বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পরীক্ষা আতঙ্ক ও আমাদের করণীয়

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী

পরীক্ষা আতঙ্ক ও আমাদের করণীয়

কেস স্টাডি-১  : সাদমান, বয়স ১৪ বছর। বর্তমানে তার সবচেয়ে বড় ভয় ক্লাসের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ।

পরীক্ষা যখন সমাগত হয় তখন সে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভালো স্টাডি থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা এলে সে প্রায়ই মনে করে তার ফেল করার আশঙ্কা খুব বেশি। তার ভিতর আরও মনে করার প্রবণতা তৈরি হয় যে সবকিছু জানা সত্ত্বেও পরীক্ষার কক্ষে সঠিকভাবে লিখে আসতে ব্যর্থ হবে।

কেস স্টাডি-২ : প্রিয়াংকা, বয়স ১৬ বছর। পড়াশোনায় বেশ আন্তরিক ও সিরিয়াস। বিপত্তি অন্য জায়গায়। পড়াশোনাসংক্রান্ত কোনো পরীক্ষা এলে তার উদ্বিগ্নতার মাত্রা খুব বেড়ে যায়। পরীক্ষার কয়েক দিন আগে থেকে সে ঠিকমতো আর টেবিলে পড়তে বসতে পারে না। পরীক্ষার আগে তার খাওয়া-দাওয়া কমে যায়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। কারও সঙ্গে কথা বলতে চায় না, মানুষের সঙ্গে এমনকি পরিবারের লোকদের সঙ্গেও মেলামেশা কমিয়ে দেয়।

ওপরের দুটি ঘটনা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ভীতিসংক্রান্ত বিষয় নির্দেশ করে। ছাত্রজীবনে যে বিষয়টি বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি ভয় পায় তা হলো ‘পরীক্ষা’। পরীক্ষা মানেই একটু বাড়তি চাপ, যার প্রভাব সবার কাছে সমানভাবে বিরাজমান নয়। শিশুর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, বাবা-মার সঙ্গে সন্তানের আবেগীয় উষ্ণ সম্পর্ক, শিশুর ওপর পরিবেশ ও প্রতিবেশের মনঃসামাজিক প্রভাব ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মানসিক সক্ষমতার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এরূপ চাপের অন্যতম হলো পরীক্ষাভীতি। শিক্ষার্থী মাত্রই পরীক্ষার সময় স্বাভাবিকভাবে এক ধরনের মানসিক চাপ অনুভব করে। এ চাপ বেশি মাত্রায় অনুভূত হলে ‘হাইপোথ্যালামাস’, ‘পিটুইটারি গ্রন্থি’ ও ‘এড্রেনাল কটেক্স’ এ সংগঠনটি একত্রে অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে ব্যক্তি বেশি মাত্রায় আবেগীয় অবস্থা অনুভব করে। আবার ব্যক্তি যখন অতিমাত্রায় মানসিক চাপ বোধ করে তখন ব্যক্তির শরীরের অভ্যন্তরে বেশি মাত্রায় ‘কর্টিসোল’ নামক হরমোন ক্ষরণ হয়। ফলে ব্যক্তির মধ্যে এক প্রকার ভীতি পরিলক্ষিত হয়।

পরীক্ষাভীতির মনস্তাত্ত্বিক ও অন্যান্য কারণ-

(!) পরিবেশগত কারণ : ১. বাবা-মা কর্তৃক সন্তানের ফলাফল-সংক্রান্ত উচ্চাশা। ২. বাবা-মা যখন সন্তানের ওপর অত্যধিক প্রত্যাশা প্রয়োগ করেন। ৩. বাবা-মা যখন সন্তানের পরীক্ষার ফলাফলকে সামাজিক মর্যাদার মানদন্ড হিসেবে গণ্য করেন। ৪. বাবা-মা যখন প্রায় সময়ই সন্তানকে অন্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে তুলনা করেন। ৫. অকৃতকার্যে শিক্ষকের বিরূপ মন্তব্য বা শিক্ষক-সংক্রান্ত অন্য কোনো সমস্যা।

(!!) পাঠসংক্রান্ত সমস্যা : ১. অনিয়মিত পড়া। ২. পরীক্ষার আগে সারা রাত পড়া। ৩. ট্রপিক্সের অর্থ না বুঝে মুখস্থ করা। ৪. সঠিকভাবে রিভাইস না দেওয়া। ৫. পড়ার বিষয় মনে করতে ব্যর্থ হওয়া। ৬. রিভাইসিং নোট তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া। মনস্তাত্ত্বিক কারণ : ১. পরীক্ষা-সংক্রান্ত নেতিবাচক চিন্তা। ২. পরীক্ষা -সংক্রান্ত আত্মবিশ্বাসের অভাব। ৩. পরীক্ষা ও ফলাফল-সংক্রান্ত অযৌক্তিক চিন্তা। ৪. যদি ফেল করি তবে মানসম্মান নষ্ট হবে এরূপ অযৌক্তিক চিন্তা। ৫. শতভাগ সঠিক ফল প্রাপ্তির আশা নতুবা মূল্যহীন হয়ে পড়ার অযাচিত আশঙ্কা।

অন্যান্য কারণ : ১. জনতার ভীতি : অনেক শিশু বহুসংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে কথা বলতে, বসতে এমনকি লিখতে ভয় পায়। ২. বংশগত কারণ : যদি আগে বাবা-মার এরূপ ভীতি থেকে থাকে তবে তা তার সন্তানের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। ৩. স্বয়ংক্রিয় ¯œায়ুতন্ত্রের গঠন : মানুষের ¯œায়ুতন্ত্রের মধ্যে দৃঢ়তা ও নমনীয়তার দিক দিয়ে পার্থক্য বিদ্যমান। যাদের ¯œায়ুতন্ত্রের গাঠনিক কার্যক্রম নমনীয় তারা একই সময়ে বহুসংখ্যক উদ্দীপক দ্বারা সহজে উদ্দীপিত হয়। যেহেতু পরীক্ষার কক্ষে শিশুর সামনে একই সময়ে বহুসংখ্যক উদ্দীপক উপস্থিত হয় সেহেতু যাদের মস্তিষ্কের গঠন নমনীয় তারা পরীক্ষা কক্ষে অনেক উদ্দীপক দ্বারা সহজে প্রভাবিত হয় ও ভীতি অনুভব করে।

পরীক্ষাভীতি দূর করতে বাবা-মার করণীয় : ১. বাসায় পড়ার পরিবেশ তৈরি করুন : পরীক্ষার সময় শিশুকে একটি কোলাহলমুক্ত পরিবেশ উপহার দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এটা শিশুর পড়ার মনোযোগ আকর্ষণে সহায়ত করবে। ২. শিশুকে ভালোভাবে লক্ষ্য করুন : শিশুটি পরীক্ষাভীতিতে আক্রান্ত কি না বোঝার জন্য তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করুন। পেটব্যথ্যা, বমি বমি ভাব, খাবারে অরুচি, ঘুম না আসা, মন ভালো না থাকা, পড়া ভুলে যাওয়া ইত্যাদি বলে দেবে শিশুটি পরীক্ষাভীতিতে আক্রান্ত। ৩. শিশুর ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে সহায়তা করুন : ‘তুমি পারবে’ এমন  উক্তি শিশুর মনোবল তৈরিতে যথেষ্ট সহায়ক; যা পরীক্ষাভীতি দূরীকরণে সাহায্য করে। ৪. শিশুর পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন : শিশুর ঘুমের ঘাটতি তার মনোযোগ-বিচ্ছিন্নতার অন্যতম কারণ। সুতরাং প্রতিদিন কমপক্ষে সাত-আট ঘণ্টা শিশুর ঘুমের ব্যবস্থা করুন। এতে তার মন শান্ত থাকবে। ৫. পড়ার মধ্যে শিশুকে বিরতি দিন : শিশুকে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিরতি দিয়ে তার সঙ্গে গল্প করুন কিংবা মাঝেমধ্যে প্রিয় কার্টুন দেখতে দিন। এতে তার মানসিক চাপ কমবে।

পরীক্ষার্থী কর্তৃক অনুসরণীয় : ১. সময়মতো রিভাইস দিতে হবে। ২. পরীক্ষার আগে হালকা খাবার খেতে হবে। ৩. রুটিন অনুযায়ী পড়তে হবে। ৪. পড়ার মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে বিরতি রাখতে হবে। ৫. পরীক্ষার দিন আগে কমপক্ষে সাত-আট ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। ৬. পরীক্ষার আগের দিন সবকিছু গুছিয়ে রাখতে হবে। ৭. পরীক্ষার ভীতিসংক্রান্ত বিষয়ে পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। ৮. পরীক্ষার আগে রিভাইসের সময় মেইন পয়েন্ট, সাব পয়েন্ট, দিন, তারিখ বা বিশেষ বিষয় লিখে রাখা যেতে পারে। তাতে মেমোরাইজ ভালো হবে। ৯. পরীক্ষার সময় অন্যের কোনো বিষয়ে নজর না দিয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে পরীক্ষা দিতে হবে।

লেখক : কলেজ শিক্ষক।

সর্বশেষ খবর