শনিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

চোখ কান খোলা রাখতে হবে

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল কিছুতেই যেন রহস্যাবৃত সেই দুষ্কর্মের রেশ কাটতে চাইছে না। আলোচনা-সমালোচনা, ঘটনা আর ঘটনার পেছনের ঘটনা এসব নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ চলছেই। তবে এটা দিব্যি বলা চলে বাংলাদেশ প্রাথমিক ধাক্কাটা ঠিকই সামলে নিয়েছে। পর্দার আড়ালের শকুনির দল চেয়েছিল এ দেশে হিন্দু-মুসলিমে একটি ধুন্ধুমার রক্তারক্তি লাগুক। আর তারা দিব্যি আয়েশে পরম সুখে মরা লাশের মাংস খুবলে খাবে। দেশের সরকার ও জনতার সতর্কতায় তাদের সে আশা এ যাত্রা কিছুটা হলেও অপূর্ণই থেকে গেল। এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম। বাকি ১০ শতাংশের বেশির ভাগ হিন্দুধর্মাবলম্বী। ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসের প্রতি যথেষ্ট বিশ্বস্ত ও অনুরাগী হলেও যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছে। মাঝেমধ্যে এখানে-সেখানে কিঞ্চিৎ হা হতাস্মি হলেও তা কখনই মারাত্মক দাঙ্গায় রূপ নেয়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম ১৯৭১- যখন বিপুলসংখ্যক হিন্দুধর্মাবলম্বী প্রাণ বাঁচাতে বাস্তুভিটা ছেড়ে পাশের দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। তবে তার জন্য দায়ী ছিল পাক হানাদার বাহিনী, এ ভূখন্ডের মুসলিম সম্প্রদায় নয়।

দুষ্টচক্রের হিসাব-নিকাশ ছিল পরিষ্কার। পূজামন্ডপে কোনো দেবমূর্তির পায়ের ওপর কোরআন শরিফের একখানি কপি রেখে দাও। এরপর ফেসবুকে লাইভ করে মুসলিম সম্প্রদায়কে উসকে দাও। আর যায় কোথায়? সর্বত্র মারদাঙ্গা লেগে যাবে। তবে তাদের এ হিসাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এ দেশের মানুষের ঐতিহ্যগত অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। ঘটনাস্থল কুমিল্লার আশপাশের জেলাগুলোয় কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিলেও সরকার, বিরোধী পক্ষ কিংবা ডান-বাম কেউই এমনকি বহুল পরিচিত ধর্মভিত্তিক দলগুলোও এতে কোনোরূপ সমর্থন জোগায়নি। উপরন্তু জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন সংগঠন সবাইকে নিয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ করে স্পষ্ট বার্তা দিয়ে দেয়- সাম্প্রদায়িক মতলববাজি এ দেশে হালে পানি পাবে না। ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে সুদূর রংপুরে যে হাঙ্গামা ঘটে তা কিছুটা কৌত‚হলোদ্দীপক। অনেকে মনে করছেন কুমিল্লা ও আশপাশের জেলাগুলোয় প্রশাসন কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলায় দুষ্টচক্র সেখানে সুবিধা করতে না পেরে তাদের উদ্দেশ্য সাধনে অনেক দূরের ওই জেলাটিকে বেছে নেয়।

তবে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। ঘটনাস্থল থেকে ওসি সাহেব যখন কোরআন শরিফটি উদ্ধারে ব্যস্ত, অনতিদূরে জনৈক ব্যক্তি তা ফেসবুকে লাইভ করছিলেন। এটা কি ওসি সাহেবের জ্ঞাতসারেই হচ্ছিল? এ ধরনের একটি ঘটনা ফেসবুকে এভাবে প্রচারের ফলে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা কি তিনি বিবেচনায় নিলে ভালো হতো না? ওই ব্যক্তিকে তো তখনই গ্রেফতার করা জরুরি ছিল। ঘটনাস্থল ও আশপাশ জেলাগুলোয় যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে তা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তার  ব্যবস্থা আর একটু দ্রুত জোরদার করতে পারত না? হাজীগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যে হতাহতের ঘটনা ঘটে তা কি পরিহারের সুযোগ ছিল না? উত্তেজনা প্রশমনে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো কি তৎক্ষণাৎ একটি কার্যকর ভূমিকা নিতে পারত না? ফেসবুকে দেওয়া উসকানির বিপরীতে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে কি জরুরি ভিত্তিতে একটি পাল্টা বক্তব্য তুলে ধরা যেত না?

আরও কিছু হতাশার দিক আছে। সরকার ও বিরোধী পক্ষ নির্বিশেষে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে অবস্থান নিলেও একে অন্যের সমালোচনায় মুখর ছিল। সন্দেহ নেই, দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার মূল দায়িত্ব সরকারের। বিরোধী পক্ষেরও এখানে গঠনমূলক ভূমিকা রাখার প্রয়োজন ও সুযোগ রয়েছে। আলোচ্য ঘটনার প্রকৃতি বিচারে এটা খুবই স্পষ্ট যে এটি একটি দেশবিরোধী শক্তির সুপরিকল্পিত চক্রান্ত, যারা দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসবের সময়টাকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির জন্য বেছে নিয়েছিল। এ ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো বহিঃশক্তির যোগসাজশ থাকাও অসম্ভব নয়, যারা দেশটিকে বিভক্ত ও দুর্বল করতে চায়। এহেন পরিস্থিতিতে কি রাজনৈতিক দ্ধন্ধ ভুলে গিয়ে দেশের স্বার্থে সবাই মিলে অভিন্ন কণ্ঠে বক্তব্য রাখা জরুরি হয়ে দাঁড়ায় না? বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে চেয়েছিল মতলববাজরা। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এ দেশের মানুষ জানে সাম্প্রদায়িক সংঘাত কারোর জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। এ দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে বিভিন্ন সময় অনেক পরিবর্তন এলেও বাংলাদেশের মানুষ কখনো সাম্প্রদায়িকতায় সায় দেয়নি। কখনই পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’- এ মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হয়নি। তবে মনে রাখা দরকার, একটি দেশের জন্য এ মূলনীতি কেবল তখনই অর্থবহ হতে পারে যখন এটি নিজস্বভাবে একটি শক্ত ভিতের ওপর দন্ডায়মান থাকে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আপামর জনতার সামগ্রিক ঐক্যই কেবল একটি দেশকে এ ধরনের সুদৃঢ় ভিত্তি দিতে পারে। একটি জাতি যখন ঐক্যবদ্ধ থাকে কেবল তখনই তা বহিঃশক্তির সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলার হিম্মত দেখাতে পারে। ’৭১-এ এ জাতি পাকিস্তানের সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে নাকে খত দেওয়াতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বস্তরের মানুষের ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে উঠেছিল বলেই। আজও জাতির শক্তিমত্তা সেই একই ঐকতানের ওপরই নির্ভর করবে। সাম্প্রদায়িক সংঘাতে দেশ ও জাতির অন্তর্নিহিত শক্তির অযাচিত অপচয় কেবল তাদেরই কাম্য হতে পারে যারা এ দেশকে শক্তিশালী অবস্থানে দেখতে চায় না। দেশপ্রেমিক শক্তিকে এ বিষয়ে চোখ-কান সব সময় খোলা রাখতে হবে। সাধু সাবধান! সবাই ভালো থাকুন।

লেখক : অধ্যাপক ও সভাপতি, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর