শুক্রবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

একজন জ্ঞানসাধকের কথা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

একজন জ্ঞানসাধকের কথা

ইতিহাসবিদ, লেখক, কলামিস্ট এবং শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ ‘বাংলাপিডিয়া’র উদ্ভাবক, প্রযোজক ও বাস্তবায়ক। ব্রিটিশ আমলে কৃষিজমির বন্দোবস্ত, আর্থ-প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র ও বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ওপর তাঁর কাজের জন্য তিনি বিখ্যাত হলেও বাংলাপিডিয়ার পথিকৃৎ হিসেবেই তিনি পরিকীর্তিত হবেন। কারণ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাপিডিয়া ও সিরাজুল ইসলাম সমার্থকের পর্যায়ে উপনীত। আজ ২৯ অক্টোবর তাঁর ৮২তম জন্মদিন। তাঁর সৃজনশীল অন্যতম কর্মস্থল এবং বাংলাপিডিয়ার প্রকাশক বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি আজ তাঁকে বিশেষ সম্মাননা জানাবে এবং এ উপলক্ষে ‘প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম : বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির আধুনিকীকরণের পথিকৃৎ’ শীর্ষক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হবে।

সিরাজুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০০০ সালে বাংলাপিডিয়ার জন্য পূর্ণ সময় দিতে অবসর গ্রহণের আনুষ্ঠানিক তারিখের পাঁচ বছর আগে তাঁর ৩৪ বছরের চাকরি ছেড়ে দেন। নিজেকে পুরোপুরি গবেষণাকর্মে নিয়োজিত করার লক্ষ্যে এবং জীবনের বাকিটা সময় দেশের কল্যাণে গবেষণা করার কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাঁর পছন্দের গবেষণার স্থান হিসেবে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিকে বেছে নেন। তিনি ছিলেন রয়্যাল হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশি ফেলো (এফআরএইসএস), ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র কমনওয়েলথ স্টাফ ফেলো এবং ব্রিটিশ একাডেমির ভিজিটিং প্রফেসর। ইতিহাসশাস্ত্রে মৌলিক গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি ভারতের বিখ্যাত ‘স্যার যদুনাথ সরকার স্বর্ণপদক’ সম্মাননায় ভূষিত হন এবং গবেষণাকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ সিনিয়র ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার ইলিনয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম

বাংলাপিডিয়ায় তাঁর জীবনের নয়টি বছর উৎসর্গ করেছিলেন এবং বাংলাদেশের প্রতিটি বিবরণ নথিভুক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য স্বেচ্ছাপ্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তথ্য সংগ্রহের কাজটি সহজ ছিল না। প্রতিটি কমিটিতে তিন থেকে চারজন করে প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাঁরা ২৬ হাজার এন্ট্রি নিয়ে আসেন। মনে হয়েছিল এতগুলো এন্ট্রির জন্য ন্যূনতম ২০টি খন্ডের প্রয়োজন হবে এবং কাজটি মূলধন-নিবিড় প্রকৃতির কারণে সম্ভব হবে না। পরে ৬ হাজার এন্ট্রিতে স্ক্রিন করা হয়। সব এন্ট্রি ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় অনুবাদ করতে অনেক অনুবাদকের এবং এডিটিং, ফটোগ্রাফি, ডিজাইন, গ্রাফিক্স, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও গবেষণায় বহু হাতের প্রয়োজন হয়েছিল। সবকিছু একসঙ্গে আনার জন্য এটি একটি আশ্চর্যজনক অর্জন ছিল। তাঁর সমন্বিত প্রচেষ্টা ও সম্পাদনায় বাংলাপিডিয়া ১০ খন্ডে বাংলা, ইংরেজি ভাষাসহ ডিভিডি এবং অনলাইন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। যা ইতিমধ্যে দেশের কোটি মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। দেশি-বিদেশি অসংখ্য গবেষক এ গ্রন্থ পেয়ে উপকৃত হয়েছেন। বাংলাপিডিয়া সম্পূর্ণ করতে খরচ হয়েছিল ৮ কোটি টাকা। ১৯৯৬ সালে যখন প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় তখন এশিয়াটিক সোসাইটির অ্যাকাউন্টে ৮ লাখ টাকারও কম ছিল। বাংলাপিডিয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানি, আন্তর্জাতিক সংস্থা এমনকি বেসরকারি ব্যক্তিদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়েছিল। ১৯৯৪-২০০০ সালে আমি জাপানের টোকিও দূতাবাসে কমার্শিয়াল কাউন্সিলর। তিনি সে সময় চারবার গেছেন জাপানে। আমাকে বেশ কয়েকবার পত্র লিখেছেন, ব্রশিওর, ফ্লায়ার পাঠিয়েছেন কীভাবে ন্যাশনাল এনসাইক্লোপেডিয়া প্রণয়নে জাপানি গবেষণা, পরামর্শ ও আর্থিক অনুদানের সংস্পর্শ পাওয়া যায়। শত শত চিঠি লিখেছেন। সরকারসহ যোগাযোগ রেখেছেন বহু জায়গায়।

২০০২ সালে বাংলাপিডিয়া ছাপাতে পাঠানোর কয়েক দিন আগে বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়ার কিছু অংশের সঙ্গে সমস্যার সৃষ্টি হয়। বাংলাপিডিয়া সম্পাদকদের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ ওঠে। সরকার, প্রকল্পের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক, উৎপাদন বন্ধ করার আদেশ জারির পথে। তিনি এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম স্মৃতিচারণা করেছেন- ‘একদিকে আমরা ফিনিশিং টাচ দিচ্ছিলাম, অন্যদিকে প্রধান ফান্ডিং কর্তৃপক্ষ (সরকার) একের পর এক বাধা সৃষ্টি করছে। এমনকি তারা আমাদের উপাদান পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করেছিল। অবশেষে আমরা প্রকৃতপক্ষে সরকারি ছাড়পত্র ছাড়াই বাংলাপিডিয়া প্রকাশ করতে গিয়েছিলাম। ধন্যবাদ, তারা এটি সম্পর্কে পরে কিছুই করেনি।’

