রবিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

ওদের সঙ্গে মিলাও যারা চরায় তোমার ধেনু

ওয়াহিদা আক্তার

ওদের সঙ্গে মিলাও যারা চরায় তোমার ধেনু

‘আমরা যে ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলাম সেখানে দেখা গেল কৃষকই আমাদের সবচেয়ে ভালো সম্পদ। তাদের না ছিল কোনো আত্মম্ভরিতা, না কোনো মিথ্যা গর্ব। স্বাধীনতার জন্য তারা ছিল আন্তরিক এবং নিবেদিত। এক জোড়া জাঙ্গল বুট; লুঙ্গি, কম্বল অথবা নিয়মিত খাবার, এ কোনো কিছুর জন্যই আমি তাদের কখনো এতটুকু কথা বলতে শুনিনি। সামান্যতম লোভও দেখায়নি কখনো তারা। এই সহজ-সরল, উচ্চাভিলাষহীন মানুষগুলোকে যখনই যেখানে গিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সে নির্দেশ পালন করেছে হাসিমুখে।’ (লাখ প্রাণের বিনিময়ে, পৃ. ২৮৪)। এই কৃষককে নিয়ে কাজ করে কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষি মন্ত্রণালয়কে কৃষককল্যাণ মন্ত্রণালয় বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশের মাটি সোনা ফলা মাটি, এই মাটির সঙ্গে মিশে আছে এই বাংলার কৃষক যাদের অন্যায় দাবিতে রাস্তায় নামার সময় নেই। কারণ তাকে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সময়মতো ফসল রোপণ করতে হয়, সময়মতো নিবিড় পরিচর্যা করতে হয়, সময়মতো ফসল ঘরে তুলতে হয়। তবে এই নিবেদিতপ্রাণ কৃষককে কোনো কোনো সময় রাস্তায় নেমে আসতে দেখেছি সার না পেয়ে।

কৃষি মন্ত্রণালয় খাদ্যশস্যের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এবং কৃষকের নিজস্ব জমিতে উৎপাদন করিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে। কৃষক তাঁর নিজ জমিতে কী ফসল ফলাবে সে স্বাধীনতা তাঁর থাকে কিন্তু আমাদের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীরা পরামর্শ, সার, বীজ ও নিত্যনতুন প্রযুক্তির প্যাকেজ নিয়ে পাশে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে কৃষককে সহায়তা করেন।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। করোনা অতিমারীকালে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৫৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা কৃষিতে উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এ প্রণোদনা পেয়েছে ৭৪ লাখ ৫৯ হাজার ৫৪১ কৃষক। যেখানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ প্রণোদনার পরিমাণ ছিল ১৩১ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং কৃষকের সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ২০ হাজার ৪৫৫। এ বছর মোট ৩ কোটি ৮৬ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপন্ন হয়েছে, তার মধ্যে ৪৮ লাখ ৭২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি থেকে ২ কোটি ৮ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপন্ন হয়েছে। এ তথ্য থেকে অনুধাবন করা যায় বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারীতে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই অনুধাবন করেছিলেন। বিশ্ববাজারে গমের মূল্য যেখানে টনপ্রতি ২০০-২২৫ ইউএস ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে, সেখানে বর্তমানে তা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি প্রায় ৪৭০ ইউএস ডলার হয়েছে। বাংলাদেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের নিশ্চয়তা থাকায় ভয়াবহ করোনা অতিমারীতে বাংলাদেশের খাদ্যের বাজার অস্থির হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতার সঙ্গে খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রাধান্য দিয়ে থাকে প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদনের ওপর। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বাংলাদেশে চালের পর্যাপ্ততা, প্রাপ্যতা ও ক্রয়সীমার মধ্যে মূল্যের ওপর নির্ভর করে। নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘ সূর্যালোক প্রাপ্তি, সেচের জমির সহজলভ্যতায় বাংলাদেশের ফসল উৎপাদনের উত্তম মৌসুম শীতকালের রবি মৌসুমকেই গণ্য করা হয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, প্রতি বছর মাথাপিছু কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। শুধু রবি মৌসুমে বোরো ধান, গম, ভুট্টা, শীতকালীন শাকসবজি, সূর্যমুখী, ডালজাতীয়, তেলজাতীয় ফসলের মধ্যে জমির প্রতিযোগিতায় বোরো ধান প্রাধান্য পায়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য চাল, গম ও ভুট্টা উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন। সেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ কোটি ৫৫ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। প্রতি বছর আমাদের গম আমদানি করতে হয়। এ বছর মাত্র ১২.৩৪ টন গম দেশে উৎপাদন হয়েছে। আমাদের দেশে গম চাষের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বোরো ধান চাষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গম উৎপাদনের জন্য জমি অপ্রতুল হয়ে পড়ে। একই জমিতে ভুট্টার চাহিদা ও বিক্রির নিশ্চয়তা থাকায় উৎপাদন বেড়ে ৫৬.৬৩ লাখ মেট্রিক টন হয়েছে। যে ফসলকে কৃষক লাভজনক মনে করে সে ফসল চাষে তারা উদ্বুদ্ধ হন। এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেই সরকার প্রণোদনা দিয়ে কৃষকদের কৃষি মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিভিন্ন ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করে। আলু, ডালজাতীয়, তেলবীজ-জাতীয়, সবজি-জাতীয় এসব ফসলকেও শীতকালে বোরো জমির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হয়। গত বছর আলু উৎপাদন হয়েছিল ১০০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি এবং এ বছর ১০৬ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। আলুতে গত বছর কৃষক দাম পেয়েছে। তাই কৃষক এবার আলু উৎপাদনে ঝুঁকেছিল। ধারণা করা হয়, করোনাকালে ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে আলু থাকায় এবং বন্যার কারণে অন্যান্য সবজি উৎপাদন তুলনামূলক কম হওয়ায় গত বছর আলুর চাহিদা বেশি ছিল। গ্রীষ্মকালীন পিঁয়াজ এ বছর ৭ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। এজন্য পিঁয়াজের বাজার এবার এখনো অস্থির হয়নি। একটি দেশ সব ধরনের খাদ্যপণ্য উৎপাদন করে না। অগ্রাধিকার প্রদান করে চাহিদাভিত্তিক ফসল উৎপাদন করে এবং আমদানির মাধ্যমে অন্যান্য ফসলের ঘাটতি পূরণ করে। কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের জন্য কোন কোন দেশে চাহিদা রয়েছে তা নিরূপণে এবং চাহিদা মোতাবেক জোগান দেওয়ার প্রস্তুতি, বিনিয়োগ ও উৎপাদন করার সুযোগ সৃষ্টি করছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ব্যবস্থা করে শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যের সঠিকতা নিয়ে অনুযোগ রয়েছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অধীন ১৪ হাজার ৯২টি ব্লক আছে। প্রতিটি ব্লকে একজন করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকেন। তাদের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে কৃষিসংক্রান্ত সব তথ্য মাঠপর্যায় থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে আসে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য আমদানি-বিকল্প খাদ্যশস্য উৎপাদন ও উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মধ্যে দেশের চাহিদার অতিরিক্ত বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করা এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের প্রসার ঘটানো।

সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ে একটি টিমের সঙ্গে সফরে খুলনা, সাতক্ষীরা ও যশোর অঞ্চলে কৃষি গবেষণা উদ্ভাবিত কিছু নতুন প্রযুক্তি দেখতে যাই। উপকূলীয় অঞ্চলে অভাবনীয় সফলতার মুখ দেখতে পেয়েছে ওই অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকরা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে অসময়ের উৎপাদিত শিম, গ্রীষ্মকালীন টমেটো ও তরমুজ। লবণাক্ত অঞ্চল খ্যাত খুলনা অঞ্চলে এর আগে ফসলের জমিতে শুধু ঘের করে চিংড়ি উৎপাদনে কৃষক উৎসাহিত হতেন। এখন তারা ঘেরের চারদিকের আইলে গ্রীষ্মকালীন শিম উৎপাদন করছেন। শত শত হেক্টর ঘেরের জমির আইলে ও রাস্তার দুই পাশে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় এ শিম উৎপাদনে ওই অঞ্চলে এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি পড়ে নেই। এ ছাড়া এক দৃষ্টিতে যত দূর চোখ যায় সবুজের সমারোহ। ঘেরের আইলে তরমুজের গাছ রোপণ করে ঘেরের ওপর জালির মাধ্যমে বিছিয়ে দেওয়া লতানো গাছের নিচে ঘেরের পানিতে মাছ ও পানির ওপরে ঘেরের চারদিকে সবুজ, হলুদ বিভিন্ন জাতের তরমুজ ধরে আছে। তরমুজ গাছের পাশেই রোপণ করা হয়েছে মরিচ গাছ। কোথাও তরমুজ, কোথাও শসা, কোথাও ঝিঙ্গা, রাস্তার দুই ধারে ঢেঁড়স গাছ। লতানো-জাতীয় সবজি চাষে ঘেরের আইল ব্যবহারে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। লবণাক্ত অঞ্চল সাতক্ষীরার কলারোয়ায় দেখা যায় অধিকাংশ ফসলি জমিতে ধানের পাশাপাশি পলিথিন শেড নির্মাণ করে নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের সহায়তায় ৮৪ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতি বিঘায় তারা গত বছর এক থেকে দেড় লাখ টাকার গ্রীষ্মকালীন টমেটো বিক্রি করতে পেরেছেন। এবার উৎপাদন সিজনে প্রতিবেশী দেশ থেকে টমেটো এসে যাওয়ায় কৃষক গতবারের তুলনায় দাম কম পাচ্ছেন বলে জানান। বাংলার কৃষির বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় যেসব ফল ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল সেসব বিদেশি ফল এখন আমাদের দেশি ফলে পরিণত হয়েছে। কীনা যোগ হয়েছে বাংলার ফলের ঝুড়িতে। ড্রাগন ফুট, কমলা, মাল্টা, স্ট্রবেরি, উন্নত জাতের পেয়ারা, আম, পার্সিমন, এভোকেডো, রামভুটান, খেজুর, ত্বিনসহ উচ্চমূল্যের বিভিন্ন ফল উৎপাদন হচ্ছে আমাদের দেশে। বান্দরবান জেলায় কফি ও কাজুবাদাম চাষের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কফি ও কাজু রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। অপ্রচলিত ফল ও ফসলের সমাহারের এ অভাবনীয় দৃশ্য না দেখলে বোঝা যাবে না বাংলার কৃষকের সক্ষমতা ও বাংলার কৃষির বৈচিত্র্য রূপ!

বাংলাদেশে ফিরে এসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ভাষণে ুবঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, এ আমার জীবনের সাধনা, এ আমার জীবনের কাম্য।’ বঙ্গবন্ধুর কন্যা সেই বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায়। শুধু ভাত খেয়ে আমরা এখন পেট ভরাতে চাই না, চাই পুষ্টিসমৃদ্ধ সুষম খাবার। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক তাঁর বক্তব্যে প্রায়ই বলেন, ‘পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতি ও মেধাবী প্রজন্ম তৈরিতে ভাতের পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টিসমৃদ্ধ সুষম খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। ভাতের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খাবার যেমন : দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, ফলমূল, শাকসবজি খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। সব মানুষের জন্য পুষ্টিসম্মত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে কৃষি মন্ত্রণালয় নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। করোনার সময় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের গুরুত্ব সবাই অনুধাবন করেছেন। এখন জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। আমরা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়েছি। এখন অপুষ্টির দুষ্টচক্র থেকে বের হতে চাই। প্রধানমন্ত্রী করোনাকালে পারিবারিক পুষ্টিবাগানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ৯৭.৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় দেশের ৪ হাজার ৫৫৪ ইউনিয়ন ও ৩৩০ পৌরসভায় ১০০ করে মোট ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৪০০ পারিবারিক সবজি পুষ্টিবাগানের প্রদর্শনী স্থাপনের কার্যক্রম চলমান আছে। আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলছি দেশের বাইরে কিছুদিন থাকার পর শত রকমের উপাদেয় খাবারেও মন ভরে না, কখনো মনে হয় একটু খিচুড়ি বা ঝাল মাংস কোথাও পাওয়া যেত বা পান্তা ভাত কাঁচামরিচ পাওয়া যেত! এখানেই আমাদের রক্তে-মাংসে সংস্কৃতির জড়িয়ে যাওয়াকে অনুভব করা যায়। দেশের বাইরে হোটেল থেকে ১ কিমি হেঁটে একটু ভাত ও গরুর মাংস খেয়ে গুনে গুনে ৩০ ডলার দিয়েও মন খারাপ হয় না, আফসোস হয় না। আমাদের দেশের মানুষ তিন বেলা পেট পুরে ভাত খায়, এখন মাছ, মাংস, ডিম, দুধের কোনো অভাব নেই।

স্বল্প আয়ের মানুষও শর্করার পাশাপাশি আমিষ খাবার জোগাড় করতে পারছে। ছোট একটি সুন্দর দেশ আমাদের বাংলাদেশ। ফুল, ফল, ফসলে সমৃদ্ধ এ দেশের আনাচে কানাচে মোড়ে মোড়ে ফসলে, সবজিতে বাজার উপচে পড়ছে। খাবারের কোনো অভাব নেই। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে বরেন্দ্র অঞ্চলের চেহারার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। হেক্টরের পর হেক্টর জমিতে ধান চাষের পাশাপাশি ফলের সঙ্গে বিস্তীর্ণ বাগান তৈরি হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী আমবাগানের পাশাপাশি মাল্টা, কমলা, ড্রাগন ফুট, কুল বরইয়ের বাগান চোখে পড়ে। ধানের জমিতে ফলবাগান, কোথাও ফলবাগানে ধান চাষ হচ্ছে। আগে শুধু বছরে বৃষ্টিনির্ভর আমন ধানই ছিল এ এলাকার মূল ফসল। নতুন নতুন জমি সেচের আওতায় এনে উর্বর বরেন্দ্র অঞ্চলে সবুজের সমারোহ চোখে পড়ে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বছরে ১০-১১ শতাংশ করে ফসলের জমি ক্রমান্বয়ে ফলের জমিতে পরিণত হওয়ায় ধানিজমি ফলের বাগানে পরিণত হচ্ছে। স্বল্প সময়ের শস্য আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পেতেন। একসময় বরেন্দ্র অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জমি ঠা ঠা ছায়াহীন ধু-ধু প্রান্তর হিসেবে শূন্য থাকত। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ধীরে ধীরে এসব জমি সেচের আওতায় এনে আমন ছাড়াও উফশী বোরো ধান, শাকসবজি, ফলমূল ব্যাপক চাষাবাদ করছেন। কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলেও আগাম শিম, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, পেঁপে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, করলা, শসা, লতিরাজ কচু, মাচায় তরমুজ, কুলসহ ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম, পেয়ারা, পিঁয়াজবীজ উৎপাদন শুরু হয়েছে। ৯৫ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ১২ লাখ মেট্রিক টন আম রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের প্রায় ২২ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালে ৪০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। বর্তমানে দেশে খাদ্য ঘাটতি না থাকলেও কতটুকু উদ্বৃত্ত থাকলে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ হবে সে বিষয়ে পরিসংখ্যানের অভাব আছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের খাদ্যবাজার কখনো সংকুচিত হবে না বরং সম্প্রসারিত হবে। আমাদের দেশের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে আর এর প্রয়োজনও আছে। বাংলাদেশ বৃদ্ধদের দেশ হোক আমরা চাই না বরং আমাদের যুবসমাজ শিক্ষিত ও কর্মঠ এবং প্রশিক্ষিত হোক এটাই কাম্য।’ তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মাটি ও পানি বড় সম্পদ। অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। গ্রামে আর্থসামাজিক কর্মকান্ড গতিশীল হওয়ায় দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, নিত্যনতুন পণ্য ও খাদ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। দেশের অভ্যন্তরেই পণ্যবাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের উন্নয়নের লক্ষ্য হলো গ্রামের মানুষের উন্নয়ন, আর্থিক সচ্ছলতা তথা ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। আমাদের নিজস্ব বাজার সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবনমান উন্নত হয়েছে এবং পুষ্টি চাহিদার বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে এ অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পেছনে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি ও কৃষকের অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। পরিশেষে রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী রচিত ‘চাষী’ কবিতার চরণ উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি।

‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,

দেশ মাতার-ই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।

দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়?

পুণ্য অত হবে না’ক সব করিলে জড়।

 

মুক্তিকামী মহাসাধক মুক্ত করে দেশ,

সবারই সে অন্ন জোগায় নাইক গর্ব লেশ।

ব্রত তাহার পরের হিত, সুখ নাহি চায় নিজে,

রৌদ্র দাহে শুকায় তনু, মেঘের জলে ভিজে।

আমার দেশের মাটির ছেলে, নমি বারংবার

তোমায় দেখে চূর্ণ হউক সবার অহংকার।’

লেখক : অতিরিক্ত সচিব।

সর্বশেষ খবর