্ছে তাদের প্রিয় এ জন্মভূমি। নবাবের সেনারাও ছিল স্রেফ মার্সেনারি ধরনের। তাদের মধ্যে ছিল না কোনো দেশাত্মবোধ। অন্যদিকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার জনসাধারণকে কখনই রাজনীতির সঙ্গে সেভাবে সম্পৃক্ত করতে পারেননি এটা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়।

আসলে রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের যে ঘৃণা, ক্ষোভ, অসন্তোষ তা সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। এর কারণ বোধ করি আঁচ করা খুব কঠিন কিছু নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের দেশের শাসকরা জনমানুষের ওপর সুবিচার করেননি। এ দৃশ্য শুধু আমাদের দেশে হবে কেন? সারা পৃথিবীতে প্রায় একই ধরনের প্রতিচ্ছবি। এ প্রসঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর বিখ্যাত আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থ ‘দ্য অ্যডাসিটি অব হোপ’-এ যা বলেছেন তা একটু বলতে হয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন শেষ করার কিছুদিন পর বিয়ে করেন বারাক ওবামা। তাই জীবন নিয়ে বেশ কিছুটা সংশয় ও অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন তিনি। এ সময় ইলিনয় রাজ্যসভার একটি আসন শূন্য হয়। বেশ কজন বন্ধু তাকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন। ওবামা স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে নেমে পড়েন নির্বাচনে। একজন নতুন প্রার্থী প্রথম যা যা করেন ওবামাও তা-ই করলেন। শ্রোতা পেলেই তাকে শোনাতেন তার নির্বাচনে দাঁড়ানোর কারণ। পাড়ার বিভিন্ন ক্লাবের বৈঠক ও চার্চের সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলেন তিনি। বিউটি শপ থেকে শুরু করে বারবার শপ পর্যন্ত কোনো কিছুই বাদ যায় না তার তালিকা থেকে। রাস্তার ওপরে যদি দুই ব্যক্তিকেও দাঁড়িয়ে আলাপ করতে দেখেন তখনই গিয়ে তাদের হাতে ধরিয়ে দেন তার নির্বাচনী প্রচারপত্রটি। ওবামা যেখানেই যান না কেন নানাভাবে ঘুরে-ফিরে সবাই তাকে সাধারণত দুটি প্রশ্ন করে- তোমার এ মজার নামটি তুমি কোথায় পেলে? অন্যটি হলো- তোমাকে তো বেশ ভালো মানুষ বলেই মনে হয়। তুমি কেন রাজনীতির মতো এমন একটি নোংরা ও জঘন্য কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছ?

এ প্রশ্নগুলোর সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন বারাক ওবামা। কয়েক বছর আগে প্রথম যখন তিনি শিকাগোর গরিব মানুষের সঙ্গে কাজ করতে এলেন তখনো প্রায় একই ধরনের প্রশ্ন করা হতো তাকে। কেবল রাজনীতি নয়, রাজনীতিবিদদের সম্পর্কেও সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের হতাশা ফুটে ওঠে এসব প্রশ্নের মধ্যে। এ হতাশা রয়েছে অন্তত শহরের দক্ষিণাংশের মানুষের মনে, যে অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করার প্রচেষ্টায় নেমেছিলেন ওবামা। এসব প্রশ্নের জবাবে তিনি হাসিমুখে তাদের সম্মান জানিয়েছেন মাথা নুইয়ে। সেই সঙ্গে বলতেন, রাজনীতির এ নৈরাশ্যকর দিক সম্পর্কে তিনি নিজেও বেশ সচেতন ও অবগত। কিন্তু রাজনীতির একটি ঐতিহ্যও তো রয়েছে।

বারাক ওবামা ঠিকই বলেছেন- রাজনীতির একটি ঐতিহ্যও রয়েছে বটে। তা না হলে এ দুনিয়াটা পাল্টাল কী করে। কিন্তু রাজা যদি সত্যি সত্যি শুধু প্রজাদের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা করতেন তাহলে বোধ করি এ পৃথিবীটা মানুষের জন্য আরও উপযুক্ত ও বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হতো। কোটি কোটি মানুষের রক্তে রঞ্জিত হতো না এ পৃথিবীর পবিত্র ভূমি। রাজনীতির প্রতি মানুষের যে ঘৃণা তা অনিবার্যভাবেই রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা থেকে উদ্ভূত। আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, ম্যান্ডেলার মতো মনীষীরা যেখানে পৃথিবীটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। হিটলার, মুসোলিনি কিংবা পিনোশের মতো রাজনীতিবিদরা তখন পৃথিবীটাকে টেনেছেন পেছনের দিকে। প্রসঙ্গক্রমেই বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল প্রণীত ‘পাওয়ার’ গ্রন্থটিতে নেতা ও এর অনুসারী সম্পর্কে কিছু কথা মনে পড়ে গেল। রাসেল তার বইটিতে লিখেছেন- ‘ক্ষমতালাভের প্রেরণা দুই প্রকার। প্রথমটি নেতাদের মধ্যে স্পষ্ট, অন্যটি অনুসারীদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন। কোনো নেতাকে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে অনুসরণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে নেতার নেতৃত্বাধীন দল কর্তৃক ক্ষমতা অর্জন। কারণ তারা মনে করেন নেতার সাফল্যই তাদের সাফল্য। অধিকাংশ লোকই বিজয় লাভের লক্ষ্যে নেতৃত্বদানে নিজের যোগ্যতার ওপর ভরসা করতে পারেন না। তাই তারা এমন এক ব্যক্তিকে তাদের দলের নেতা বানাতে চান যার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রয়োজনীয় সাহস ও বিচক্ষণতা আছে বলে তাদের মনে হয়। এমনকি ধর্মের বেলায়ও এ আবেগ বিদ্যমান। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে তার যোগ্যতায় বিশ্বাস করে ততক্ষণ সে ক্ষমতার আশা করে। কিন্তু যখন নিজের অযোগ্যতা সম্পর্কে বুঝতে পারে তখন সে একজন নেতাকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।’ রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের যতই অসন্তোষ কিংবা ঘৃণা থাকুক না কেন দেশ, মা, মাটি ও নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ কিন্তু নেতার ওপর আস্থা রেখে শত্রু মোকাবিলায় অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৪৭, ১৯৬৯ কিংবা ১৯৭১ সালে আমরা সেসব দৃষ্টান্তই দেখতে পাই।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিস ঔপনিবেশিক শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের জনসাধারণ জেগে উঠেছিল শরীরের সব শক্তি নিয়ে। তারা কিন্তু যথার্থভাবেই আস্থা রেখেছিলেন সে সময়ে বিখ্যাত ও জনবান্ধব কিছু নেতার ওপর। মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, বল্লভ ভাই প্যাটেল, বালগঙ্গাধর তিলক, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ নেতা সত্যিকার অর্থেই মুক্তিকামী জনতাকে দেখিয়েছেন আলোর পথ। আর সেজন্যই ইংরেজ শাসকরা এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। দেশ তো স্বাধীন হলো, ১৯৪৭ সালের আগে আমরা ছিলাম ভারতীয়। ’৪৭-এর পর হলাম পাকিস্তানি। কিন্তু অত্যাচার, নিপীড়ন ও বৈষম্যের হাত থেকে আমরা রেহাই পেলাম না একবিন্দুও। বরং অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতনের মাত্রা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পেল। আবার শুরু হলো আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষিত গভর্নর হাউস ঘেরাও ও পরবর্তী দিনগুলোর কর্মসূচির মাধ্যমে ’৬৮-এর ছাত্র অসন্তোষ গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ’৬৮-এর গণআন্দোলনই ধীরে ধীরে ’৬৯-এ গণবিস্ফোরণে রূপ নেয়। গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারের মুখে টিকতে না পেরে শেষাবধি ২৫ মার্চ পাকিস্তানের লৌহমানব প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া খান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করেন।