আজ বাংলাপিডিয়া বাংলাদেশের ভার্চুয়াল অ্যাম্বাসাডর হয়ে উঠেছে। বিশ্বের প্রায় সব বড় লাইব্রেরিতে বাংলাদেশের একটি সিরিজ আপনি তাকটিতে পাবেন তা হলো বাংলাপিডিয়া, পাশাপাশি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাস। বইটিতে ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, সাহিত্য, পরিবেশ এবং আরও অনেক কিছুর মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ৬ হাজার এন্ট্রি রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেও এই মাত্রার কিছুই করার চেষ্টা করা হয়নি। বাংলাপিডিয়া মূলত সময় ও তথ্য সংরক্ষণকারী সাহিত্য। পশ্চিমে কেউ যখন স্কলারলি কাজ করেন সেখানে সব প্রয়োজনীয় তথ্য সাধারণত বিভিন্ন সংযোজিত প্রকাশনার মাধ্যমে সহজে পাওয়া যায় এবং সহজে অভিগম্য (অ্যাক্সেসযোগ্য)। অথচ এ এঞ্চলে বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞানসমৃদ্ধ গবেষণা করা অসম্ভব। বাংলাপিডিয়া সেই দুর্দশা মোচন এবং বাংলাদেশের সব প্রজন্মের কাছে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক জ্ঞানচর্চার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে বাংলাপিডিয়ার নতুন অনলাইন সংস্করণ প্রকাশের প্রয়াস চলছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সহস্রাধিক নতুন এন্ট্রিসহ পুরনো এন্ট্রিসমূহের হালনাগাদ তথ্য সন্নিবেশ ও পরিবেশিত হবে।

প্রফেসর ইসলাম ১৯৩৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার থানাকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ১৯৬১ সালে বিএ অনার্স ও ১৯৬২ সালে এমএতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন এবং ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। তার আগে তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ও ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৬৮ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দি স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ বিভাগে অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে ‘বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ শীর্ষক গবেষণাকর্মের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

বাংলাপিডিয়া ছাড়াও তাঁর সম্পাদনায় এশিয়াটিক সোসাইটির ফোরা ফনা, কালচারাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, ছোটদের বাংলাপিডিয়া, ঢাকার ৪০০ বছর, তিন খন্ডে বাংলাদেশের ইতিহাস (১৭০৪-১৭৯২) প্রকাশিত হয়। এসব প্রকল্পের জন্য অর্থসংস্থান, নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়নে তাঁর দক্ষ নেতৃত্ব ছিল প্রবাদসম। তিনি ছিলেন বরাবরই বড় মাপের গবেষক, সংগঠক ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনার পৃষ্ঠপোষক। জাতীয় পর্যায়ে জ্ঞানগর্ভ গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি এবং সঠিক সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁর অবিচল ও অয়োময় প্রত্যয়কে জাতি সব সময় সম্মান ও সমীহ করবে। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তিন খন্ডে বাংলাদেশের ইতিহাস (১৭০৪-১৯৭১) প্রথম প্রকাশনার সময় প্রকাশনা অনুদান গ্রহণ নিয়ে একটি স্পর্শকাতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যা তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সুবিবেচনার সঙ্গে মোকাবিলা করেন। ২০০২ সালে বাংলাপিডিয়া প্রথম প্রকাশের প্রাক্কালেও বেশ কিছু স্পর্শকাতর অভিযোগ ও প্রসঙ্গের বেড়াজাল গজিয়ে ওঠে। সেখানেও তাঁর দৃঢ়চিত্ত অবস্থান প্রচেষ্টা জয়ী হয়েছিল।

তাঁর উল্লেখযোগ্য মৌলিক গ্রন্থ ও গবেষণাকর্ম হচ্ছে- ক. বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯০-১৮১৯), খ. বাংলার ভূমিস্বত্ব : মধ্যবর্তী শ্রেণীর উদ্ভব, গ. বাংলাদেশের নদী অববাহিকার গ্রামসমূ হ, ঘ. বাংলাদেশের গ্রামীণ ইতিহাস, ঙ. ফজলুল হক পরিষদ স্মারক বক্তৃতা, চ. ভূমি ব্যবস্থা ও সামাজিক সমস্যা, ছ. ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, জ. ভূমি ও ভূমি সংস্কার। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম দেশের বিভিন্ন জেলার ব্রিটিশ আমলে প্রকাশিত ব্রিটিশ সরকারের গেজেটগুলোর ওপরও গবেষণা করেন।

সামুদ্রিক ইতিহাস গবেষণায় অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলামের প্রচুর ঝোঁক রয়েছে। তিনি ১৯৯০ সাল থেকে তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে ভারত মহাসাগরের সামুদ্রিক ইতিহাসকে বেছে নেন। ভারত মহাসাগরে আমেরিকানদের আগমনের ইতিহাস ও তৎসংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা দৃঢ়ভাবে সমর্থিত হয়েছে ফুলব্রাইট কমিশন, অ্যাসোসিয়েশন অব কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ একাডেমি এবং কিংস রয়েল কলেজ লন্ডন প্রভৃতি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান দ্বারা। সমুদ্রসীমার ইতিহাস ও সমুদ্রবিজ্ঞানের ওপর তাঁর অনেক মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ দেশি-বিদেশি বহু জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির কাউন্সিল সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর