শনিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

এগিয়ে চলছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ

নাফিসা বানু

এগিয়ে চলছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ

১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য গতিশীল যোগ্য দক্ষ ও যথাযথ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এ পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছে। ক্ষুদ্র আয়তনের উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে। অপ্রতিরোধ্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। যোগ্য নেতৃত্ব ও যথাযথ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, বৈদেশিক বাণিজ্যের বিস্তৃতি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, শক্তিশালী বাজার পরিকল্পনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানি, শিল্পায়ন প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা নজিরবিহীন। এ ছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকার বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ১০ মেগা প্রকল্প, ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণকাজ হাতে নিয়েছে। আশা করা যায় খুব অল্প সময়ে সরকারের এসব মেগা প্রকল্পের সুফল দেশের মানুষ ভোগ করতে পারবে। যার ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। মেগা প্রকল্পগুলো হলো- ১. পদ্মা বহুমুখী সেতু ২. মেট্রোরেল ৩. পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ ৪. দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুনধুম পর্যন্তরেললাইন নির্মাণ ৫. রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ৬. মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ৭. এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ ৮. কয়লাভিত্তিক রামপাল থারমাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ৯. পায়রা বন্দর নির্মাণ ও ১০. সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প।

এ মেগা প্রকল্পের বাইরে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইপিজেড) প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এ কার্যক্রমের সূচনা করা হয়েছিল। এ ছাড়া উল্লেখ্য, দেশের মোট রপ্তানির ২০ শতাংশ হচ্ছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ইপিজেড) মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলাদেশে আটটি চলমান ইপিজেডের মাধ্যমে বেপজা জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমানে আরও চারটি ইপিজেড নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২০১৭ সালে গৃহীত প্রকল্প চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় ১ হাজার ১৫০ একর জমিতে ‘বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পথ সহজতর করার জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ করা হবে। বেপজার সাফল্যের কথা বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকার তিনটি নতুন ইপিজেড স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে। সেগুলো হলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যশোর জেলায় একটি, দেশের উত্তরাঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে একটি এবং পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের কাছাকাছি এলাকায় একটি। এ তিনটি ইপিজেড বাস্তবায়নের কাজ বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন।

অগ্রগতির ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা হলো উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদার স্থানে বাংলাদেশের পদার্পণ। বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভুক্ত হতে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ তিনটি শর্তই পূরণ করে। স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। আগেই উল্লেখ করেছি জাতিসংঘ সাধারণত তিনটি সূচকের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে। এ ক্ষেত্রে তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করে এগিয়ে গেছে। উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হওয়া উচিত কমপক্ষে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার। সেখানে দেখা যায় ২০২০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হিসাব করা হয় ২ হাজার ২৪ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে ৬৬ পয়েন্টের প্রয়োজন হয়। সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট ৭৫.৩। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে কোনো দেশের পয়েন্ট ৩৬-এর বেশি হলে সে দেশকে এলডিসিভুক্ত করা যায়। সাধারণত পয়েন্ট কমে ৩২ আসার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জিত হয় সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট কমে হয়েছে ২৫.২।

দেশের জিডিপির হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। একটি দেশের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক বছর) যে পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয় তার মোট মূল্যই হচ্ছে জিডিপি। কোনো দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির শতকরা হারকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। জিডিপির মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনীতির আকার ও শক্তি প্রকাশ পায়। বিশ্বব্যাপী এটাই অর্থনৈতিক সামর্থ্য নির্ণয়ের গ্রহণযোগ্য ও বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৩১৭.৪৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে দাঁড়ায় ৮৬০.৯১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৮, ২০১৯ সালে জিডিপির হার ছিল যথাক্রমে ৮% ও ৭.৯%। ২০২১ সালে সম্ভাব্য হারে আশা করা যায় ৯.৫%। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আসে প্রধানত পাঁচ খাত থেকে- উৎপাদন, পাইকারি-খুচরা ব্যবসা, পরিবহন, নির্মাণ ও কৃষি। আনুমানিক ৬৭% জিডিপি নির্ভর করে বাংলাদেশের উল্লিখিত পাঁচ খাতের ওপর।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মন্তব্য করেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। এর মধ্যে বিশেষ করে শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার ও জন্মহার কমানো, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম অন্যতম।

ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনের জন্য দেশটির জন্মের ৫০ বছরের মধ্যে দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি ও তথ্যের মাধ্যমে দেশের সম্প্রচার কার্যক্রম সমৃদ্ধ হচ্ছে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ই-নথির প্রচলন, সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পাদনের বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজ, স্বচ্ছ ও দ্রুত সম্পাদনের জন্য চালু করা হয়েছে ই-পেমেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিং। এ ছাড়া তৈরি হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। দেশের সব কটি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়। এসব সফলতা বাংলাদেশের ডিজিটাল উন্নয়নের ফল।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেড়ে চলেছে। রেমিট্যান্স বেড়েছে, কৃষিশিল্পের উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানও বেড়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, মূলত প্রান্তিক পর্যায়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। অর্থনীতিতে বাংলাদেশ বর্তমানে ৩৭তম এবং দ্রুতবর্ধনশীল দেশ হিসেবে পঞ্চম। ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ এখন একটি উচ্চারিত নাম। বর্তমানে পাকিস্তান ও ভারত এ দুটি দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশেই শক্ত। বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি শক্ত অবস্থানে দাঁডাতে যেন পারে সে আশায় বাংলাদেশের জনগণ আজ বুক বেঁধে আছে। জন্মের ৫০ বছর পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশ আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে ক্ষুধা ও প্রায় দরিদ্র মুক্ত দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জোয়ারের কান্ডারি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিনি তাঁর পিতা বাঙালি জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন। অন্তরের গভীর থেকে তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা ও তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন দীর্ঘজীবী হোন। তিনি যেন বাংলাদেশকে বিশ্ব অর্থনীতির একটি মর্যাদাপূর্ণ শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেন। তা হলেই জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।

লেখক : সদস্য (অর্থ), নির্বাহী বোর্ড, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ খবর