কিন্তু জয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন তিনি। যা ১৯৭১ সালে জাতিকে মুক্তিসংগ্রামের দিকে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নিজস্ব একটি কৃষ্টি, কালচার ও শিল্পসাহিত্য বোধ সৃষ্টি হয়। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল মূলত তিনটি চেতনার ওপর ভিত্তি করে। প্রথমত. বৈষম্যহীন সমাজ, দ্বিতীয়ত. মানবিক সমমর্যাদা আর তৃতীয়টি সামাজিক সুবিচার। প্রসঙ্গক্রমেই এখানে বলতে হচ্ছে- আমি ব্যক্তিগতভাবে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের চেতনার সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনেক সাযুজ্য দেখতে পাই। ফরাসি বিপ্লবেরও মূল কথা ছিল তিনটি। ১. মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন ও সমান ২. আইনের চোখে সবাই সমান এবং ৩. সব সার্বভৌমত্ব জনগণের (এত দিন যা রাজার বলে দাবি করা হতো)। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম আর ফরাসি বিপ্লবের মধ্যকার যে মিল তা আমার কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দী অবস্থায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গুলিতে নিহত হন। তার মৃত্যুসংবাদে পরিস্থিতি এমন উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে যে বিকালে মওলানা ভাসানী লক্ষাধিক মানুষের জনসভায় দু-এক মাসের মধ্যে ১১ দফার বাস্তবায়ন এবং সব রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া না হলে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি আরও বলেন, প্রয়োজন হলে ফরাসি বিপ্লবের মতো জেলখানা ভেঙে শেখ মুজিবকে ছিনিয়ে আনা হবে। সভা শেষে জনতা মন্ত্রীদের ঘরে অগ্নিসংযোগ শুরু করে। ফরাসি বিপ্লবেও কিন্তু ফ্রান্সের জনগণ তখনকার প্রগতিশীল প্রজাবান্ধব নেতা যেমন রবস্পিয়ের, দাঁতো, মিরাবোঁ, লাফায়েৎ প্রমুখ নেতার ওপর আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু আস্থা রাখতে পারেননি রাজা ষোড়শ লুই ও তার পরিষদের ওপর। কেনই বা তাদের ওপর আস্থা থাকবে। রাজা-রানী, রাজ পরিবার, অভিজাত এবং ধর্মযাজক শ্রেণির কিছু লোকের আরাম-আয়েশ ও নিত্যনতুন আমোদ-ফুর্তির দাম শোধ করতে হতো দেশের কোটি কোটি গরিব প্রজাকে। কত রকমের খাজনা যে আদায় করতেন রাজা ষোড়শ লুই, সেগুলো বলে শেষ করা যাবে না। এ রকম একটি খাজনার নাম ছিল ‘লবণ কর’। প্রয়োজন হোক কিংবা না হোক একটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে বছরে ৭ পাউন্ড করে লবণ কিনতেই হবে।

অন্যদিকে আবার ঘরে যেটুকু লবণ থাকবে তার ওপরও খাজনা দিতে হবে। চাষির জমিতে উৎপন্ন যে কোনো ফসল কিংবা ফলমূল হোক আগে জমিদারকে প্রদান করতে হতো, তারপর সে নিজে ভোগ করতে পারবে। অনেক সময় রাতে জমিদারদের বিশাল বিশাল অট্টালিকার চারপাশে ব্যাঙ ডাকত। চাষিদের রাত জেগে সেসব ব্যাঙ তাড়াতে হতো, যাতে জমিদারপত্নীদের নিদ্রায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। আর এতে দেশের জনগণ যে খেপে উঠবে তা-ই তো স্বাভাবিক।

ফ্রান্সজুড়ে সাধারণ মানুষের অসন্তোষের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে রাজার উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদের অনেকেই বিপ্লবীদের পক্ষে অবস্থান নেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মিরাবোঁ ও লাফাইয়েৎ। মিরাবোঁ অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিপ্লবের শুরুর দিকে। ‘দুই জগতের নায়ক’ লাফাইয়েৎ বুর্জোয়া ও পারির নাগরিকদের আস্থাভাজন ছিলেন। ১৭৮৯-এর ৬ অক্টোবরের পর থেকে লাফাইয়েৎ রাজার প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতেন। ১৭৯০-এর ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজাকে জাতীয় সভায় নিয়ে যান। সেখানে রাজা সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন। অতএব সাধারণ মানুষেরও এই ধারণা হয়েছিল যে জনপ্রিয় লাফাইয়েতের নেতৃত্বে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকবে। জর্জ ওয়াশিংটনের মতো লাফাইয়েৎও চেয়েছিলেন রাজা ও অভিজাত শ্রেণি বিপ্লবকে স্বীকার করুক এবং জাতীয় সভা একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করুক। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি। এখানে উল্লেখ্য, শুধু রাজা, মন্ত্রী কিংবা উপদেষ্টাদের মধ্যেই মতভেদ কিংবা মতানৈক্য সৃষ্টি হয়নি বরং ফরাসি বিপ্লবকে কেন্দ্র করে জাতীয় পরিষদের সদস্যরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এক পক্ষ ছিলেন রাজার প্রতি অনুগামী ও আস্থাশীল। আরেক দল নিয়েছিল বিপ্লবীদের পক্ষ। যেহেতু রাজার পক্ষাবলম্বনকারীরা জাতীয় পরিষদের ডান দিকে বসত সেহেতু বিপ্লবীদের পক্ষাবলম্বনকারীরা বসত জাতীয় পরিষদের বাঁ দিকে। সেই থেকে প্রগতিশীলতার রাজনীতি বলতে ‘বামধারার রাজনীতি’ বোঝায়, যা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এখনো বিদ্যমান।

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ফরাসি বিপ্লব বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত মানুষের মনে আশার আলো জ্বালিয়েছিল। চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল অত্যাচারী রাজা ও রাজ অমাত্যদের। কিন্তু রাজনীতি বড়ই জটিল ও কুটিল একটি বিষয়। বিপ্লবীরা অপ্রত্যাশিতভাবে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ল। একদল বলল, রাজাকে রেখেই রাজনীতির সম্যক সংস্কার করা যেতে পারে। আর একদল বলল, রাজাকে করতে হবে চিরতরে উৎখাত। একদল অন্য দলকে বিপ্লবের শত্রু ভাবতে লাগল। আর এ রকম রাজনৈতিক ডামাডোলে প্রাণ হারাতে হলো ফরাসি বিপ্লবের দুই মহান নেতা দাঁতো (১৭৫৯-১৭৯৪) ও রবস্পিয়েরকে, (১৭৫৯-১৭৯৪)। ফ্রান্সের জনগণ যখন পুনরায় হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার পথে ঠিক এ রকম একটি সময়ে দেশটির হাল ধরলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।

রাজনীতিতে যেমন অনেক নৈরাশ্যজনক দিক আছে, তেমন রয়েছে এর আশাজাগানিয়া দিকও। দেশের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে অনেকের অতিকথন, বাচালতা ও হঠকারী কর্মকান্ড যখন আমাদের হতাশার দিকে ঠেলে দেয় ঠিক তখনই কিছু আত্মত্যাগী নেতা দেশ, দেশের মানুষ ও দলের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেন তার জন্য মনের মধ্যে আশার আলো জ্বলে। পরিশেষে এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে রাজনীতির এ কুটিল ও জটিল ব্যাপার-স্যাপার থেকে উন্নত দেশগুলো আজ অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সত্যিকারের গণতন্ত্র। তবে এশিয়ার কিংবা আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি সত্যিকারের জনমানুষের সরকার। এ হতাশা থেকে কবে যে আমরা মুক্ত হব তা-ই এখন দেখার বিষয়।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

Email : [email protected]

 

সর্বশেষ খবর